Advertisment

মাতৃভাষাচর্চা ও ভিন্ন ভাষার চাপ

প্রধান ভাষাগুলির প্রত্যেকটিতেই সরকারি কাজ হতে পারে সংবিধান অনুসারে। সদ্য নির্বাচিত কেন্দ্রীয় সরকারের সেই দূরদর্শিতা থাকলে মঙ্গল। তাঁরা হিন্দি ভাষাকে শিক্ষাঙ্গনে বাধ্যতামূলক করতে গিয়ে হঠকারিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে সুবুদ্ধির পরিচয় রেখেছেন।             

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Amader Rajniti

অলংকরণ- অরিত্র দে

ভাষা মনের ভাব প্রকাশ করার অন্যতম মাধ্যম। একইসঙ্গে কথ্য বা লেখ্য ভাষা মনের ভাবকে গোপন করার একটি প্রকৃষ্ট মাধ্যমও বটে। সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে ভাষার বিবর্তন হয়েছে প্রবলভাবে। শুধুমাত্র মুখোমুখি ব্যক্তিগত বাক্যালাপে মনের কথা বলা বা লুকোনো নয়, ভাষা এখন মানুষের জীবনের অনেকটা জুড়ে। সমাজ বা রাষ্ট্রের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান থেকে শুরু করে দলিল-দস্তাবেজে, আইনি কাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা, কূটনৈতিক কাজকর্ম, বিজ্ঞান চর্চা থেকে বিনোদন… সবই ভাষার ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক মানুষ শব্দ ও ভাষার অবলম্বন ছাড়া ভাবতেও পারে না। স্বাভাবিকভাবেই ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়, যা সাধারণ অবস্থায় অবহেলিত হয়, কিন্তু বিশেষ মুহূর্তে মানুষকে রাজদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য করতে পারে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙলাদেশ হয়ে ওঠা।

Advertisment

আরও পড়ুন, বিরোধীর দায়িত্ব ও গুরুত্ব

ভাষা মানুষের ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা দু-একটি বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাহায্যে সহজেই বোঝা যায়। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের মস্তিষ্কের যে অংশ বিশেষভাবে বড়, সেটা হল গুরু মস্তিষ্কের সামনের দিকটা। এই অংশটি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে ভাষার ব্যবহার শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে এবং সম্ভবত ভাষার হাত ধরেই তার বিপুল বৃদ্ধি। ভাষার সাহায্যেই জটিল হয়েছে মানুষের চিন্তাভাবনার পদ্ধতি৷ আধুনিক সমাজের অসামান্য বৈচিত্র্য ও জটিলতার পিছনেও ভাষার ভূমিকা কম নয়। ভাষা মানুষের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কথা বোঝার ও বলার জন্য মানুষের মস্তিষ্কে আছে বিরাট এক ব্যবস্থা। সেই মন্ত্রকের প্রথম দপ্তরটির কাজ হল মানুষের কণ্ঠকে অন্যান্য আওয়াজ থেকে আলাদা করা। তারপর ক্রমশ মগজের অভিধান মিলিয়ে শব্দ ও বাক্য বোঝা এবং প্রয়োজনমতো উত্তর দেবার জন্য এলাহি বন্দোবস্ত।

মানুষের ভাষা তো অজস্র। একথাও চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরীক্ষায় প্রমাণিত যে একের অধিক ভাষা শিক্ষা অ্যালঝেইমার্স জাতীয় স্মৃতিঘাতী রোগ প্রতিহত করতে সাহায্য করে। তাহলে কি মাতৃভাষার কোনো আলাদা গুরুত্ব আছে? শোনা যায় সম্রাট আকবর একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছিলেন, আজকের দিনে যাকে অতি নিষ্ঠুর বলা হবে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কিছু শিশুকে এনে তিনি একটি জায়গায় রেখে দিয়েছিলেন, যেখানে কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলত না। আকবর দেখতে চাইছিলেন, তাদের নিজে থেকে নিজের নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে শুরু করে কিনা। বলা বাহুল্য, তারা আদৌ কথা বলেনি। অর্থাৎ মাতৃভাষা জন্মের আগে থেকে মাথার মধ্যে গাঁথা থাকে না বা জিনের শরীরে খোদিত থাকে না অপরিবর্তনীয় রূপে। মাতৃভাষা মায়ের শরীর থেকে শিশুর শরীরে আসে না, আসে মায়ের (বা অন্য কারো) মুখ থেকে শুনতে শুনতে।

তা বলে মানুষের জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। যদি শুধুমাত্র বিজ্ঞানের দিকটুকু দেখা যায়, তবে বলতে হবে যে মাতৃভাষা মস্তিষ্কের মানচিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন ধ্বনিগুলির (phonemes)  জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত স্নায়ুরা মাথার মধ্যে কেমনভাবে বিন্যস্ত থাকবে, তা একজন ইংরেজ, একজন জাপানি আর একজন বাঙালির ক্ষেত্রে আলাদা। দশ বছর বয়সের পর কোনো দ্বিতীয় ভাষা প্রথমবার শেখা শুরু করলে সেই ভাষার উচ্চারণে সেই ব্যক্তির মাতৃভাষার উচ্চারণের ছাপ থেকে যাওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুন, নির্বাচনের ফল: দয়া ও অধিকার

এ তো নীরস বিজ্ঞান। মাতৃভাষা একটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে সংজ্ঞায়িত করে। তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র‍্যের বাহক সেই ভাষা। রোম সাম্রাজ্যের পতন এবং চার্চের আধিপত্য খর্ব হবার পর ইউরোপ জুড়ে যখন বিভিন্ন জাতির নিজস্ব দেশ বা রাষ্ট্র গড়ে উঠছিল, তার অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল ভাষিক পরিচয়। গুটেনবার্গের ছাপাখানা প্রথম যে মুক্তি ইউরোপীয়দের উপহার দিয়েছিল, তা হল ল্যাটিন আধিপত্য থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার মুক্তি। বিভিন্ন ভাষায় বাইবেল অনূদিত হয়ে ল্যাটিন বিশারদদের ক্ষমতা এবং  ভ্যাটিকানের সর্বময়তাকে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে এও এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। মধ্যযুগেও মাতৃভাষার রাজনীতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ণায়ক।

আধুনিক বিশ্বায়িত পৃথিবীতে কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মাতৃভাষাকে কতটা শক্ত করে আঁকড়ে থাকবেন, তা অনেকাংশে নির্ভর করে তাঁরা নিজের অঞ্চলে যথেষ্ট কাজের সুযোগ পাচ্ছেন কিনা, তার ওপরে। যদি সেই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ পুরনো দিনের কাজকর্মকে পেশা হিসেবে নেন (যেমন চাষ বা বংশের পেশা ইত্যাদি), অথবা যদি সেখানে নতুন শিল্প-বাণিজ্য ঘিরে যথেষ্ট কর্মসংস্থান থাকে, তাহলে তাঁরা মাতৃভাষাতেই নিজেদের প্রয়োজনীয় কথা চালিয়ে যেতে পারবেন। অপরপক্ষে যদি কোনো অঞ্চলে অল্পবয়সী, প্রশিক্ষিত, উচ্চাভিলাষী মানুষের সংখ্যার তুলনায় উপযুক্ত কর্মসংস্থান অনেক কম হয়, তাহলে সেই অঞ্চলের মানুষ কাজ পাবার জন্য জরুরি বিদেশী ভাষার দিকে বেশি ঝুঁকবেন। যদি সেসব ভাষার জ্ঞান কোনোভাবে সামাজিক সম্মানের সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়, তবে সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃভাষা অবহেলিতও হতে পারে। তা সত্ত্বেও সেই জনসমষ্টির মনে মাতৃভাষার একটি ঠাকুর-পট থেকেই যাবে। যদি সেই "নিজের" ভাষা আক্রান্ত হয়, অবদমিত হয়, তবে সেই জাতির অস্মিতা আহত হবে, কারণ মাতৃভাষা শুধু ভাষা নয়, একটি ভাষিক জনজাতির স্বাতন্ত্র‍্যের প্রতীক। তাঁদের ভাষাকে পিছনে ঠেলে দেবার চেষ্টা করা মানে তাঁদের সংস্কৃতি ও পরিচয়কে সামগ্রিকভাবে আক্রমণ করা।

আরও পড়ুন, জুন: মানবাধিকারের পক্ষে ভয়াবহ এক মাস

ভারত ভূখণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারণ যেই করুন, তাঁকে বা তাঁদের মনে রাখতে হবে যে ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতির সমন্বয়ে গঠিত এই রাষ্ট্র। ভারত একটি মিশ্রণ, যৌগ নয়। বৈচিত্র‍্যের মধ্যে ঐক্য সম্ভব… তা ভারতের সৌন্দর্য, কিন্তু অন্তত ভাষার প্রশ্নে এই সমস্ত জাতির পক্ষে যৌগের পরমাণুদের মতো নিজেদের মৌল অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে এক নতুন অভিন্ন ভাষিক সত্তায় বিলীন হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার অপচেষ্টা না করলে বরং দেশের মানুষ এক সুন্দর দ্রবণের মতো মিশে থাকতে পারবে। ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের সেই বোধ ও দূরদৃষ্টি ছিল বলেই ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই। প্রধান ভাষাগুলির প্রত্যেকটিতেই সরকারি কাজ হতে পারে সংবিধান অনুসারে। সদ্য নির্বাচিত কেন্দ্রীয় সরকারের সেই দূরদর্শিতা থাকলে মঙ্গল। তাঁরা হিন্দি ভাষাকে শিক্ষাঙ্গনে বাধ্যতামূলক করতে গিয়ে হঠকারিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে সুবুদ্ধির পরিচয় রেখেছেন।

একটি ফেডারেশনের মধ্যে একটিমাত্র ভাষাকে সবার ওপর চাপিয়ে দিতে গেলে কী হতে পারে, তা বুঝতে পাকিস্তানের উদাহরণটুকুই যথেষ্ট। আরএসএস- বিজেপি পাকিস্তানকে পছন্দ করে না। আশা করা যায় তাদের নেতারা এমন অপকর্ম করবেন না, যা পাকিস্তান করেছে। পাকিস্তানের আদি পিতা মহম্মদ আলি জিন্নাহর মনে হয়েছিল একটি শক্তিশালী ও সুসংহত দেশ বানাতে হলে একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা থাকা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে সব সরকারি কাজ হবে। তাঁর বেছে নেওয়া ভাষাটি ছিল উর্দু। বর্তমান ভারতীয় শাসকদের "হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান" প্রকল্পের সঙ্গে জিন্নাহর "উর্দু-ইসলাম-পাকিস্তান" প্রকল্পের মিল প্রচুর। পাকিস্তানের সুবিধা ছিল এই যে ধর্ম নিয়ে মতভেদ সেখানে কোনো সমস্যা তৈরি করেনি, তবু বিরাট সমস্যায় তাদের পড়তে হল ভাষার কারণে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপরেও উর্দু চাপিয়ে দিতে গিয়ে গোল বাধল। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রমনা ময়দানে জিন্নাহ সাহেব ঘোষণা করলেন, "Let me make it very clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan." (সেই "দেশদ্রোহী' তকমা! কি অদ্ভুত মিল দুই দেশের দুই শাসকে!) জিন্নাহ বলে চললেন, " Without one state language, no nation can remain tied up solidly together and function." তারপর কী হয়েছিল আমরা জানি। রাষ্ট্রভাষা বাঁচাতে গিয়ে রাষ্ট্রই ভেঙে গেল।

জিন্নাহ পণ্ডিত ছিলেন। ইতিহাস পড়েই তাঁর মাথায় রাষ্ট্রভাষার ভূত চেপেছিল। বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, "Look at the history of other countries." তিনি নিশ্চয় ইউরোপীয় দেশগুলির কথা বলছিলেন। আসলে "নেশন" ব্যাপারটা এখনও আমরা সম্পূর্ণ বুঝি না, জিন্নাহও বুঝতে ভুল করেছিলেন। একটি প্রধান ভাষা সম্পন্ন নেশন স্টেটগুলির সঙ্গে বহুভাষিক কনফেডারেশন স্টেটের বাস্তবতাকে তিনি গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি।

ভারত পাকিস্তানের চেয়েও বেশি জটিল ও বৈচিত্র্যময়। এখানে ভাষা উপভাষার সংখ্যা অনেক বেশি। আমরা পরস্পরের ভাষা শিখতে পারি। একাধিক ভাষা শেখা মগজের পক্ষেও ভালো। রাষ্ট্রনেতারাও শিখুন হিন্দি বাদে আরও কিছু প্রাদেশিক ভাষা, তাতে মগজের পুষ্টি হবে। অন্য ভাষাগুলিকে ধ্বংস করার মাধ্যমে ভারতীয় সত্তাকে অতি সংকুচিত করার চেষ্টা না করলেই তাঁরা দেশের উপকার করবেন। এদেশের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী নিজেদের মাতৃভাষার প্রাধান্য এবং স্বতন্ত্র ভাষিক অস্তিত্ব বজায় রেখেই ভারতীয় থাকবেন, ভারতকে ভালবাসবেন।

(কৌশিক দত্ত পেশায় চিকিৎসক। মতামত ব্য়ক্তিগত)

Advertisment