এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার কী হবে? এবার ভোট জয়ের পর বলা হচ্ছে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের নতুন নাম হল 'মোদী রিপাবলিক’। কিন্তু মোদী রিপাবলিকও জানে, এবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দেশের অর্থনীতিকে। প্রধানমন্ত্রী তো ক্ষমতায় এসেই এবার মন্ত্রিসভার দুটি বিশেষ কমিটি গঠন করলেন, দুটি বিশেষ কমিটি গঠন করলেন, দুটি কমিটিরই তিনি চেয়ারম্যান। কমিটি দুটি হলো, কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগ বিষয়ক। এবার ভোটের সময় বিরোধীদের প্রধান প্রচারের বিষয়বস্তুও ছিল, দেশের বেকারত্ব, কর্মহীনতা, বৃদ্ধির সমস্যা এবং বিদেশি বিনিয়োগের অপ্রতুলতা। সরকার পক্ষ যতই যুক্তি দিন না কেন, এ হল গোটা পৃথিবীরই প্রবণতা। বিশ্ব জুড়ে আর্থিক চিত্রের স্বরূপ। সর্বত্র কর্মহীনতা ও বৃদ্ধির সঙ্কট।
প্রধানমন্ত্রী আবার দ্বিতীয়বারের জন্য ভোট জিতে কিন্তু আর্থিক বিষয়েই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রথম ক্যাবিনেট বৈঠক শুরুর আগেই কৃষকদের আর্থিক সাহায্য সংক্রান্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেটাই ছিল তাঁর এই ইনিংসয়ের প্রথম ফাইলের প্রথম হস্তাক্ষর। আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াও রেপো রেট কমাল। এই নিয়ে টানা তিনবার ঋন নীতিতে সুদ কমাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। আরও কমানোর রাস্তাও খোলা রাখা হয়েছে। এতে রফতানিকারী ও ছোট শিল্পের সুবিধা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আগামী ৫ জুলাই নতুন সরকারের বাজেট পেশ করবেন নতুন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এই বাজেটের মাধ্যমেও প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের আর্থিক অগ্রাধিকারগুলি স্পষ্ট করার চেষ্টা করবেন। জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স ) চালু করেছে মোদী সরকার। Insolvency and Bankruptcy Code (IBC) চালু করেছিল বিগত মোদী সরকার, কিন্তু তারপরও বৃদ্ধির হার কমার দিকে। অন্য বহু দেশের তুলনায় এখনও ভারতের বৃদ্ধির হার দ্রুত। কিন্তু খরা পরিস্থিতি অর্থাৎ যথেষ্ট বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কৃষিক্ষেত্রের চিত্র খারাপ, কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা উদ্বেগজনক। বেকারত্ব, বেসরকারি ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের অভাব, ও সবশেষে খুবই নিম্নগামী consumption। ওদিকে সঞ্চয়ের হারও উৎসাহব্যঞ্জক নয়।
তাই মোদী প্রথমেই কৃষিক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন। এবারও ভাল বর্ষা না হতে পারে ধরে নিয়ে কৃষকদের দুর্দশা দূর করার ব্যবস্থা নেবেন। বাজার বা তথাকথিত মান্ডিগুলিতে যাতে কৃষকদের সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হয় সেটা দেখতে হবে। কৃষি শস্য সঞ্চয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে। খরা পরিস্থিতি তৈরি হলে গরীব কৃষকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক শস্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিবিধ শস্য চাষের বৈচিত্র্যের ব্যবস্থা কৃষকদের করতে হবে, যাতে জল সম্পদও সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।
কৃষির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার জন্য অ্যাকশন প্ল্যান গড়ে তুলতে হবে। শ্রম নির্ভর শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যাঁরা নতুন নতুন শিল্প করবেন, তাঁদের জন্য আরও সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্প ও বানিজ্য ক্ষেত্রে নতুন নীতি গ্রহণের কথা ভাবছে সরকার, যেমনটা হয়েছে নয়া শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে।
বানিজ্যমন্ত্রীর পদ থেকে এবার সুরেশ প্রভুকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কারণ বানিজ্য ক্ষেত্রে ঘাটতির সমস্যা এখনও বড় দায়। আমেরিকায় যেমন যেমন বানিজ্য প্রতিনিধির একটা অফিস আছে যা সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে রিপোর্ট করে, সেভাবে এখানেও যদি একটা বানিজ্য প্রতিনিধির পৃথক অফিস তৈরি করা হয় এবং সেটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অফিসকেই রিপোর্ট করে, তবে সেটা কেমন হবে তা বিবেচনা করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় আছে উৎপাদন কমিশন। এই কমিশন সমস্ত বানিজ্য চুক্তিগুলির নিরন্তর পর্যালোচনা করে। অনেক বিশেষজ্ঞ এধরনের কমিশন গঠনের পরামর্শ দিচ্ছেন।
নরেন্দ্র মোদী বুঝতে পারছেন, অর্থনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে কিছু কিছু অনিশ্চয়তা আছেই। ভালো বৃষ্টি যদি এবারও না হয় তবে দেশের অর্থনীতির বিপদ, আবার হঠাৎ তেলের দাম যদি খুব বেড়ে যায়, তাহলেও কিন্তু বিপদ। তাই সরকার আপাতত বৃদ্ধিকে গোলপোস্ট না করে কর্মসংস্থানকে প্রধান গোলপোস্ট করতে চাইছে। পরিকাঠামো, রাস্তা, বন্দর নির্মাণে সরকার অনেক কাজ করছে, কিন্তু পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে সরকারের ঋণের বহরও খুব বেশি।
আসলে ভারতের অর্থনীতি আর রাজনীতি আজ এতটাই পরতে পরতে জড়িয়ে আছে যে মোদীর পক্ষেও খুব কঠোর আর্থিক সংস্কারের পথে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সমাধানের চরম রাস্তায় যাওয়া সহজ নয়। ভোটের আগে সব দেশেই শাসকদলকে জনপ্রিয় রাস্তায় হাঁটতে হয়। যাকে আমরা বলি পপুলিজম। আর তাই ভোটের আগে সব সরকারই দাতা কর্ণ হয়ে ওঠেন। যাতে ভোটার দেবতা নারাজ না হন।
২০১৪ সালে মোদী যখন বিপুল ভোটে জেতেন তখন জগদীশ ভগবতী বা অরবিন্দ পানাগাডিয়ার মতো অর্থনীতিবিদরা ভেবেছিলেন, মোদী বোধহয় বিজেপিকে মার্কিন রিপাবলিকান দলের এক ভারতীয় অধ্যায়ে পরিণত করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি একবার আমাকে বলেছিলেন যে সম্পাদকীয় নিবন্ধে ওই ধরনের কঠিন সংস্কারের কথা লেখা যায়, কিন্তু বাস্তবে ওসব পালন করা সম্ভব নয়। ভারতের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভাবনা আছে। সে ভাবনাকে সমাজতান্ত্রিক বলা হোক বা না হোক। আমার মনে হয়, নরেন্দ্র মোদী মধ্যপন্থা অনুসরণ করে এগোতে চাইছেন। অর্থাৎ প্রবল দক্ষিণপন্থী কঠোর সংস্কারও নয়, আবার ঝোলাওয়ালা বামপন্থীদের মতো সবটাই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার অর্থনীতি নয়। এত বড় রাষ্ট্রে ভারসাম্যটা খুব প্রয়োজন।
কৃষকরা নূন্যতম মূল্য না পেলে সেও যেমন সরকারের সমস্যা, আবার কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে গেলে মধ্যবিত্ত সমাজেরও সমস্যা। তাই সরকারকে ভারসাম্য রক্ষা করতেই হবে। কৃষি ঋণ সম্পূর্ণ মকুব করে দেওয়া যে আসলে কৃষি সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়, তা কিন্তু সব রাজনৈতিক দলই জানে। অথচ ভোটের সময়ে সব দলই ঋণ মকুবের কথাই বলে। কৃষকদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো যে একটা বড় প্রয়োজন, তা কে কাকে বোঝাবে। আপাতত এক কথায় বলা যায়, বিদেশনীতি বা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকার এখন অনেকটাই এগিয়ে, কিন্তু দেশের আর্থিক পরিস্থিতির নেতিবাচক চ্যালেঞ্জগুলি কঠোর বাস্তবতা। এবার নতুন সরকারের তাই আর্থিক চ্যালেঞ্জই হল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ হলো মোদী-প্রজাতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ।
নেহরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশে ভারি শিল্পকে খুব বেশি গুরুত্ব দেন, কিন্তু দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পর থেকে কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা সমানে চলছে। অর্থনীতির দিক নির্দেশ নিয়ে আজও যেন ঘড়ির পেন্ডুলাম একবার এদিক, একবার ওদিক। মোদী সরকারের উচিত এই অর্থনৈতিক দোদুল্যমানতা থেকে বেরিয়ে আসা।
কোনো একটা দেশের অর্থনৈতিক মডেলকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করে, কোনো একটা অর্থনৈতিক তত্ত্ব, তা সেটা যতই জগদীশ ভাগবতী বা অমর্ত্য সেনের হোক, চোখ বুজে না গ্রহণ করে সকলের কথা শুনে মোদী সরকার এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিক, সেটাই কাম্য।