/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/02/delhi-rally-759.jpeg)
দিল্লিতে কেজরিওয়ালের ধর্না মঞ্চে বিজেপি বিরোধী জোটের ছবি। ছবি: প্রেমনাথ পাণ্ডে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
গত বুধবার দিল্লিতে বিরোধী জোটের নেতানেত্রীদের নিয়ে আবার একটা জনসভা হয়ে গেল। এবার মূল সংগঠক অরবিন্দ কেজরিওয়াল, বিশেষ বক্তাও বটে। বড় বড় সাইক্লোন বা টরনেডোর যেমন গালভরা নাম দেওয়া হয়, জনসভাগুলোর জন্যেও আজকাল ঠিক করা হচ্ছে কিছু কিছু শব্দবন্ধ। এই সভার শিরোনাম ছিল “স্বেচ্ছাচারিতা হঠাও, লোকতন্ত্র বাঁচাও”। সেখানে কেজরিওয়াল মোদীকে বারো ক্লাস পাশ করা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। যদিও মূল শ্লোগান এখন ভোটের আগে জোট। মোদী সরকারকে গদি থেকে সরাতে দলমত নির্বিশেষে সবাই তাই একদলে। যেমন গত ১৯শে জানুয়ারি তৃণমূলের ব্রিগেড ছিল লোকসভা নির্বাচনের আগে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের আহ্বান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নেতা-নেত্রীরা ছিলেন সেই জনসভার মূল আকর্ষণ। ব্রিগেড থেকে নিজের রাজ্যে ফিরে গিয়ে তাঁরা অনেকে অন্য কথা বললেও সেই সমাবেশের মূল তার বাঁধা ছিল তৃণমূল নেত্রীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কম্পাঙ্কে।
আরও পড়ুন, জোট এবং বাস্তবতা ও বাধ্যবাধকতা
রাজনীতি অনুশীলনে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল একই কথা বারবার বলে যাওয়া। নেতা নেত্রীর ভাষণ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে তা যখন শ্লোগানের রূপ নেয় তখন সেই অল্প কয়েকটি শব্দ আশ্রয় করেই বদল হয় শাসকের, বদলায় রাজনীতি। তবে নেতানেত্রীদের ভাষণ তো আর শুধু শ্লোগান হতে পারে না। সেখানে একই কথা ফেনিয়ে বলতে হয়। এর মধ্যে অবশ্যই বিভিন্ন নেতার বক্তব্যের নিজস্ব ধারা থাকে। জনসভায় তো আর বিপুল তথ্যরাশি পেশ করে জনসাধারণকে বোঝানো সম্ভব নয়। কৃষিক্ষেত্রে কত দশমিক কত শতাংশ উন্নয়ন হয়েছে, দেশে বা রাজ্যে কাঁচা রাস্তা পাকা হয়েছে কতো কিলোমিটার — এ সমস্ত তথ্য একটু গোঁজামিল সহকারে বলে দিলেও খুব কিছু যায় আসে না। বড়জোর সেই চলছবি বারবার টেলিভিশনে দেখিয়ে সন্ধেবেলার রাজনৈতিক তরজায় কিছুটা সময় কাটানো যায়। জনসভার ভাষণে তাই সত্যি কথার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মাঠের শুকনো ঘাসে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া। চাগিয়ে দেওয়া সমর্থকদের। জনসভা থেকে ফিরে যাওয়ার পরেও যেন তাদের কানে বাজতে থাকে নেতা বা নেত্রীর বক্তব্য। এরকম ক্ষেত্রে নিজে কতো ভালো কাজ করেছেন, তার থেকে বেশি কাজে আসে বিরোধীদের উদ্দেশে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল এই শেষের পথটা নেন তাঁর বক্তব্যে। সরাসরি আক্রমণ করেন বিরোধীদের, এবং একেবারে ব্যক্তি ধরে। ব্রিগেডের গত মাসের জনসভায় তাই বিজেপি নয়, তাঁর আক্রমণ ছিল সরাসরি নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহের দিকে। এই দুজনকে গদি থেকে সরিয়ে দেওয়াই যে একমাত্র লক্ষ্য সেকথা তিনি তাঁর ছোট্ট বক্তব্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন বারবার। আর সেই ধারা বজায় রেখেই গত তেরোই ফেব্রুয়ারি তিনি আবার মোদীকে আক্রমণ করেছেন। এবারে তার বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে। একথা অনেকেই জানেন যে নরেন্দ্র মোদীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে আআপ (আম আদমি পার্টি) প্রশ্ন তুলেছে বারবার। তার এখনও কোন নিষ্পত্তি হয় নি। ভারতের বিভিন্ন প্রখ্যাত নেতানেত্রীদের এই সমস্যা কিন্তু আছেই। সত্যি বলতে কি খুব কিছু যায় আসে না মন্ত্রীর পুঁথিগত বিদ্যা আছে কি না আছে সেই দ্বন্দ্বে। দেশের সংবিধানে কোথাও লেখা নেই যে জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রী হতে গেলে কোন পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে হবে। সোজা কথায় মনমোহন সিংহ যে ইন্দিরা গান্ধীর থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতায় এগিয়ে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে কেউ প্রশ্ন তুলবেন না ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা নিয়ে। সেখানে কিন্তু অর্থনীতির গবেষক মনমোহন সিংহকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে বিষয়টা ভালো খারাপের নয়। এক একজন এক এক রকম। সেভাবেই তাঁরা দেশ চালান। সঙ্গে থাকে প্রশাসন, আইন ব্যবস্থা। এই সব মিলিয়েই তো দেশটা গড়ায়।
মুশকিল হল আমাদের দেশের অনেক নেতানেত্রী পড়াশোনায় ভালো না হয়েই ডিগ্রির সন্ধানে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ান। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই মিথ্যে বা অস্পষ্ট সত্য পেশ করেন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র পেশ করার সময়। আর আজকের তথ্য বিস্ফোরণের দিনে সেগুলো ধরা পড়ে যায় খুব সহজে। কোন পরীক্ষায় পাশ করে ডিগ্রি পেলে তা প্রমাণ করতে সময় লাগে না। কিন্তু জালিয়াতির আশ্রয় নিলে মিথ্যেকে সত্যি বলে চালাতে ঝামেলা হয় বেশি। বদলাতে হয় অনেক নথি। শেষমেশ হয়ত ক্ষমতার অস্ত্রে মিথ্যে সত্য হয়, কিন্তু তাই নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপের ইয়ত্তা থাকে না। তবুও সেই একই কথা সত্যি যে নিজের ডিগ্রি নিয়ে মিথ্যে বললেই যে কোন নেতা বা নেত্রীর মন্ত্রী হওয়া আটকে যায় না। আইনেও নয়, দেশের মানুষের উপলব্ধিতেও নয়।
অবশ্য একথাও অনস্বীকার্য যে শিক্ষার একটা শ্লাঘা আছে। অরিবন্দবাবু আইআইটি খড়গপুর থেকে পাশ করা প্রযুক্তিবিদ। অর্থাৎ পুঁথিগত বিদ্যায় তিনি দেশের একেবারে ওপরের সারিতে। ফলে তাঁর কাছে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা লোকজনের শিক্ষার দাম যে আপেক্ষিকভাবে অনেক কম সে নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। এই প্রসঙ্গে বঙ্গানুবাদ করা যাক তাঁর জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণের। “শেষবার আপনারা বারো ক্লাস পাশ করা একজনকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। এবার আর সে ভুল করবেন না। অন্তত একজনকে খুঁজে বার করুন যিনি শিক্ষিত। কারণ বারো ক্লাস পাশ করা মানুষের বোধ থাকে না যে সে কোথায় সই করছে।” জনসভায় উপস্থিত থেকে তালে তাল মিলিয়েছেন চন্দ্রবাবু নাইডু। তিনিও চেয়েছেন শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রী। এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে আক্রমণ দু দিক থেকে ধেয়ে গেছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দিকে। একটা হল তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র নিয়ে অনুযোগ, আর দুই হল সত্যিই যদি তিনি বারো ক্লাস পাশ হয়ে থাকেন তাহলে সেই শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মত নয়। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর পেশ করা প্রধানমন্ত্রীর ডিগ্রির সত্যতা নিয়ে প্রথম বক্তব্যটি রাজনৈতিকভাবে অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিষয়টা পরিষ্কার করে জানাতে পারলে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির ক্ষতির থেকে লাভই হত বেশি। অন্যদিকে শুধুমাত্র উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলে ভালো জনপ্রতিনিধি হওয়া যায় না সে কথারও সারবত্তা নেই মোটেই।
যাদের সঙ্গে কেজরিওয়াল বিভিন্ন মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে নতুন জোট সরকারের স্বপ্ন দেখছেন তাদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা মোটেও আইআইটিতে সুযোগ পাওয়ার মত নয়। এটাও মনে রাখতে হবে আইআইটি থেকে পাশ করা সত্বেও প্রযুক্তিবিদ্যাকে পেশা হিসেবে নেন নি অরবিন্দ কেজরিওয়াল। যোগ দিয়েছেন প্রশাসনে। সেখান থেকে রাজনীতিতে। পুঁথিগত বিদ্যার সঠিক দাম বোঝা যেত যদি তিনি তাঁর স্নাতকস্তরের প্রযুক্তিবিদ্যাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারতেন দেশ শাসনে। সেটাই যদি না হয় তাহলে দেশ শাসনে মোদীর সঙ্গে কেজরিওয়ালের পার্থক্যটা শংসাপত্রের মূল্যমান দিয়ে বিচার করা শক্ত।
সবশেষে এটাও বলতে হবে যে আজকের দিনে ভারতে পুঁথিগত শিক্ষার অবস্থা অত্যন্ত গোলমেলে। বুদ্ধি নয়, যে কোন পরীক্ষাতেই প্রচুর পড়তে হচ্ছে ভালো ফল করার জন্যে। সেখানে বুদ্ধির থেকে পরিশ্রমের জোর বেশি। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সময় হয়ত বিষয়টা এতোটা সাংঘাতিক ছিল না। কিন্তু আজকের দিনে আইআইটির প্রবেশিকায় সফল হতে গেলে জীবনের বাকি সব অভিমুখের গলা টিপে শুধুই চালিয়ে যেতে হয় একমুখী পড়াশোনা। তার জন্যে কোচিং ইস্কুলে যেতে অর্থব্যয়ও হয় বিপুল। দেশের একটা বড় অংশের নিম্নবিত্ত মানুষ সে জায়গাতে পৌঁছতেই পারে না। আজকের উচ্চশিক্ষিত নেতারা তাই সময় পেলে অন্তর্জাল ঘেঁটে রবীন্দ্রনাথের “শিক্ষার বাহন” প্রবন্ধটি পড়ে ফেলতে পারেন। “যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায় সেই বা কম কী করিল? সভ্যতার নিয়ম অনুসারে মানুষের স্মরণশক্তির মহলটা ছাপাখানায় অধিকার করিয়াছে। অতএব যারা বই মুখস্থ করিয়া পাস করে তারা অসভ্যরকমে চুরি করে অথচ সভ্যতার যুগে পুরস্কার পাইবে তারাই?” আমাদের সৌভাগ্য যে দেশের আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের কাছে উচ্চশিক্ষার নাগাল পাওয়ার থেকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ এখনও অনেক বেশি। আপাতত তাই অজিত সিং, জয়রাম রমেশ, মনোহর পারিক্কার এবং অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছাড়া আইআইটি পাশ করা এমন উজ্জ্বল উদাহরণ বেশি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা যাক আইআইটি ফেরত কেউ ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পর দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন কিনা। সেখানকার ডিগ্রিটা তো আর যখন তখন বানিয়ে ফেলা যায় না!
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)