সাধারণভাবে আমরা ভাবি, যে কোনও প্রাণীরই নতুন প্রজাতির সন্ধানে যেতে হলে ঢুকতে হবে ঘন জঙ্গলে, হাঁটতে হবে মাইলের পর মাইল, জনবসতি থেকে বহুদূরে। কিন্তু দ্রুত হ্রাস পেতে থাকা বনজঙ্গলের যুগে এই ভাবনা বাস্তবের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। আক্ষরিক অর্থেই 'ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া' আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন কোনও নতুন প্রজাতি।
যেমনটা ঘটেছে বাংলারই এক জনবহুল অঞ্চলে, যেখানে চাঞ্চল্যকরভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন এক প্রজাতির ব্যাঙ। "একেবারে আমাদের চোখের সামনে, চারদিকের ঘরবাড়ির মাঝখানে!" বলেন আবিষ্কারক দলের সদস্য জয়াদিত্য পুরকায়স্থ।
পড়শি রাজ্য আসামের বাসিন্দা জয়াদিত্য পেশায় সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণী বিশেষজ্ঞ, যিনি 'হেল্প আর্থ' নামক একটি এনজিও চালান। তাঁর এবং তাঁর সতীর্থদের রোমাঞ্চকর আবিষ্কারের পটভূমি হলো বাংলার দুটি জায়গা, উত্তর ২৪ পরগণার বাদু এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার খড়দানাহালা। বাংলার সম্মানে নতুন প্রজাতির এই ব্যাঙয়ের পোশাকি লাটিন নামকরণ হয়েছে 'Polypedates bengalensis' (পলিপেডাটিস বেঙ্গলেনসিস), চলতি নাম 'ব্রাউন ব্লচড বেঙ্গল ট্রি ফ্রগ'। এই আবিষ্কার মান্যতা পেয়েছে বিশেষজ্ঞদের সমর্থিত আন্তর্জাতিক জার্নাল 'জুট্যাক্সা'-য়
জয়াদিত্য আরও বলছেন, "বেশিরভাগ গবেষকই জঙ্গল বা কিছুটা আদিম অঞ্চল খোঁজেন, শহর বা শহরতলি এড়িয়ে যান। এর ফলে এই ধরনের আবিষ্কারের ঘটনাও বিরল। এই প্রজাতির ব্যাঙটি না জানি কতকাল ধরে মানুষের চোখের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ কেউ জানতেই পারে নি।" মূলত কাছিম নিয়েই কাজ করেন এই পরিবেশ সংরক্ষণকারী। তবে প্রায়শই তাঁর কাছে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে নানা জায়গা থেকে আসতে থাকে ব্যাঙ, সাপ, এবং অন্যান্য সরীসৃপের ছবি, সঙ্গে সেগুলিকে চিহ্নিত করার অনুরোধ।
পলিপেডাটিস বেঙ্গলেনসিস-এর প্রথম ছবি তাঁর কাছে আসে ২০১৬-র শেষাশেষি, প্রেরক কলকাতাবাসী সর্পপ্রেমী শিবাজি মিত্র। "আমি দেখেই বুঝতে পারি, অন্যরকম ব্যাঙ এটা," বলেন জয়াদিত্য। Polypedates গোত্রের গাছে চড়া ব্যাঙ পাওয়া যায় দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র, তবে তাদের গায়ে সাধারণত ডোরাকাটা দাগ থাকে, এই নতুন প্রজাতির মতো ছোপ ছোপ নয়। "এবং এরা সাধারণভাবে হলুদ রঙের হয়, কিন্তু এর গায়ে হলুদ এবং খয়েরি, দুটো রঙই ছিল। আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। শ্রেণীবিন্যাসের (taxonomy) ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের থেকে বিন্দুমাত্র আলাদা কিছু দেখলেই আমরা আশা করতে থাকি যে একেবারে নতুন কিছু হয়তো পাওয়া গেছে," বলেন জয়াদিত্য।
কিন্তু আরও প্রায় দু'বছর লেগে যায় পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করতে। যতদিন না কিংশুক মণ্ডল নামে বাংলারই আরেক সরীসৃপ প্রেমী জয়াদিত্যকে আরও ছবি পাঠান, ব্যাঙের প্রজাতিটির একটি নমুনা সংগ্রহ করেন, এবং তার ডাক রেকর্ড করেন, ততদিন বৈজ্ঞানিক মতে এগোনো যাচ্ছিল না। গবেষকদের আকৃষ্ট করে ব্যাঙটির ডাক, যা শুরু হতো "সূর্যাস্তের বেশ কিছু সময় পরে, চলত মধ্যরাত পর্যন্ত"। জয়াদিত্যের কথায়, "আজকাল আমরা আণবিক (molecular) গবেষণার ওপর নির্ভর করি অনেকটাই, কিন্তু আগেকার দিনে দুটি প্রজাতির তফাৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের ডাক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। এই ব্যাঙটির খুব সুনির্দিষ্ট 'টক টক' একটা ডাক আছে।" এছাড়াও তিনি জানাচ্ছেন যে ব্যাঙটির "চোখের পিছন থেকে রন্ধ্র অবধি ক্রমান্বয়ে ছয় থেকে ন'টি গাঢ় খয়েরি ছোপ রয়েছে"।
সারা বিশ্বে Polypedates-এর আরও ২৫টি প্রজাতি পাওয়া যায়, অতএব Polypedates bengalensis হলো ২৬ তম। এ ব্যাপারে আমাদের গবেষকরা সহায়তা পেয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ মালয়েশিয়ার ইন্দ্রনীল দাসের কাছ থেকে, যিনি একাধিক Polypedates প্রজাতি আবিষ্কারের খ্যাতি অর্জন করেছেন। ভারতে এই প্রজেক্টটির সমন্বয় করেছেন ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির অনির্বাণ চৌধুরী, এবং ব্যাঙটির উদ্ভব সম্বন্ধীয় কাজে সহায়তা করেছেন গুয়াহাটির মধুরিমা দাস।
ভারতে ৪১০-টিরও বেশি প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া যায়। কিন্তু ব্রাউন ব্লচড ট্রি ফ্রগের আবিষ্কার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, অসুরক্ষিত অঞ্চলে ঠিক কতটা বিপদের মধ্যে বাস করে নানা প্রজাতির প্রাণী। জয়াদিত্য যেমন বলছেন, "এলাকা সুরক্ষিত না করলে অনেক প্রজাতিই হারিয়ে যাবে। তবে আমরা আশা করব, এই আবিষ্কারের ফলে এই অঞ্চলটির মতো অন্যান্য অঞ্চলের ওপর আরও নজর পড়বে। শহুরে এলাকায় জীব বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।"