Advertisment

মাদার টেরিজার লাখ লাখ টাকার চেক জালিয়াতি, পার্কস্ট্রিট খেকে সিঙ্গাপুরে লালবাজার!

মাদারের সঙ্গে দেখা করার পরই ঘোলা হল জল। মাদার জানালেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ চেক বা ড্রাফট নিয়ে এ ভাবে যাতায়াত করেন না। অতএব পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ জমা পড়ল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
mother teresa cheque fraud case detected by lalbazar kolkata police

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।

শীতের রাত। শেষ দিককার লোকাল। এ ঋতুতে, এ সময়ে সব কিছুর মধ্যেই কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। লেবু চা বিক্রেতা খুচরো গুনতে গুনতে ঝিমোচ্ছে, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত বাচ্চা মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে কিংবা মাফলার মুড়ি দিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে ঝালমুড়িওয়ালা। অফিস ক্লান্ত বাবুটিও আলগোছে মাথা হেলিয়ে রেখেছেন সিটে। স্টেশন এলে যে যার মতো নেমে পড়ছে।সকলেই সকলকে দেখছে, কিন্তু ঠিক যেন মন দিচ্ছে না।

Advertisment

publive-image

হঠাৎ করেই এক যাত্রীর চোখ পড়ে গেল ব্যাগটার দিকে। আগরপাড়া স্টেশনের পর থেকে এ ব্যাগ যেন বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে আছে। প্রথম দিকটায় লোকে গুরুত্ব দেননি। কারণ, অনেক সময়ে দামি জিনিস তেমন না থাকলে অনেকে গেটের সামনে এসে দাঁড়ান। বিড়িতে দু’টান দিয়ে আবার বসেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটেনি। কয়েকজন যাত্রীর মধ্যে একজন কৌতূহলের বশে চেন টেনে ব্যাগটা খুলে ফেললেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

দেখা গেল অনেকগুলো চেক আর ড্রাফট। সবই হয় মাদার টেরিসা নয় মিশনারিজ অফ চ্যারিটি-র নামে। সবই বিদেশ থেকে এসেছে। সকলে ভাবলেন নিশ্চয়ই মাদারের প্রতিষ্ঠানের কেউ ব্যাগ ফেলে গিয়েছেন। রেলপুলিশের হাতে তুলে দিয়ে দায় সেরে ফেলার বদলে দুই যাত্রী ঠিক করলেন পরদিন এজেসি বোস রোডে মাদারস হাউসে গিয়ে নিজেরাই ব্যাগটা দিয়ে আসবেন।

মাদারের সঙ্গে দেখা করার পরই ঘোলা হল জল। মাদার জানালেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ চেক বা ড্রাফট নিয়ে এ ভাবে যাতায়াত করেন না। অতএব পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ জমা পড়ল। সেটা ১৯৮৫ সাল। লালবাজারে খবর গেল। বিষয়টা জানার পরই পুলিশকর্তারা জালিয়াতির গন্ধ পেলেন। তখন পুলিশ কমিশনার ছিলেন নিরূপম সোম। দমদম বিমানন্দরের ওল্ড টার্মিনালে যেখানে বিদেশের চিঠি-পত্র আসে সেখানে ওৎ পাতলেন গোয়েন্দারা। জানা গেল, মাদার বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে চিঠি এলেই চিঠি সর্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকা কয়েকজন চটপট খামগুলি নিয়ে টয়লেট বা ফাঁকা রেস্টরুমে ঢুকে চেক ও ড্রাফট সরিয়ে ফেলছে। তিনজন চিঠি বাছাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হল। তাদের থেকেই জানা গেল তারা টাকার বিনিময়ে কয়েকজন বাংলাদেশির হাতে তুলে দেয়। প্রাথমিক তদন্তে আন্দাজ গেল জালিয়াতিটা চলে সিঙ্গাপুর থেকে, কিন্তু তখনও হাতে আসেনি প্রমাণ।

আরও পড়ুন- রবীন্দ্রনাথের মহামূল্য হিরের আংটি নিউমার্কেটের দোকানে!

এরই মধ্যে মাদার্স হাউসে একের পর এক মাদারের গুণমুগ্ধের চিঠি আসতে লাগলো। প্রায় সকলেরই চিঠিতে অভিমান, তাঁরা অর্থসাহায্য পাঠিয়েছেন, কিন্তু হাউসের তরফ থেকে কোনও প্রাপ্তিস্বীকার আসেনি। গোয়েন্দারা বুঝলেন এঁদের সকলেরই চেক, ড্রাফট মাঝপথে বেহাত হয়েছে। এঁদের কাছে পাল্টা চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হল কবে, কার অ্যাকাউন্ট থেকে চেক ভাঙানো হয়েছে। দেখা গেল, অনুমান ঠিক। চেকগুলি ভাঙানো হয়েছে হাবিব ব্যাঙ্কের সিঙ্গাপুর শাখায়, অমর-ব্রাদার্স নামে এক দোকানের নামে। ড্রাফটের পিছনে একটি চিঠিতে মাদারের নামে জাল সই করে অমর ব্রাদার্সকে টাকা দিয়ে দিতে বলা হয়েছে।

এবার সিঙ্গাপুরে গিয়ে হাতেনাতে বিষয়টি ধরার প্রস্তুতি নিলেন গোয়েন্দারা। তাঁরা সেখানে পৌঁছে সেখানকার সিআইডি কর্তাদের সাহায্য নিলেন। জানা গেল, অমর ব্রাদার্স একটি ইলেকট্রনিক্স গুডসের দোকান। ভুয়ো পরিচয় দিয়ে, দিনের পর দিন সেখানে গিয়ে মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে খেজুরে আলাপ জমিয়ে ফেললেন গোয়েন্দারা। আর নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে, দোকানদারদের অসতর্ক এক মুহূর্তে একদিন চোখের নিমেষে হাতিয়ে ফেললেন একটা ব্যাগ, যার ভিতর পাওয়া গেল মাদারের নামে গোটা দশেক চেক। গ্রেপ্তার করা হল দোকানের মালিক-সহ চার জনকে। সেটা ১৯৮৭ সাল। বন্দি প্রত্যার্পণের ব্যবস্থা করতে না পারায় তাদের তখনকার মতো তুলে দেওয়া হল সিঙ্গাপুর পুলিশের হাতে। শুরু হল বিচার, ক্রমে দোষী সাব্যস্তকরণ।

শোনা যায়, কলকাতায় গোয়েন্দারা ফিরে আসার পর সব শুনে মাদার লাখ লাখ টাকা জালিয়াতি নিয়ে একটি কথাও মন দিয়ে শুনতে চাননি। বরং অনেক মমতার সঙ্গে জানতে চেয়েছিলেন, ধৃতরা কজন বিবাহিত, কার ক'টি সন্তান, অপরাধীদের পিতা বা স্বামীর কারণে এইসব নিরপরাধ মানুষগুলোর কোনও ক্ষতি হবে না তো?

(গত কয়েক দশকে কলকাতার নানা অপরাধমূলক ঘটনার সময়ে তখনকার সংবাদপত্র ও পত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং ক্রাইম সংক্রান্ত নানা বইয়ে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতেই প্রকাশ করা হচ্ছে এই ফিচার–ধর্মী কলামটি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য, অপরাধী–আইনজীবী, বাদী–বিবাদী পক্ষ, পুলিশ–গোয়েন্দা, মামলার খুঁটিনাটি ইত্যাদির দায় কোনও অবস্থাতেই কলামের লেখক কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়। শহরে শোরগোল ফেলে দেওয়া ক্রাইমগুলির কয়েকটি এ কলামে গল্পাকারে জানাতে চাওয়া হয়েছে মাত্র।)

Kolkatar Kalo Katha lalbazar kolkata police
Advertisment