/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/01/OBIT_1.jpg)
অলংকরণ- অরিত্র দে
সংবাদমাধ্যমের দফতরে, মানে নিউজরুমে, ওবিট বলে একটা কথা চালু আছে। ওবিট বা অবিট। উচ্চারণভেদে ওবিচুয়ারি বা অবিচুয়ারি। কোনও মানী ব্যক্তিত্বের প্রয়াণের পর তাঁকে নিয়ে শোকগাথা লেখার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। তাকে আমরা ওবিচুয়ারি বলে ডাকি।
বিগত এক বছরের মধ্যে বাংলা জগতে বেশ কয়েকজন মানী ও নামী ব্যক্তিত্বের প্রয়াণ ঘটেছে। রাজনীতি জগতে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে, সাহিত্য জগতে রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দিব্যেন্দু পালিত, পিনাকী ঠাকুর, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়।
সর্বপরিসরে কাঁঠালি কলার মত ক্রিয়াশীল সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা এতজন ব্যক্তিত্বের সকলের ক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে অবহিত হবেন বা থাকবেন, এমনটা আজকাল আর আশা করা যায় না। তাহলে কী হবে - তাঁদের জন্য শোকগাথা কি লেখা হবে না নিজ নিজ সংবাদমাধ্যমে? তেমনটা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় বলেই সাধারণভাবে মনে করা হয়। মনে করা হয় পাঠকদের কাছে মানী ব্যক্তিত্বদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানানোর দায় ও দায়িত্ব রয়েছে সংবাদমাধ্যমের। ফলে শরণ নেওয়া হয় সেই জগতের (এখানে সাহিত্যজগতের) বর্তমান ক্রিয়াশীল ব্যক্তিত্বদের। প্রত্যাশা করা হয়, কাঁঠালি কলার চেয়ে তাঁরা ভালো পারফর্ম করবেন এই ধরনের লেখায়।
কিন্তু হা হতোস্মি! প্রত্যাশা মেটে না। অনুরুদ্ধ অবিচুয়ারিগুলিতে লেখকের কর্মসন্ধানের হদিশ কই? যা আসতে থাকে তা কেবল 'আমি ময়'। ওবিট লেখকদের ব্যক্তিগততাময়। সে ব্যক্তিগততা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বা আমিকেন্দ্রিকতার বাইরে আর কিছু নয়। অক্ষরের পর অক্ষর সেজে ওঠে বটে, কিন্তু প্রয়াত মানুষটির কাজ নিয়ে আলোচনার দিশা মেলে না সেসব লেখায়। একজন নতুন মানুষ জেনে উঠতে পারেন না প্রয়াত লেখকের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসমূহের কথা।
এমন একটা প্রতর্কের অবতারণা করা যেতে পারে, যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের খতিয়ান লেখা আমন্ত্রিত লেখকের কাজ নয়। তিনি তো তাঁর ব্যক্তিগত নিয়েই লিখবেন। এ যুক্তি তেমন পরাক্রমশালীও নয় অবশ্য। কারণ একজন অনুরুদ্ধ লেখক, প্রয়াত ব্যক্তিত্বের কোনও না কোনও কাজ দ্বারা প্রাণিত হয়েছেন নিশ্চয়ই, কোনও না কোনও ভাবে প্রয়াত মানুষটির এক বা একাধিক কাজ তাঁকে প্রভাবিত করেছে কোনও না কোনওভাবে - অর্থাৎ অনুরুদ্ধ ব্যক্তি প্রয়াত ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে লেখার অধিকারী। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব প্রত্যাশামাত্র। পাঠক এই ওবিচুয়ারিগুলি থেকে প্রয়াত ব্যক্তিত্বের কর্মময় ভুবন সম্পর্কে অনবহিতই থেকে যান, কোনও নতুন আলো পড়ে না সেখানে। অথচ পাঠক তো জানতে চান, কোন সেই পংক্তি - যা বিদ্যুৎঝলক সৃষ্টি করে দিতে পারে আরেক ক্রিয়াশীলের মধ্যে - কালের বাঁধন খুলে ফেলতে পারে কোন রচনা বা গ্রন্থসমূহ - সমকালীন কোন কোন লেখকদের সমসাময়িকতাকে ছাপিয়ে যেতে পারত বা গিয়েছিল সদ্যমৃতের কোন লেখা!
এমনটা অস্বাভাবিক নয়, যে প্রয়াণের আঘাত, প্রিয়জন বিয়োগের বেদনার বিধুরতা কাটিয়ে এত কিছু আলোচনার সুযোগ হয়ে ওঠে না। কিন্তু প্রিয়জন হয়ে ওঠার কারণসমূহ তো ব্যক্তিগতই নয়। ক্রিয়াশীলতা। একজন লেখক আরেকজন লেখকের আত্মীয় হয়ে উঠতে পারছিলেন তো ক্রিয়ার মাধ্যমে। সেসব কাজের কারণেই অপরিচয়ের বেড়াজাল ভেঙে যাচ্ছিল প্রয়াতের সঙ্গে জীবিতের। কোন সে কাজ - কোন কোন সে রচনা বা গ্রন্থ - এসব জানার আগ্রহই তো থাকে পাঠকমধ্যে।
দমদম বিমানবন্দরের অবতরণের কিছু আগে প্লেন থেকে যখন নিচের দৃশ্যগুলি দেখা যেতে শুরু করে, সে সময়ে জীবনানন্দ দাশের 'রূপসী বাংলা' পাঠের প্রতিক্রিয়া এই বাংলা ভাষাতেই লেখা হয়েছিল। সে অবশ্য অবিচুয়ারি ছিল না, অন্তত এখনকার অর্থে।
দীর্ঘদিন আগে যোগসূত্র পত্রিকায় প্রয়াত সাংবাদিক সাহিত্যকর্মী রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। স্বভাবসিদ্ধ মজারু ঢংয়ে সেখানে সম্পূর্ণ ভিন পরিপ্রেক্ষিতে মনে করানো হয়েছিল, ছাপাখানার কর্মীরা সব লেখাকেই কপি বলেন!
ওবিচুয়ারি উঠে গেছে। এখন ওবিটের ওবিট লেখার সময় এল বুঝি!