ঠিক ৭৫ বছর আগে এই অগস্ট মাসেই একবার ভাগ হয়েছিল নদিয়া। পুনরায় এই বছর, স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের কালে আবার সেই আগস্টেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন নদিয়া ভাগ হবে, নতুন জেলা হবে রানাঘাট। বাঙালির কাছে কবি জয়দেব, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, কৃত্তিবাস ওঝা, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, দীনবন্ধু মিত্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের স্মৃতিবিজড়িত এই নদিয়া ভাগ হয়ে যাওয়ার খবর সত্যিই বেদনাদায়ক। আর বাঙালিকে হয়তো তার থেকেও বেশি বেদনা দেয় এই নামের বিলুপ্তি। ‘নদিয়া’ নামের সঙ্গে বাঙালির যে অভিজাত ইতিহাস এবং গভীর আবেগ মিশে আছে তা তো কেবলই এই জেলার ঐতিহ্যের জন্য। আজকের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে দাঁড়িয়ে আসুন একবার সেদিকে ফিরে তাকানো যাক।
একাদশ শতাব্দীতে পালবংশের শেষ রাজা রামপাল যখন দুর্বল হয়ে পড়ছেন তখন সেই সময়ের সুযোগ নিয়ে বাংলার রাজনীতিতে আবির্ভাব হচ্ছে সেন বংশের। রাজা বিজয় সেনের পুত্র রাজা বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯ খ্রি:) গৌড় ছাড়াও তৎকালীন সুবর্নগ্রাম ও নবদ্বীপেও দুটি রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। বল্লাল সেন নবদ্বীপে তাঁর জীবনের অনেকটা সময়ই কাটান এবং সে সময়ে ভাগীরথীর তীরে তিনি একটা প্রাসাদও বানান। বর্তমানে নদিয়ার বামনপুকুর গ্রামে যার ধ্বংসস্তূপ ‘বল্লাল ঢিপি’ নামে পরিচিত।
রাজা বল্লাল সেনের পর বাংলার সিংহাসনে বসেন রাজা লক্ষণ সেন (১১৭৯-১২০৫)। তাঁর পূর্বসূরির মত তিনি শিবের উপাসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন বৈষ্ণবধর্মানুরাগী। দায়িত্বভার গ্রহণ করেই তিনি তাঁর রাজধানী পুরোপুরিভাবে স্থানান্তরিত করেন নবদ্বীপে। আমরা সবাই জানি যে লক্ষণ সেনের বিদ্যা ও বিদ্বানের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল। তিনি এমন মানুষদের স্থান দিয়েছিলেন তাঁর রাজসভায়। আর সেই রাজসভা থেকেই বাঙালির কাছে উঠে আসেন আরেক কিংবদন্তী মানুষ; কবি জয়দেব। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘গীতগোবিন্দ’ যে বাঙালির গৌরব, একথা তো বলাই বাহুল্য।
সেন রাজত্বের শেষদিকে বা বলা যায় ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে তুর্কী শাসক কুতুব উদ্দিনের সেনাপতি ইখ্তিয়ার-উদ্দিন্-মহম্মদ-বিন্-বখ্তিয়ার খিলজি বাংলা আক্রমণ করেন এবং তিনি তাঁর কার্যকলাপ চালান এই নবদ্বীপেই। লেখক মিনহাজ-উদ্দিন বা মিনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর ‘তবকাৎ-ই-নাসেরী’-তে এই আক্রমণের উল্লেখ করেছেন। এরপর নবদ্বীপ হয়ে ওঠে বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মঞ্চ। খিলজিদের পরে ইলিয়াস শাহি বংশ, তারপরে হাবসীরা এই বাংলা শাসন করেছেন। এরপর স্থিতাবস্থা আসে হাবসী রাজা মজাফর শাহের প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ হুসেন শাহের হাত ধরে। তিনি হিন্দু ও মুসলমান জমিদারদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ১৪৯৬ সালে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন।
আরও পড়ুন ঐতিহ্যবাহী মুর্শিদাবাদ জেলা: বাঙালির ইতিহাসের ধারক
যে বছর থেকে বাংলায় হাবসী শাসন শুরু হয় সে বছরেই অর্থাৎ ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে (১৮০৭ শকাব্দে) নবদ্বীপে আবির্ভূত হন বিশম্ভর। যিনি পরবর্তীকালে বাঙালির কাছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নামে অধিক পরিচিত হন। ধীরে ধীরে বিশম্ভর হয়ে ওঠেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ভেদাভেদ মিটিয়ে তিনি বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার এবং বাংলায় ভক্তি আন্দোলন শুরু করেন। হরিনাম সংকীর্তনের মধ্য দিয়ে তিনিই বাংলায় প্রথম মিছিলের প্রবর্তন করেন। অনেক পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীর মতে এই পদক্ষেপগুলোর ফলেই সেসময়ে বাংলায় প্রকৃত নবজাগরণ বা রেনেসাঁস হয়েছিল, আবার অনেকে এই মতের বিরোধী। কিন্তু একথা মানতেই হয় যে এইসব ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ঘটেছিল এই নবদ্বীপ তথা নদিয়ার মাটিতেই।
সম্রাট আকবরের আমলে সেনাপতি ছিলেন মানসিংহ। সেসময়ে ‘বারো ভূঁইয়া’দের রাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করতে মানসিংহ তথা মোগল সৈন্যবাহিনিকে সাহায্য করেন নদিয়ার রাজবংশের ভবানন্দ মজুমদার। বাংলা মোগলদের হস্তগত হলে আকবরের পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর খুশি হয়ে ভবানন্দকে বাংলার দায়ভার সামলানোর দায়িত্ব দেন। এইসময়ে ভবানন্দ নবদ্বীপের পাশে রেউই গ্রামে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তীকালে এই গ্রামেরই নাম হয় কৃষ্ণনগর। ভবানন্দের এই বংশেই ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন বাংলার সুবিখ্যাত নরপতি কৃষ্ণচন্দ্র রায়। বর্তমানে কমবেশি প্রায় প্রতিটি বাঙালিই যাঁর নাম শুনেছে তাদের ছোটবেলায়, গোপাল ভাঁড়ের গল্প শুনতে শুনতে।
এছাড়াও এই নদিয়ার মাটিতে (শান্তিপুরের ফুলিয়ায়) জন্মগ্রহণ করেছেন বাংলায় প্রথম রামায়ণের অনুবাদক ও বাংলা সাহিত্যের আদিকবি কৃত্তিবাস ওঝা, চৌবেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন কিংবদন্তী নাটক নীলদর্পণ’-এর রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র, নদীয়ার বিল্বগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহপাঠী, সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষক মদনমোহন তর্কালঙ্কার, নদিয়ার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন নাটককার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
ঐতিহাসিক বাঙালিদের ছাড়াও নদিয়া বিখ্যাত তার খাবার এবং শাড়ির জন্য। কৃষ্ণনগরের কথা মনে পড়লেই বাঙালির মনে পড়ে যায় শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সরভাজা আর সরপুরিয়ার কথা। কথিত আছে স্বয়ং রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই মিষ্টির খুব ভক্ত ছিলেন।
এছাড়াও নবদ্বীপের লাল দই আর রানাঘাটের পান্তুয়া সমানভাবে বিখ্যাত। মিষ্টি ছাড়াও নাম করতেই হয় শান্তিপুরী তাঁত ও জামদানি শাড়ির।
এইসব ঐতিহ্য ছাড়াও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নদিয়ার ভুমিপুত্ররা যে অবদান রেখেছে তার জন্য বাঙালি নদিয়ার মাটির কাছে কৃতজ্ঞ। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঘা যতীনের (১৮৭৯-১৯১৫ খ্রিঃ) কথা। বাঘা যতীন নদিয়ায় তাঁর মামাবাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতেন এবং কৃষ্ণনগর এ.ভি. স্কুল থেকে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। তাঁর নেতৃত্বে কৃষ্ণনগর পাব্লিক লাইব্রেরির পিছনে একটা শক্তিচর্চার আখড়া গড়ে ওঠে।
সবশেষে বলতে হয়, বাঙালির কাছে তার ঐতিহ্যে ভাঙন ধরার কষ্ট যে অনেকটাই তা বলা বাহুল্য। ৭৫ বছর আগে একবার এই নদিয়া ভেঙে তৈরি হয়েছিল কুষ্টিয়া। আবার এক ভাঙনের সম্মুখীন হয়ে নতুন জেলা তৈরি হতে চলেছে রানাঘাট। স্বাভাবিকভাবেই একদিকে বাঙালি সমাজের নানা মহলে যেমন নানা প্রতিক্রিয়া উঠে আসছে তেমনই একথাও ঠিক যে এই ঐতিহ্যকে, এই ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার দায়টাও সেই বাঙালিদেরই।
সূত্র: পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা (নদিয়া জেলা সংখ্যা)
‘নদীয়া: স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ’
‘স্বাধীনতা সংগ্রামে নদীয়া’