Advertisment

ময়নাগড়ের ময়নামতী

এখান থেকেই নীচে ভূগর্ভে যাওয়ার পথ ছিল, যা এখন নিরাপত্তার খাতিরে বন্ধ। মাটির নীচে একাধিক গুপ্তকক্ষ থাকায় ময়নাগড়ে নলকূপ বসানো সম্ভব হয়নি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Maynagarh Heritage

ময়নাগড়ের দরওয়াজা

(শুধু শহর কলকাতা নয়, এ রাজ্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক স্থাপত্য, যারা নিত্য চোখের সামনে থাকে বটে, কিন্তু তার ইতিহাস ও তার সঙ্গে বিজড়িত কাহিনিগুলি অজ্ঞাতই থাকে। এ রাজ্যের কিছু ‘হেরিটেজ’ হিসেবে চিহ্নিত ও ‘হেরিটেজ’ ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা স্থাপত্যের কথা তুলে আনছেন দুই স্থপতি সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগ। সে সব স্বল্প-জানা কথা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।)

Advertisment

আরও পড়ুন, এ এক অন্য লাল বাড়ির গল্প

যদি বলি, কোলকাতা থেকে মোটে তেষট্টি কিলোমিটার গেলেই পরিখায় ঘেরা এক জলদুর্গে পৌঁছে যাবেন, যেখানে ইতিহাসের গা ছমছমে গল্পরা ঘুরে বেড়ায় নির্জন ঘাটে, মাটির তলার গভীর গোপন কুঠুরিতে, দুর্ভেদ্য কাঁটা বাঁশগাছের জঙ্গলে! সত্যিই রূপকথায় শোনা গল্পের মতো এমন এক জায়গা আছে, খুব বেশি দূরেও নয়, পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার পশ্চিমে। ময়না ব্লকের গড়সাফাৎ মৌজায়, কংসাবতী নদীর ধারে, ৬৫ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে এই প্রাচীন দুর্গ। ৩০টি ছোট ছোট দ্বীপ, ৩৫টি ছোটবড় খাল বা পরিখা নিয়ে বাহুবলীন্দ্র রাজবংশের দুর্গ – ময়নাগড়।

Moynagarh Heritage ৩০টি ছোট ছোট দ্বীপ, ৩৫টি ছোটবড় খাল বা পরিখা নিয়ে বাহুবলীন্দ্র রাজবংশের দুর্গ – ময়নাগড়

কথিত আছে, ধর্মমঙ্গল কাব্যের নায়ক পালবংশের রাজা লাউসেন ময়না দুর্গের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিতীয় একটি মতানুসারে, দ্বিতীয় মহীপাল (৯৮৮-১০০৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই একাধিক নদীবেষ্টিত দ্বীপের মতো স্থানে জলদুর্গটি তৈরি করেন। পাল বংশ শেষ হয়ে যাবার পর বহুদিন ময়নাগড় পরিত্যক্ত ছিল। ছিল জলদস্যু আর ডাকাতদের আনাগোনা। পরে উড়িষ্যা অর্থাৎ উৎকল রাজাদের দ্বারা অধিকৃত হয় ময়না। বাহুবলীন্দ্র রাজাদের অধীনস্থ জনৌতি দণ্ডপাট-এর সদর দফতর বালিসিতাগড় থেকে ময়না দুর্গে স্থানান্তরিত করা হয়। সে ১৫৬১ কি ৬২ সাল। তারপর থেকে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ – সব সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস শুরু হয় এ অঞ্চলে।

ময়নাগড়ের খাস তালুকে পৌঁছতে গেলে এককালে তিনটি পরিখা পার হতে হত। প্রথম পরিখা কালিদহ, পাল রাজাদের সময়ে তৈরি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিখা তৈরি করান গোবর্ধনানন্দ (১৫৬১-১৬০৭)। তৃতীয় পরিখাটি আর নেই। দ্বিতীয়টির নাম মাকড়দহ। সেটিও প্রায় অবলুপ্তির পথে। সরকার তার ওপর তৈরি করেছে কংসাবতী নদীসেতুর সংযোগকারী রাস্তা, সেতুর থাম নির্মাণ করতে গিয়ে বুজে গেছে মাকড়দহ। রয়ে গেছে শুধু কালিদহ। ময়নাগড় যেতে হলে কালিদহ পার না করে উপায় নেই। ফলে নৌকাই এখানে একমাত্র যান।

Moynagarh Heritage ময়নাগড় যেতে গেলে নৌকা ভরসায় পেরোতে হবে কালিদহ

ইতিহাস প্রতি পদক্ষেপে কথা বলে ময়নাগড়ে। দুর্গটি প্রায় দুর্ভেদ্য ছিল তিনটি পরিখার অবস্থানের জন্য। পরিখার গভীরতা অনেক, তাতে ছাড়া থাকত হিংস্র কুমীর। ছিল সর্পসংকুল পদ্মবন। এই দহ সাক্ষী থেকেছে বর্গী আক্রমণ প্রতিহত করার প্রয়াসের (১৭৪০ থেকে ১৭৪৪)। ইংরেজরাও দীর্ঘদিন চেষ্টা করেছে ময়নাগড় দখলের। ওয়ারেন হেস্টিংস এক সময় আদেশ দিয়েছিলেন পরিখা বুজিয়ে ফেলার, যদিও তা কার্যকর হয়নি। এখনো ময়নাগড়ে যাবার জন্য নৌকাই ভরসা। সকাল নটা থেকে বারোটা অবধি নৌকা চলে। তার বাইরে কোনো সময় যেতে হলে পুরো নৌকা ভাড়া করতে হবে। ময়নাগড়ে এখনো বাহুবলীন্দ্র পরিবারের বংশধরেরা বসবাস করেন, তাঁদের সবারই ব্যক্তিগত নৌকা এবং ঘাট আছে। জীবনযাপনের যাবতীয় প্রয়োজনের জন্য নৌকাই একমাত্র উপায়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত পানীয় জলও আসত নৌকাবাহিত হয়ে। এমনকি মৃত্যুর পর সৎকারকার্যের জন্য কালিদহ পার হয়ে শবদেহ আনীত হয় দুই পরিখার সংযোগস্থলে মাটি কেটে বানানো রাজপরিবারের শ্মশানভূমিতে। এখন ১৭০ ফুট প্রশস্ত কালিদহে ঝুঁকে থাকে শ্যামল ছায়াময় গাছ, নীল আকাশ, রাজহাঁসের সারি। কল্পনাও করা যায় না, এখানেই রাজদ্রোহী প্রজাকে কুমীরের মুখে ছুঁড়ে ফেলা হত একসময়। রাজপরিবারে নববধূ এলে তাঁকে পালকি শুদ্ধ পরিখার জলে চুবিয়ে শুদ্ধ করে রাজবাড়িতে তোলা হত। এবং যে সদ্য বিবাহিত মেয়েটি কালিদহ পার করে একবার ময়নাগড়ে পা রাখত, তার আর কোনোদিন বেরোবার নিয়ম ছিল না। আমৃত্যু থাকতে হত অন্তঃপুরবাসিনী বন্দিনী হয়ে।

moynagarh Heritage টেরাকোটায় ফুটে উঠেছে নৌকের কাজ

দ্বীপের মধ্যে দুর্গ, তা থেকেই নাম ময়নাগড় বা ময়নাচৌরা। চৌরা শব্দটির উড়িয়া ভাষায় অর্থ জলবেষ্টিত ভূখণ্ড। উঁচু ঢিপির ওপর অবস্থানের জন্য এটি দূর থেকে দেখা গেলেও প্রবেশের কোনো উপায় ছিল না। চারপাশে ছিল হিংস্র শ্বাপদসংকুল জঙ্গল যার দুর্ভেদ্য কাঁটা বাঁশ বন এখনো খানিকটা দেখা যায়। বিভিন্ন উঁচু জায়গায় বসানো থাকত কামান, ছিল পাঁচিলের মত উঁচু ঢিপি। ইংরেজ সৈন্য সে সব অতিক্রম করে ময়নায় প্রবেশ করলেও তৎকালীন রাজা জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্রকে জীবন্ত ধরতে পারেনি। কিছু বিশ্বস্ত অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়ির ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে আত্মগোপন করেন জগদানন্দ, জীবদ্দশায় আর সেই গুপ্ত কুঠুরি থেকে বের হননি তিনি।

এমনই সব রোমহর্ষক কাহিনি ময়নাগড়ের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে। ময়নায় রয়েছে বাহুবলীন্দ্র রাজাদের কূলদেবতা রাধেশ্যামসুন্দর জিউর দক্ষিণমুখী পঞ্চরত্ন অর্থাৎ পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট মন্দির। নিত্যপূজা হয় এখানে। পৌষী পূর্ণিমায় হয় রাজাভিষেক পূজা। রাজ্যপাট বা রাজা নেই, তাই রাজটীকা পরানো থাকে বিগ্রহের কপালে, মাথায় থাকে রাজমুকুট। বর্তমান মন্দিরটি উনিশ শতক নাগাদ সংস্কার করা হলেও আদি মন্দির ষোড়শ শতব্দীর তৈরি বলে অনুমান করা হয়। মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দির, তাকে ঘিরে মোটা খিলান যুক্ত থাম দিয়ে ঘেরা অলিন্দ, পাশ দিয়ে নেমে গেছে ঘাটের সিঁড়ি। এ পথ দিয়ে রাজঘাট বা ঠাকুরঘাট দিয়ে রাস উৎসবে শ্যামসুন্দর জিউর বিগ্রহ নৌকাবিহারে বাইরে আসে, দেবতা রাস মঞ্চে অবস্থান করেন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত। শেষ দিন মন্দিরে ফেরার সময় রাজপরিবারের একজন সদস্য বিগ্রহের মাথায় ধরেন সোনারূপাখচিত রাজছত্র। রাসের মেলায় ময়নাগড়ে লক্ষাধিক জনসমাগম ঘটে, ফানুস, আতসবাজি, শব্দবাজি পোড়ানো হয়। এই মেলার আরেক আকর্ষণ বিশাল থালার মাপে তৈরি বাতাসা আর ফুটবলের মাপের কদমা।  

রাজবাড়ির পূর্ব দিকে রয়েছে আটচালা বিশিষ্ট লোকেশ্বর শিব মন্দির। দালান ঘেরা প্রায় বর্গাকার এই মন্দিরের গায়ে খোদাই করে লেখা আছে এটি রানি সারদাময়ী ও রানি বামাসুন্দরী কতৃক ১৯০৯ সালে নির্মিত। যদিও মন্দির গাত্রের টেরাকোটার কারুকাজ দেখলে বোঝা যায় এটি আরো পুরোনো। এই টেরাকোটায় আঁকা হয়েছে নৌকাবিহার, শ্রীকৃষ্ণের গোষ্ঠবিহার, গবাদীপশু থেকে শুরু করে পর্তুগীজ সৈন্য, মুসলমান সৈন্যের ছবি। মন্দিরের ভেতরে ১৫ ফুট গভীরে রয়েছে স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ। কংসাবতী নদীর সঙ্গে এ মন্দিরের সরাসরি সুড়ঙ্গ পথে যোগাযোগ রয়েছে। নদীতে জল বাড়লে শিবকুণ্ড ডুবে যায়। আছে একটি প্রাচীন মুর্তি যা রুক্মিণী দেবী হিসেবে পূজিতা, কিন্তু গঠন শৈলী অনুযায়ী এটি বৌদ্ধ হীনযান তন্ত্রের দেবী তারা। মন্দিরের ঠিক বাইরে শ্বেতপাথরের স্ল্যাবের ওপর একটি শঙ্খ যা অতীতে সূর্যের অবস্থান বোঝার জন্য ব্যবহৃত হত।

Moynagarh Heritage রাজবাড়ির পূর্ব দিকে রয়েছে আটচালা বিশিষ্ট লোকেশ্বর শিব মন্দির

রয়েছে জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্রের স্মৃতিস্তম্ভ, হাওয়ামহল, আয়নামহল, রাজদরবার কক্ষ। এখানে রাজাদের শিকারের নিদর্শন রূপে গোলাকার থামের গায়ে টাঙানো আছে হরিণের মাথা। দেওয়ালে নানা আকারের কুলুঙ্গি, যাতে জ্বলত প্রদীপ। রয়েছে একটি সিন্দুক, যা আজও খোলা যায়নি। এখান থেকেই নীচে ভূগর্ভে যাওয়ার পথ ছিল, যা এখন নিরাপত্তার খাতিরে বন্ধ। মাটির নীচে একাধিক গুপ্তকক্ষ থাকায় ময়নাগড়ে নলকূপ বসানো সম্ভব হয়নি। আছে রাজা রাধাশ্যামনন্দ বাহুবলীন্দ্রের (১৮২২-১৮৮৩) প্রতিকৃতি, যিনি খাল সংস্কার, বাঁধ দেওয়া ইত্যাদি গঠনমূলক কাজ করেন। আবার তাঁরই মৃত্যুর পর তিন পুত্রের বিবাদে রাজ সিংহাসন খণ্ডবিখণ্ড হয়ে কালিদহের জলে তলিয়ে যায়। রাজবাড়ির অন্দরমহলের ঘেরা বারান্দায় এককালে ময়ূর ঘুরে বেড়াত। রাজবাড়ির মেয়েদের জন্য ছিল কড়া অনুশাসন। বিধবাদের এক বেলা স্বপাকে খেতে হত। তাঁদের রান্নার জ্বালানি কাঠ কালিদহের জলে ভিজিয়ে রাখা হত, যাতে সারাদিন সেই ভিজে কাঠ জ্বালিয়ে রান্না করতেই কেটে যেত। তবু সূচিকর্মে, বড়ি দেওয়ায় ময়নাগড়ের মেয়েদের সুনাম ছিল। সত্যজিত রায়ের আগন্তুক ছবিতে ময়নাগড়ের গয়নাবড়ি ব্যবহৃত হয়েছিল।

Moynagarh Heritage ময়নাগড় দেউড়ি

বাকি রইল ময়নামতীর গল্প। রাজা রাধাশ্যামনন্দের অতিরিক্ত বাইজি প্রীতি জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল রানি অপূর্বময়ীর মনে। অন্দরমহল থেকে সরাসরি বারমহলে এসে বাইজি ময়নামতীর ঘরে হানা দেন তিনি, ছিঁড়ে নেন তার নাকের নথ। এই ঘটনায় অন্তঃপুর আর বারমহলের যোগাযোগের পথ চিরতরে বন্ধ করে দেন রুষ্ট রাজা, অপূর্বময়ীর মুখদর্শনও করেননি আর।

২০০৬ সালে ‘হেরিটেজ সাইট’-এর স্বীকৃতি পেয়েছে ময়নাগড়। আজও নাকি  জ্যোৎস্না রাতে কালীদহে ভেসে বেড়ান পদ্মাসনে আসীন এক সাধু। মহলে কান পাতলে শোনা যায় বাইজীর ঘুঙুরের কিংবা রানিদের চাপা কান্নার শব্দ।

Advertisment