বর
২০০ টাকায় সেকেন্ড হ্যান্ড নোকিয়া ফোন পেয়ে গিয়েছিল ছেলেটা, ফোনটা হাতে পেয়ে সে ভেবেছিল, এবার তার ভাগ্যই বদলে যাবে। তার বয়স ১৫, স্কুলের মুখ দেখেনি কখনও। বিধবা মা এবং দুই ছোট বোনের সঙ্গে দু কামরার একটা কুঁড়ে ঘরে বাস তার। খুব শিগগিরই তার দিন মজুরের জীবন শুরু হবে। কেউ একজন তারে বলেছিল, একটা ফোন মানে আরও বেশি কাজ। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ওই ফোনের কারণে তার জুটে গেল এক বধূ।
আসামের গোয়ালপাড়া জেলার বাসিন্দা ১৫ বছরের কিশোর বলছিল, সেপ্টেম্বর মাসে তার ফোনে একটা মিসড কল আসে। ফিরে যখন সে ওই নম্বরে ফোন করে, তখন ফোন যে তুলেছিল, সে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন।
কিশোরের কথা অনুযায়ী, পরের কয়েক মাস ধরে সেই মিসড কলের জের ধরে চলতে থাকে দীর্ঘ, ঘনিষ্ঠ কথোপকথন। ‘‘এর আগে আমি কখনও কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলিনি। আমি প্রেমে পড়তে শুরু করি।’’ মোবাইলে সে ১০০ টাকা ভরেছিল। সারা মাস আনলিমিটেড কলিংয়ের সুবিধা সমেত। ‘‘আমি আমার বন্ধুদের মত ফোনে ছবি তুলতে বা ভিডিও দেখতে পারতাম না। কিন্তু কথা বলতে পারতাম।’’
কিছুদিন কথা বলার পরেই অপরপক্ষ তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল, বলছে কিশোরটি। বলছে, ‘‘আমি ওকে বিয়ে করে আমার বৌ হিসেবে বাড়ি নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম।’’ বধূর গ্রাম খুব দূরের নয়, বরপেটা জেলায়। দিন আর সময় ঠিক করা হয়।
১৭ অক্টোবর সকালে সাইকেলে চেপে রওনা দেয় কিশোর। তার সেদিন দেখা হবে রহস্যময় কণ্ঠস্বরের অধিকারিণীর সঙ্গে। ‘‘যাতে ও আমায় চিনে নিয়ে পারে সেইজন্য বলে দিয়েছিলাম যে আমি নীল জামা পরে থাকব।’’
ছেলেটির মা নিজেও দিন মজুর। তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না ছেলে কোথায় যাচ্ছে। ‘‘আমি ভেবেছি কাজে যাচ্ছে।’’ ৮ বছর আগে স্বামীকে হারানোর পর খুব সামান্য রোজগারে ছেলেমেয়েদের বড় করে তুলেছেন তিনি। তাঁর আশা ছিল, ছেলে এবার রোজগারে মন দেবে।
১২ কিলোমিটার সাইকেলে চেপে যেতে লেগে যায় প্রায় দু ঘন্টা। একে তো ভাঙা রাস্তা, তার ওপর যার সঙ্গে সে দেখা করতে চলেছে সে থাকে এক নদীর ওপারে। অক্টোবর মাসে নদীতে তেমন জল থাকে না, পেরোনো সহজ হয়ে যায়, রাস্তা ধরেই হোক বা অস্থায়ী সেতু পেরিয়ে। তেমন অনেকগুলো সেতু পার হয়েছিল ছেলেটি।
শেষ পর্যন্ত যখন সে যথাস্থানে পৌঁছল, তার সঙ্গে দেখা হল এক বয়স্কা মহিলার। ‘‘দুপুরে উনি আমাকে ভাত, তেলপিঠা খাওয়ালেন। আমি খেলাম কিন্তু বার বার জিজ্ঞাসা করছিলাম আমার কনে কোথায়?’’ দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে বছর ষাটেকের ওই মহিলা বলেন, তিনিই কনে।
কনে
সারা জীবন তাঁর বাস ব্রহ্মপুত্র ও তার শাখানদীর চরে। সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি, সেখানেই তাঁর বিয়ে হয়, পাঁচ সন্তান ও অনেকগুলো নাতি নাতনি হয় তাঁর, স্বামী মারাও যান। নমনি আসামের বালিভরা এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ- সারাজীবন তিনি ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার প্রায় ৩৬০০ বর্গ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছেন। এ অঞ্চলে মূলত বাঙালি মুসলমানদের বাস। প্রতি বর্ষায় বন্যা, দারিদ্র্য, অনুন্নয়ন, ‘বেআইনি’ কিংবা ‘বিদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার ভয়, সব মিলিয়ে এ জীবন বড় সহজ ছিল না।
‘‘শহরের মেয়েরা চরের ছেলেদের সঙ্গে মেশে না। আর চরের মেয়েরা সবসময়েই চর ছেড়ে বেরোতে চায়।’’ মহিলা বলছিলেন।
চরে এতদিন কাটানোর পরেও তাঁর নিজের কোনও ঘর নেই। মুখে বলিরেখা, অবশিষ্ট দাঁতগুলো পোকায় খাওয়া, মহিলা বলছিলেন, ‘‘একবার ছেলেমেয়ের ঘর, একবার পাড়ার লোকের ঘর, একবার আত্মীয়ের ঘরে ঠাঁই নিই।’’
১৫ বছরের কিশোরের সঙ্গে তাঁর কী ভাবে দেখা হল? তাঁর কাহিনিটি পৃথক।
সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গাইগাঁওয়ে এক নির্মাণ কাজ চলছিল। সেখানেই ওই কিশোরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, বলে জানিয়েছেন মহিলা। তাঁর বক্তব্য, ছেলেটি বলেছিল, ‘‘ভাবি, আমি বিয়ে করব, মেয়ে দেখে দাও।’’ তিনি তখন ছেলেটিকে বলেছিলেন চরে আসতে, চরে অনেক মেয়ে আছে। মহিলার দাবি, তখন তিনি ছেলেটির নাম পর্যন্ত জানতে চাননি, এখনও তার নাম জানেন না। ‘মিসড কলের গপ্পো’ তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন।
ফোন নম্বর আদানপ্রদান হয় তাঁদের মধ্যে। মহিলার দাবি, মাসখানেক আগে তাঁরা ফোনে কথা বলতে শুরু করেন, একটি দিনও ঠিক হয় যেদিন ছেলেটি চরে আসবে। কথা মত, ‘‘ও এল, আমরা চর ঘুরলাম, এমনকি মেয়েকে দেখে পছন্দও হয়ে গেল ওর।’’
ততক্ষণে ওর বাড়ি ফেরার পক্ষে বেলা বেশি গড়িয়ে গিয়েছিল। ‘‘আমি ওকে আমার বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে যেতে বলি।’’ তিনি নিজে চলে যান মেয়ের বাড়িতে। ‘‘কিন্তু চরের অনেকে ওকে দেখেছিল। কেউ একজন গুজব ছড়িয়ে দেয় যে আমার সঙ্গে ওই বাচ্চা ছেলেটার সম্পর্ক আছে।’’
রাতে যখন কিশোর ছেলে ও ৬০ বছরের মহিলার মেলামেশার গল্প চরে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন জনা দশেক লোক মহিলার বাড়িতে চড়াও হয়। অভিযোগ, ছেলেটিকে মারতে মারতে টেনে হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। মহিলা বলছিলেন, ‘‘আমাদের গাঁয়ে এ ধরনের লোকডন ভর্তি।’’ তাঁর মেয়ে বললেন, ‘‘হ্যাঁ, ওরা বলে গ্রামের জন্য এসব করে ওরা, আসলে ওরা সব জায়গায় খালি ঝামেলা পাকাতে চায়।’’
গ্রামের কেউই এখন সে ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে চান না।
ছেলেটিকে মারধর করার পর তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় মহিলার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? ‘‘ছেলেটা বলে, ও আমায় ভালবাসে। তাই আমিও বলি যে আমিও ওকে ভালবাসি’’।
সত্যিই কি প্রেম ছিল মহিলার? ‘‘কিছুতেই না। কিন্তু আমি যদি সেদিন ও কথা না বলতাম তাহলে ওরা ছেলেটাকে মেরেই ফেলত। ওকে বাঁচানো আমার কর্তব্য ছিল।’’
বিবাহ
দুজনকে জোর করে ‘সামাজিক’ মতে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। একজন কাজিকে ডাকা হয়েছিল, একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান হয়েছিল, সে রাত ওই মহিলার সঙ্গেই কাটিয়েছিল কিশোরটি। দুজনেরই বক্তব্য, তারা এক ঘরে রাত কাটায় নি।
পরদিন সকালে, ১৫ বছরের কিশোর তান নব‘বধূ’কে সঙ্গে নিয়ে রওনা দেয় সেই পথে, যে পথ দিয়ে সে চরে এসে পৌঁছেছিল। সাইকেলে চেপে, ভাঙা রাস্তা ও অস্থায়ী সেতু ধরে। মহিলার পরণে ছিল লাল শাড়ি, ছেলেটির পরণে আগের দিনের নীল রঙের জামাটাই।
বাড়ি পৌঁছনোর পর আঁতকে ওঠেন কিশোরের মা। ‘‘আমার ছেলের বৌ আমার থেকে বয়সে বড়!’’ গাঁয়ের মাথাদের ডাক পড়ে। এ অঞ্চলে তাঁরা দিওয়ানি নামে পরিচিত।
ব্যবসায়ী শাহ জাহান আলি বললেন, ‘‘ছেলেটা আমাদের বলে যে ওরা ফোনে কথাবার্তা বলা শুরু করেছিল। আমরা অবাক হইনি। কয়েক মাস আগে নলবাড়ি থেকে এক মহিলা হাজির হয়ে বলেছিল এ গ্রামের একজনের সঙ্গে তার ভালবাসা হয়েছে। তার আগে তিনসুকিয়ার এক নেপালি মহিলা আমাদের গ্রামের এক মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে নেয়।’’
এ দুটো বিয়েই ওই ফোনের ‘রং নাম্বারের’ কারণে, বলছিলেন আলি। তাঁর মতে গ্রামীণ আসামে ফোনের জেরে প্রচুর সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, সে ফোন ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত।
দিওয়ানিরা রায় দেন, ১৫ বছরের ছেলের সঙ্গে ওই মহিলার সামাজিক বিচ্ছেদ করাতে হবে। ফলে গাঁয়ে ফেরার দু ঘন্টা পর এক কাজির সামনে দুজনকে কিছু কাগজে সই করতে হয়। পনের মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় ২৪ ঘন্টার কম সময়ের এক বিবাহ।
মোবাইল ফোন, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ততক্ষণে এ বিয়ের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। যে সাংবাদিক প্রথম এ খবর প্রকাশ করেন, তিনি জানান ফেসবুকে ক্লিপিংয়ের ভিউ সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে।
শাহজাহান আলি বলছিলেন, ‘‘স্থানীয় থানা থেকে আমাদের কাছে খোঁজ খবর নেওয়া হয়, কিন্তু বিয়ে যেহেতু অন্য জেলায় ঘটেছিল, ফলে তারা আর কিছু করেনি।’’ আলোপতি চর থানার ওসি শাহ আলম বললেন, ‘‘আমাদের কাছে যেহেতু অভিযোগ করা হয়নি, ফলে আমরাও কিছু করিনি।’’
জানা গিয়েছে, এ মামলা নিজের হাতে নিয়েছে আসাম শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন। কিন্তু কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনীতা চাংকাকোতি জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে এ ব্যাপারে কোনও রিপোর্ট জমা পড়েনি।
বিচ্ছেদ
‘‘বিধবাকে বিয়ে করে ছেলেটার খুব নামডাক হয়ে গেছে।’’ বলছিলেন শাহজাহান আলি।
১৫ বছরের কিশোরের ফোন সে দিনই ভেঙে দিয়েছিল গ্রামবাসীরা, নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল সিম কার্ডও। তার মা বললেন, ‘‘অন্য জায়গায় কী হয় না হয় আমি জানি না, কিন্তু ফোন খুব খারাপ জিনিস।’’ ফোন হীন কিশোর এখন এদিক সেদিক কাজ খুঁজে বেড়ায়। মা জানালেন, ছেলে মুখ গোমড়া করে থাকে সবসময়ে, কথা বার্তাও আগের চেয়ে কম বলে এখন।
বিচ্ছেদের দিন বিকেলেই নিজের গাঁয়ে ফিরে আসেন ৬০ বছরের মহিলা। এখন গ্রামে কেউ সে ঘটনার কতা উল্লেখ করে না। তবে একটা জিনিস বদলেছে। বাজার যাওয়ার রাস্তায় তিনি দেখালেন, পেটিকোটের মধ্যে দুডো জিনিস গোঁজা রয়েছে। জর্দার টিন আর মোবাইল ফোন। ফোনটা ডেড। সিম কার্ড ওরা সেদিনই নষ্ট করে দিয়েছে। ’’কিন্তু তবু আমি ফোনটা কাছেই রাখি। এ নেশা ছাড়তে পারব না।’’
Read the Full Story in English