(শুধু শহর কলকাতা নয়, এ রাজ্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক স্থাপত্য, যারা নিত্য চোখের সামনে থাকে বটে, কিন্তু তার ইতিহাস ও তার সঙ্গে বিজড়িত কাহিনিগুলি অজ্ঞাতই থাকে। এ রাজ্যের কিছু 'হেরিটেজ' হিসেবে চিহ্নিত ও 'হেরিটেজ' ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা স্থাপত্যের কথা তুলে আনছেন দুই স্থপতি সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগ। সে সব স্বল্প-জানা কথা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।)
‘বাবুল মোরা নইহার ছুটত হি যায়!’ সেই নইহার অর্থাৎ বাপের বাড়ি এক্ষেত্রে নিজের পিতৃভূমি, নিজের রাজপাট। লখনউ ছেড়ে আসার শোকে লিখেছিলেন ওয়াজেদ আলী শাহ। ১৮৫৬ সালে সিংহাসন হারিয়ে তিনি চলে আসেন কোলকাতায়। জীবনের শেষ তিরিশটা বছর কাটিয়েছেন এই শহরে, ইংরেজদের দয়ার পেনশনে। নবাবের সাথে কোলকাতায় এসে বসত বাঁধেন তাঁর সাথী, খিদমতগার, আত্মীয় স্বজন মায় বাবুর্চী, চাকরবাকর, দর্জি, নাপিত, পানওয়ালা সহ বহু মানুষ। তাঁদের সকলকে নিয়ে মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে গড়ে উঠল ‘ছোটা লখনউ’। নবাব এখানে একের পর এক প্রাসাদ বানাতে শুরু করলেন, সাথে চলে ধ্রুপদী সঙ্গীত চর্চা, শের-শায়রি, কত্থক নাচ, রহস, জলসা, বিরিয়ানি সহ নানা দমপক্ত খাবারে রসনাতৃপ্তি। সারা কোলকাতার বহু রসিক মানুষ ভিড় জমাতেন মেটিয়াবুরুজে।
১৮৮৭ সালে নবাবের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার তাঁর বহু প্রাসাদ, অট্টালিকা ধ্বংস করে ফেলে। কোলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট তৈরির সময় নবাবীর শেষ চিহ্নও প্রায় মুছে যায়। মেটিয়াবুরুজে রয়ে যায় নবাব ও তাঁর সঙ্গীদের বংশধরদের একাংশ আর শাহী ইমামবাড়ায় শায়িত নবাবের কবর। আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। অক্ষত আছে শুধু দু-একটি প্রাসাদোপম বাড়ি। গার্ডেনরিচ রোডে পুরোনো বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে, বর্তমানে দক্ষিণ পূর্ব রেলর সদর দপ্তরের প্রাঙ্গণে জেনারেল ম্যানেজারের বাসগৃহ ‘বিএনআর হাউস’ ছিল ওয়াজেদ আলী শাহের নাচঘর বা বাগানবাড়ি। তারও আগে ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৫ এ বাড়ি ছিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার লরেন্স পীলের বাসগৃহ।
বিএনআর হাউসের প্রকৃত সৌন্দর্য দেখা যায় গঙ্গাবক্ষ থেকে। মেটকাফে হলের আদলের এই প্রাসাদের স্থাপত্য আথেন্সের ‘টেম্পল অব দ্য উইন্ডস’-এর পোর্টিকোর মতো। এই রীতি অনুসৃত হয়েছিল বলে বাড়িটির গড়ন হাল্কা অথচ মজবুত । কারুকাজ করা পোক্ত বেসমেন্ট-এর ওপর ২৮টি ৩৬ ফুট উঁচু কলামের উপস্থিতির জন্য বিএনআর হাউসকে দেখতে লাগে গ্রিক মন্দিরের মতো। কলাম আর কলোনেড প্রায় সম্পূর্ণ বাড়িটির কাঠামোকে ঘিরে রেখেছে। বাড়িটির দুটি তলা, এক তলায় প্রশস্ত বসার ঘর, দোতলায় শয়নকক্ষগুলি।
১৮৪০ সালে বিএন আর হাউস পরিচিত ছিল বাংলো নম্বর ১১ হিসেবে। অপূর্ব গঠনশৈলী এবং চারপাশের কারুকার্যমণ্ডিত থামগুলি একে খুবই দৃষ্টিনন্দন রূপ দিয়েছিল। ১৮৯৭ থেকে ১৯০২ এ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করেন স্যার টি আর ওয়েন, বিএনআরের প্রাণপুরুষ বলা হয় যাকে। এজেন্ট ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও চেয়ারম্যান হিসেবে বিএনআরের সাথে যার যোগাযোগ প্রায় ৫৩ বছরের। লেডি ওয়েন এ বাড়ির পরিবেশে মুগ্ধ ছিলেন। হামেশাই সন্তানদের নিয়ে নৌকাবিহার করে গঙ্গাবক্ষ থেকে এ বাড়ির রূপ দেখতেন দু চোখ ভরে। এবাড়ির প্রাঙ্গণেই ছিল এজেন্টস জেটি অর্থাৎ একটি ভাসমান প্ল্যাটফর্ম।
১৯৫২ সালে এই বাড়িতে ছিল সেন্ট্রাল হাসপাতাল আর চিফ মেডিক্যাল অফিসারের কার্যালয়। ১৯৬৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া থেকে যন্ত্রপাতি এনে এখানেই চালু হয়েছিল ডেন্টাল ক্লিনিক। সত্তর দশকের মাঝামাঝি বিএনআর হাউসের পিছনদিকে নতুন হাসপাতাল ভবনের প্রসারণের সময় এই প্রাসাদের দক্ষিণ দিকের আটটি থাম ভেঙে ফেলার এবং পরিবর্তে চারটে পিলার বানানোর হঠকারী সিদ্ধান্ত পাশ হয়ে যায় তৎকালীন মেডিক্যাল অফিসারের কলমের এক আঁচড়েই। স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাড়িটির দক্ষিণ দিকের সাযুজ্য। তবু আজও এ বাড়ির অপরিসীম সৌন্দর্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হেরিটেজ হিসেবে ঘোষিত এ বাড়ির রেখচিত্র এঁকেছেন প্রখ্যাত শিল্পী রথীন মিত্র।
এরপর আসা যাক এ চত্বরের আরেক হেরিটেজ বিল্ডিং এজেন্টস অফিস বা জিএম বিল্ডিং-এ। দক্ষিণ পূর্ব রেলের সদর দপ্তরের মূল বাড়ি এটি। ১৮৯৫ সালে প্রাথমিক ভাবে ১২ নম্বর বাংলো ছিল এজেন্টস অফিস। ১৮৯৭ থেকে ১৯০৯ ক্রমশ পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে এটি এক বিশাল অফিস বাড়িতে পরিণত হয়। সে সময় এজেন্ট ও তাঁর সেক্রেটারিদের চেম্বার ছিল দোতলায়, সঙ্গে একটি উন্মুক্ত ওয়েটিং হল, যার ছাদ কাঁচ দিয়ে ঘেরা। কেন্দ্রস্থলে ছিল বিরাট এক মিটিং রুম, চারপাশে চিফ ইঞ্জিনিয়ার, ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার, সিগন্যাল ইঞ্জিনিয়ার আর আর্কিটেক্টদের চেম্বার। একতলায় ছিল পারচেজিং এজেন্ট আর মেরিন সুপারিন্টেন্ডেন্টদের অফিস, ক্লার্ক ও ওয়ার্কিং স্টাফদের অফিস। ১৯০৭ সালে যখন এজেন্ট নতুন প্রাসাদোপম অফিসে চলে গেলেন, ১৯৫১ অবধি এ বাড়িতে ক্যালিগ্রাফি ও ড্রয়িং সেকশন ছিল, তারপর এটি বসবাসের জন্য পালটে ফেলা হয়।
বর্তমান হেড কোয়ার্টার ভবন তৈরি শুরু হয় ১৯০৬ সালের ১০ এপ্রিল, শেষ হয় ১৯০৭ এর মে মাসে। জে ম্যাশন তখন এজেন্ট, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ই এফ স্যান্ডার্স। এ বাড়ির স্থপতি ছিলেন ভি জে এশ। তাঁর এ বাড়ি তৈরির কমপ্লিশন রিপোর্ট অনুযায়ী – ‘বিএনআর হেড অফিস বিল্ডিং তৈরি হয় ১৯০৬-০৭ সালে, খরচ হয় ৭,০১,৯৯৫ টাকা। এর আয়তন ৫৩৬১৩ স্কোয়ার ফুট।’ মূলত ইন্দো সেরাসেনিক ধারায় তৈরি, লাল ইটের মধ্যে কোথাও কোথাও রিলিফ এনেছে পাথর বা টেরাকোটা্র কাজ। এ বাড়ির স্থাপত্য একান্তভাবেই এর নিজস্ব, কোথাও কোন অপ্রয়োজনীয় কারুকাজ নেই। প্ল্যান বর্গাকার, কেন্দ্রে আয়তাকার বিশাল স্পেস। ঢোকার পোর্টিকো, এজেন্ট রুমের বাইরের বারান্দা ও কেন্দ্রের হলটি ক্ল্যাসিকাল ডিজাইনের। অতীতে মূল সিঁড়ি ও সেন্ট্রাল হলের লিফট নির্ধারিত ছিল এজেন্ট ও অতিথিদের জন্য। ক্লার্ক ও পিয়নরা আলাদা ছোট সিঁড়ি ব্যবহার করত। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের স্টাফেদের জন্য আলাদা সিঁড়ি এমনভাবে বানানো ছিল যাতে ওঠানামার সময় কখনই ভিড় না হয়। একতলায় কিম্বা ছাদের নিচের দিকে ছিল রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা। বাড়ির ভিত মাত্র ৪ ফুট গভীর হলেও, প্রশস্ত। সব ঘরের দুদিক খোলা পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের জন্য। ছোট ঘরগুলো সাড়ে ষোল ফিট চওড়া, বড়গুলো প্রায় তিরিশ ফিট, যাতে স্ট্রাকচার ভারমুক্ত থাকে।
বর্তমানে জিএম তৎকালীন এজেন্টের ঘরের উল্টোদিকে এখন শ্বেত পাথরের বাইফারকেটেড সিঁড়ি প্রথমেই দর্শনার্থীদের নজর কেড়ে নেয়। ওই ঘরের সামনে থেকেই সর্পাকৃতি কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে তিন তলায়, যা ভারী দৃষ্টিনন্দন। কেন্দ্রীয় ডোমটি আলো চলাচলের জন্য কাঁচ দিয়ে ঢাকা। বাড়িটির চার কোণে রয়েছে আরো চারটি গম্বুজ, যা দীর্ঘ সমতল ছাদের একঘেয়েমি দূর করেছে। পিছন দিকে কাঠের সিঁড়ি সংলগ্ন বিশাল গোলাকার ঘড়িটি আজ আর নেই, কালের নিয়মে অপসৃত হয়েছে জানলার ওপরে কাঠের কারুকার্যমন্ডিত ছাজা বা সানশেডগুলিও। তবু চুন সুরকি প্লাস্টারে খাঁজ কেটে তৈরি জানলার মাথার আর্চগুলি এ বাড়িকে বাড়তি সৌন্দর্য দিয়েছে। হেরিটেজ রুম, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা কর্মচারীদের জন্য নির্মিত লেডিজ রুম, জিএম-এর ঘরের সামনে বিএনআর-এর মনোগ্রাম লাগানো পুরোনো কাঁচের দরজা এখনো সম্ভ্রম জাগায়।
এ বাড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা চিত্র পরিচালক শ্যুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহার করেছেন একে। বাংলা, হিন্দী, তেলেগু বহু ছবির চিত্রগ্রহণ হয়েছে এখানে, ‘নায়ক’, ‘চেনা অচেনা’, ‘লক্ষ্মী’, ‘চলো পাল্টাই’...তার মধ্যে কিছু নাম।
একদা নবাবের এখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা এই প্রাঙ্গনে রয়েছে চুয়াল্লিশটি সুসজ্জিত বাগান, অপূর্ব স্থাপত্যের কোয়ার্টার, গঙ্গা তীরবর্তী অফিসার্স ক্লাব সহ একাধিক দর্শনীয় স্থাপত্য। শতাব্দী প্রাচীন এ সব বাড়ির আনাচে কানাচে গঙ্গার বাতাস ফিশ ফিশ করে কত যে গল্প শোনায়! বিএনআরের খেলার মাঠে ফুটবল খেলেছেন তুলসীদাস বলরাম মেওয়ালাল, হকি খেলে গেছেন যোগীন্দর সিং আব্দুল হামিদ, ক্রিকেট খেলেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। রয়েছে কবেকারের সব গাছ, তাদের ডালে ডালে অজস্র পাখি। গঙ্গার ধারে রয়েছে এক কালীমন্দির, জনশ্রুতি যার মূর্তির কাঠ এই ঘাটেই ভেসে এসেছিল। গডফ্রে ম্যানশনের বাগান সাক্ষী ১৯৪২ সালের ২ জুন রয়েল এয়ারফোর্সের ৯৭৮ বেলুন স্কোয়াড্রনের প্রথম ব্যারেজ বেলুন উড়ানের। এমনই নানা ইতিহাস বুকে নিয়ে ভীষণভাবে জীবন্ত এই চত্বরে সম্প্রতি নিয়মিত হেরিটেজ ওয়াকের আয়োজন করা হচ্ছে।