২০০৮ সালে ছ'জনের প্রাণ কেড়ে নেওয়া মালেগাঁও বিস্ফোরণের ঘটনায় অভিযুক্ত প্রজ্ঞা ঠাকুর এবারের সাধারণ নির্বাচনে লড়ছেন। একজন মুসলমান হিসেবে আমি কি এই খবরে ভয় পাচ্ছি? না।
মুসলমানরা তাঁকে ভোট না দিলে তাঁদের তিনি কাজ দেবেন না, মানেকা গান্ধীর এই উক্তিতে কি আমি চিন্তিত? একেবারেই না। বরং ওঁর 'হুমকিতে' মজাই পেয়েছি। যোগী আদিত্যনাথ "আলির" সঙ্গে "বজরং বলীর" তুলনা করেছেন বলে কি আমি আঘাত পেয়েছি? হাই তুলে বলি, আরেকটু ভদ্রস্থ ছন্দ খুঁজে বের করা উচিত ছিল ওঁর।
তাঁদের অধিকাংশেরই মোদী-পন্থী অবস্থান দেখে কি আমি টিভি অ্যাঙ্করদের প্রতি ক্ষুব্ধ? না, আমি তাঁদের সাংবাদিকতার ভীরুতা দেখে তাঁদের প্রতি করুণা অনুভব করি।
আমি ভারতীয় মুসলমান। গত পাঁচ বছর ধরে যে বিদ্বেষের রাজনীতি আমার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে, তাতে আমার আর ভয়, রাগ বা হতাশা হয় না। সেসব অনেক পিছনে ফেলে এসেছি আমি।
মে ২০১৪-য় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুসলমানদের কোণঠাসা করার কোনো সুযোগ ছাড়ে নি মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার। সাম্প্রদায়িক গণ হিংসাকে পুরস্কৃত করেছে, নেতারা নিয়মিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে গেছেন, সরকারি নির্দেশে ভেদাভেদের নীতিকে মদত জুগিয়েছে মিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপে গুজবের কারখানাকে ফুলে ফেঁপে উঠতে সাহায্য করেছে, এবং ক্রমাগত "হিন্দুরা বিপন্ন", এই কল্পিত ভয় দেখিয়ে গেছে।
এই প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও সফল বটেই। মুসলমানরা ভয়ের বশবর্তী হয়ে ট্রেনে মাংস নিয়ে সফর করছেন না, গরুর কাছ দিয়ে হাঁটছেন না বা গাড়ি চালাচ্ছেন না, সন্তানদের "অতিরিক্ত মুসলমান শোনায়" এমন নাম রাখছেন না।
কিন্তু সব অনুভূতিরই একটা উর্দ্ধসীমা আছে। ভয়েরও আছে। সেই সীমা অতিক্রম করলে অনুুুভূতিটা ফিকে হয়ে আসে, তারপর একসময় মুছে যায়। প্রতিটি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে লুকিয়ে থাকে সুযোগ। ২০১৭ নাগাদ, যখন মহসিন শেখ, অখলাক, জুনেইদ, এবং পেহলু খানকে কুপিয়ে মারা হয়, মুসলমানদের মধ্যে জেগে ওঠে এক নতুন প্রবণতা। তাঁদের ভয়, বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে জন্ম নেয় তাগিদ - সম্প্রদায়কে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তোলার। "কাকে ভয় করি" নিয়ে বিলাপের বদলে "আমাদের কী করা উচিত" নিয়ে শুরু হয় কথোপকথন। তার মানে বৈঠকখানার আড্ডা নয়। আজ পথে নেমেছেন মুসলমানরা, বস্তিতে অথবা গ্রামে ঘুরছেন, তাঁদের অপেক্ষাকৃত অসুরক্ষিত সহ-ধর্মীয়দের ক্ষমতায়নের স্বার্থে।
যেমন ধরুন আমার শহর লখনউয়ে একদল মুসলমান আমাদের পাশের জেলা সীতাপুরের একটি গ্রাম দত্তক নিয়েছেন। সেখানকার বাবা-মায়েদের তাঁরা বোঝাচ্ছেন, কেন স্থানীয় সরকারি স্কুলে বাচ্চাদের পাঠানো উচিত, গ্রামের মাদ্রাসায় হিন্দি এবং ইংরেজির শিক্ষক নিয়োগ করেছেন, প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষার জন্য বিশেষ ক্লাস চালু করেছেন, পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছেন, এবং মহিলাদের জন্য স্বনির্ভর প্রকল্প চালু করেছেন।
ম্যানেজমেন্টে ডক্টরেট এক মুসলমান মহিলা উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে নিজের শহর বলরামপুরে একটি স্কুল খুলেছেন। তাঁর কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিছিয়ে পড়া মুসলমান পরিবারদের বোঝাচ্ছেন যে, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো জরুরি। এদিকে আবার লখনউয়ে একদল মুসলমান মহিলা এমন এক রান্নাঘর চালান যেখানে দরিদ্র মহিলারা উপার্জন করতে পারেন তাঁদের সন্তানদের উন্নততর প্রতিপালনের জন্য।
এই ধরনের প্রতিটি উদ্যোগের তহবিল আসে নিজেদের মধ্যে থেকেই, কোনোরকম রাজনৈতিক বা সরকারি হস্তক্ষেপের আওতার বাইরে, এবং এদের যৌথ লক্ষ্য হলো সম্প্রদায়ের দীর্ঘমেয়াদী আর্থ-সামাজিক উন্নতি। আমি আমার শহরের উদাহরণ দিলাম, কিন্তু এই জাতীয় আরো উদ্যোগ অন্য কোথাও নেওয়া হয়ে থাকলে অবাক হব না।
অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ার ফলেই রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন মুসলমানরা, এবং তাঁদের কলুষিত ভাবমূর্তির নেপথ্যেও সেই অর্থনীতি (শুনে অন্যায় মনে হলেও)। অনেক মুসলমানের মতেই একমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভবিষ্যত প্রজন্মকে মিডিয়া, সরকার, এবং রাজনৈতিক দল দ্বারা দানবায়নের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
এমন নয় যে এর আগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেন নি মুসলমানরা। বেশ কয়েক দশক আগেই লখনউতে অন্তত তিনটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান - একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি মেডিক্যাল কলেজ এবং একটি ল কলেজ - চালু করেন মুসলমানরা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে একটা বিশেষ তাড়া টের পাওয়া যাচ্ছে। আমার চেনা প্রায় প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে সম্প্রদায়ের জন্য "কিছু একটা করার" ইচ্ছে দেখছি - যে ইচ্ছে এর আগে শুধুমাত্র কিছু দূরদর্শি মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
সাধারণ মুসলমানরা যতটুকু সম্ভব করছেন - কেউ অর্থ দিচ্ছেন, কেউ সময়, কেউ মেধা - তাঁদের নিকটতম মূলস্তরের প্রকল্পের স্বার্থে। এর আগে সাধারণ মুসলমানদের মনোভাবের সঙ্গে এটাই তফাত, যে এর আগে সাম্প্রদায়িক একতার অর্থ ছিল, নির্বাচনের সময় একজোট হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া। এখন বহু সংখ্যক মুসলমান বুঝতে শুরু করেছেন যে প্রতিকূলতার মধ্যেও রয়েছে সুযোগ, দুর্বলতার মধ্যেই আছে শক্তি, ভয়ের মধ্যেও রয়েছে আশা।
কিঞ্চিৎ অবাক লাগলেও, এই মনোভাব বর্তমান রাজনীতিক নীতিরই ফসল। বিক্ষিপ্ত গণপ্রহারের ঘটনা এবং বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যের মাধ্যমে অত্যন্ত বুদ্ধি খাটিয়ে মোদী সরকার নিশ্চিত করেছে 'হ্রাস পেতে থাকা ক্রোধ' তত্ত্বের প্রয়োগ। প্রতিটি গণপিটুনির ঘটনার সঙ্গে একটু একটু করে কমেছে নাগরিক ক্রোধ। ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসেই একটি প্রতিবেদনে প্রতাপ ভানু মেহতা সঠিক লিখেছেন, "বড় ধরনের দাঙ্গা মনকে আঘাতের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত করে, অপ্রিয় শিরোনামের সৃষ্টি করে। তার চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, ঢিমেতালের দাঙ্গা, বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আলাদা আলাদা শিকার, একটা দৈনিক রুটিনের বিভ্রম তৈরি করে। যার ফলে এর প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে, ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।"
এই বিপন্ন সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে কিন্তু হ্রাস পেতে থাকা ভয়ের তত্ত্বও খাটছে। খুব বেশি সময় ধরে ভয় পেয়ে থাকা কঠিন, অসম্ভব। দেশের বহু মুসলমানের ভয়ের পুঁজি ফুরিয়ে গেছে। তার জায়গা নিয়েছে আশা, যা জোর পেয়েছে নিজেদের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি করার চেষ্টা থেকে।
মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াটা অবশ্যই সরকারের বৃহত্তর পরিকল্পনার অঙ্গ, যাতে করে এক বিভ্রান্তিকর হিন্দু অহং বোধের বিকাশ ঘটানো যায় - যে অহং দাঁড়িয়ে আছে মুসলমানদের দানবায়নের ওপর। ভয়ের সীমানা পার করে আসা একজন সাধারণ মুসলমান হিসেবে আমি আশা করব, গত পাঁচ বছরে তাঁর চৈতন্যে গেঁথে দেওয়া মুসলমান-বিরোধী বিদ্বেষও ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন একজন সাধারণ হিন্দু।
ভয়ের মতোই বিদ্বেষও অনির্দিষ্টকাল ধরে রাখা যায় না। দুটোরই সময়সীমা বা এক্সপায়ারি ডেট আছে। আমার ভয়ের মৃত্যু হয়েছে। আপনার বিদ্বেষের কী খবর?