Advertisment

বিরোধীর দায়িত্ব ও গুরুত্ব

সত্য হোক, মিথ্যা হোক, কিছু স্বপ্ন নিশ্চয় বিজয়ী পক্ষ ফেরি করতে পেরেছে। মানুষকে মূর্খ না ভেবে তাঁদের  কাছ থেকেই শোনা দরকার তাঁরা কী প্রত্যাশা নিয়ে সরকার নির্বাচন করেছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Amader Rajniti

অলংকরণ- অরিত্র দে

গণতন্ত্রে বিরোধীর ভূমিকা শাসকের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদিও আমরা তাকে লঘু করে দেখতে অভ্যস্ত। এই অভ্যাস বেশি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে যখন বিরোধী স্বয়ং নিজের ভূমিকাকে লঘু করে দেখেন বা নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন থাকেন না। কেবল একবার হেরে যাবার হতাশা-ক্ষোভ আর পরের বার গদি দখল করার প্রস্তুতির মধ্যে হারিয়ে যায় পাঁচ বছর বিরোধীর গুরুদায়িত্ব পালন করার অঙ্গীকার ও প্রচেষ্টা। ভারতের মতো বহুদলীয় গণতন্ত্রে ব্যাপারটা আরো জটিল। বিরোধী দলের সংখ্যা অনেক এবং তাদের নিজেদের মধ্যে প্রভেদ বিপুল। ফলে সংগঠিতভাবে দায়িত্বশীল বিরোধীর ভূমিকা পালন করা আরো দুরূহ। অবশ্য একই কারণে রাজনৈতিক বিরোধিতায় বহুস্বর ও বহুমাত্রিকতা এক অনন্য সম্ভাবনারও জন্ম দেয়।

Advertisment

আরও পড়ুন, নতুন অধ্যায়: নবকলেবরে নরেন্দ্র মোদী

শাসকের উদ্দেশ্য, মনোভাব, কর্মপদ্ধতি ইত্যাদি যদি সন্দেহজনক হয়, তাহলে বিরোধী পক্ষের ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বস্তুত গণতন্ত্রের অর্জন এই বিরোধিতার অধিকারটুকুই, নইলে শাসক তো রাজতন্ত্রেও ছিল। শাসক যখন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করেন, তখন অবশ্যই সেই কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ প্রয়োজন,  কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রাকশর্ত আছে।

আরও পড়ুন, নির্বাচনের ফল: দয়া ও অধিকার

প্রথমত শক্তিশালী বিরোধী পক্ষের অস্তিত্ব জরুরি। বলা বাহুল্য, এই শক্তির সঠিক পরিমাপ সংসদে বা বিধানসভায় প্রাপ্ত আসনসংখ্যা থেকে হয় না। ভোটের শতাংশ থেকে কিছুটা বোঝা যায়, বিরোধীর শক্তির আসল পরিমাপ তাঁদের সংগঠন, কর্মীদের তৎপরতা ও জনসংযোগ থেকেই সম্ভব।

দ্বিতীয়ত প্রতিবাদ করার বা নিজের মত ব্যক্ত করার অধিকার সবার আছে, এই বিশ্বাসে সব রঙের রাজনৈতিক দলগুলোকে স্থিত হতে হবে। প্রতিবাদীকে দমন করা বা প্রতিরোধ চূর্ণ করা শাসকের চরিত্র হতে পারে। এমন কাজ করলে শাসক হিসেবে কিছু স্বল্পমেয়াদী সুবিধা পাওয়া যায়, সুতরাং এই প্রবণতা যেকোনো শাসকের মধ্যে জন্মানো কিছুটা প্রত্যাশিত। সেই কারণেই সব প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে সমর্থন জানানো মূলত বিরোধী দলগুলির কর্তব্য। তার মানে এই নয় যে সব প্রতিবাদই যুক্তিযুক্ত হবে বা সব দল সব প্রতিবাদের বিষয়ে একমত হবে। এসব নিয়ে, অর্থাৎ বিরোধিতার ক্ষেত্র ও পদ্ধতি নিয়ে বিরোধীদের মধ্যে তর্ক হতে পারে। বস্তুত তর্ক হওয়া উচিত। তর্কের মাধ্যমে উন্নততর প্রতিরোধে পৌঁছনো যায়, যেটা বহুদলীয় গণতন্ত্রের একটা সুবিধা। শুধু প্রতিবাদের অধিকার সম্বন্ধে একমত হওয়া দরকার। বিরোধী আসনে বসা বা একটিও আসন না পাওয়া  বিভিন্ন দল যদি এরকম পরিস্থিতিতে ছোটখাটো লাভের আশায় জাতীয় বা আঞ্চলিক স্তরে প্রতিযোগী অন্য দলকে বিপাকে ফেলার খেলায় মাতেন, তাহলে বিরুদ্ধস্বর দুর্বলতর হবে।

আরও পড়ুন, দেবশঙ্কর হালদারের রবীন্দ্রনাথের নাটক ও সমসময়

তৃতীয়ত জনমানসে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা এবং বজায় রাখা বিরোধী পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শাসকের কাছে মানুষ যেমন কিছু নৈতিকতা আশা করেন, বিরোধীদের কাছেও থাকে তেমনই প্রত্যাশা। বিরোধী দলগুলির নেতা-কর্মীরা কেমন ভাষায় কথা বলছেন, মানুষের সঙ্গে কেমনভাবে মিশছেন, সাধারণ মানুষের কথা কতটা শুনছেন, দেশের উন্নতির কাজে কতটা অংশগ্রহণ করছেন, কোন ইস্যুতে সরকারের বিরোধিতা করছেন, সেই বিরোধিতা কতটা যুক্তিযুক্ত এবং কতটা জোরদার হচ্ছে, শুধুই বিরুদ্ধভাষণ হচ্ছে নাকি কোনো উন্নততর বিকল্প প্রস্তাব তাঁরা দিচ্ছেন… এই সবকিছুই জনতার নজরে থাকে। এই বিষয়টি সামান্য আলোচনার দাবি রাখে।

জনতার নজরদারির কথাটা বলতে গেলেই জবাব পাই, "ধুর, আমাদের দেশের লোকে অত দেখে বা বোঝে নাকি? এখানে তো রাম নামের জিগির তুলেই সব হয়।" এই উন্নাসিকতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। দেশের মানুষকে অবজ্ঞা করে গঠনমূলক রাজনীতি করা যায় না। সেক্ষেত্রে শাসকদলের হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা করার জন্য ভাষা বা জাতপাত কেন্দ্রিক অন্য কোনো জিগির তোলার ফন্দি মাথায় আসে। "জয় শ্রী রাম"-এর চেয়ে "জয় বাঙলা, বিহারি খেদাও" স্লোগানকে চরিত্রগতভাবে নিরীহ ভাবার বিশেষ কারণ আছে কি? গুজরাত থেকে বিজেপিকে সরানোর জন্য হার্দিক প্যাটেলের জঙ্গিপনার ওপর ভরসা রাখতে দেখেছি অনেক সেকুলার বুদ্ধিজীবীকেও। হার্দিক কি কোনো সুস্থ রাজনৈতিক বিকল্প উপহার দিয়েছেন? পাতিদার অস্মিতার রাজনীতি কি হিন্দু অস্মিতার রাজনীতির চেয়ে বেশি ভালো কিছু? এসব ফন্দি ছাড়া কিছু মাথাতেই আসবে না যদি আমরা ধরেই নিই আমাদের দেশের মানুষ এতটাই পশ্চাদপদ যে হুজুগ ছাড়া কিছুই বুঝবেন না। হুজুগের বিকল্পে অন্যতর স্বপ্ন দেখানো হয়েছে কি? হয়ে থাকলে কতটুকু? কতজনকে জানানো হয়েছে সেসব কথা? মানুষের কাছ থেকে কি শোনা হয়েছে, সেই বিষয়ে তাঁরা কী ভাবছেন? জনতার বোধবুদ্ধির প্রতি শ্রদ্ধা রাখা এবং জনতার নজরদারিকে সম্মান জানানো জরুরি। তাঁদের চাহিদা বোঝার চেষ্টাটুকু করা উচিত। যাঁরা দেশের মানুষকে অবজ্ঞা করবেন, মানুষ তাঁদের ওপর আস্থা নাও রাখতে পারেন।

আরও পড়ুন, বিরোধী পক্ষের ভুলের কারণেই মোদী অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেছেন

২০১৪ সালে যখন প্রথম "মোদী সরকার" গঠিত হয়, তখন বিজেপি বিরোধী অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে বলছিলেন, "এই সরকার মানি না।" ভোটে জিতে আসা একটি সরকারকে সরাসরি অস্বীকার করা কতটা গণতান্ত্রিক, সেই বিচার আপাতত তোলা থাকছে। ৩১% ভোটের জোরে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকারের বিরুদ্ধে একথা বলা যৌক্তিক ছিল যে দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁদের ভোট দেননি। প্রশ্ন হল, "মানি না" বলার পরের ধাপে আপনার কর্তব্য কী? কেমন পদ্ধতিতে আপনি বিরোধীর ভূমিকা পালন করবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে "গঠনমূলক বিরোধিতা"র কথা বলে পরিচিত মহলে প্রবলভাবে সমালোচিত হয়েছিলাম। বলা হয়েছিল, "গঠনমূলক বিরোধিতা হল সোনার পাথরবাটি। অতএব বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করতে হবে।" এই মতটি শিক্ষিত বিজেপি বিরোধীদের বেশিরভাগের মত, তা ক্রমশ দেখেছি। কিন্তু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতাও যথেষ্ট দানা বাঁধল না, অনেকটাই সীমাবদ্ধ থাকল অপছন্দের দল, সরকার আর মানুষজনকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করার মধ্যে। কিছু ক্ষেত্রে ঠাট্টা চলল এমন বিষয় নিয়ে, যা মানুষের ভালো লাগেনি। যেমন ধরুন, পূর্বতন মোদী সরকার দেশের যাবতীয় অভাব-অনটনের আলোচনা ও অভিযোগকে ধামাচাপা দেবার জন্য জাতীয়তাবাদ, সীমান্ত, সেনাবাহিনী ইত্যাদিকে ব্যবহার করেছে, একথা অনস্বীকার্য। এটা যখন বুঝে ফেললেন, তখন আপনি খুব স্পষ্ট করে সেই কথাটুকু সাধারণ মানুষকে বারবার বলতে পারতেন বা পারেন। মানুষ আজ না হলেও কাল বুঝবে। বদলে যদি আপনি প্রবল বুদ্ধিমানের মতো ভাব করে ক্রমাগত "কিউঁকে সিয়াচেন মে হামারে জওয়ান…" বলে চুটকি বানাতে থাকেন, তাহলে সাধারণ মানুষের অনেকেই ভাববেন যে আপনি সেনা জওয়ানদের অপমান করছেন (যদিও আপনি আসলে তা করতে চাননি)। এই ভাবাটা আপনার বিরুদ্ধে যাবে, কারণ যাঁরা ভোট দেন, তাঁদের অনেকেই সেনাবাহিনীকে সম্মান করেন।

এখনো মনে করি, দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা, গোরক্ষা বাহিনীর তাণ্ডব, জাতীয় বা রাজ্য স্তরে যেকোনো সরকার বা শাসকদলের দমননীতি বা ভোট লুণ্ঠনের মতো ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা হওয়া প্রয়োজন এবং তা ঠাট্টার ছলে নয়, সর্বশক্তি দিয়ে। বাকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিরোধীর ভূমিকা হওয়া উচিত গঠনমূলক। একথা বুঝতে হবে যে সত্য হোক, মিথ্যা হোক, কিছু স্বপ্ন নিশ্চয় বিজয়ী পক্ষ ফেরি করতে পেরেছে। মানুষকে মূর্খ না ভেবে তাঁদের  কাছ থেকেই শোনা দরকার তাঁরা কী প্রত্যাশা নিয়ে সরকার নির্বাচন করেছেন। সেইসব প্রত্যাশা বুঝে তদনুযায়ী দেশের গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে। তবেই জনগণের তরফে সরকারের বিরোধিতা করার ছাড়পত্র পাওয়া যাবে এবং সেইসব বিরোধিতার মুহূর্তে জনগণকে পাশে পাওয়া যাবে। নইলে কেবলমাত্র রেটরিক-সর্বস্ব রাজনৈতিক বিরোধিতা দেশবাসীর বিরক্তিই উৎপাদন করবে। "স্বচ্ছ ভারত মিশন", "বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও" গোত্রের উদ্যোগগুলো অন্তত নামে এবং ঘোষিত উদ্দেশ্যে সাধু। এগুলো নিয়ে ঠাট্টা করলে জনমনে বিকৃত প্রভাব পড়তে বাধ্য। বরং সহযোগী হিসেবে সোৎসাহে এসবের মধ্যে অংশগ্রহণ করলে কিছুদিন পরে প্রকল্পগুলোর কার্যপদ্ধতির সমালোচনা করা সহজ হবে। তখন লোকে মন দিয়ে সেই সমালোচনা শুনবে। তখন আপনি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পারবেন বেটি বাঁচানোর জন্য বরাদ্দ টাকার কীভাবে অপব্যয় হচ্ছে এবং মানুষ আপনার কথাকে গুরুত্ব দেবে।

আরও পড়ুন, মাঝে মাঝে মূর্তি ভেঙে পড়াই ভাল

আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক আছে। দেশের যুবসমাজ যেকোনো মূল্যে উন্নয়ন চাইছেন, একথা বোঝা যাচ্ছে। তার জন্য তাঁরা একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারে আস্থা রাখছেন বারবার। এই সুযোগে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকার নিজের পছন্দমতো উন্নয়নের সংজ্ঞা ও পদ্ধতি নির্ধারণ করছেন, যার কিছু অংশ দেশের অর্থনীতির পক্ষে (বিশেষত নিম্নবিত্ত মানুষ ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের পক্ষে) দীর্ঘমেয়াদে বিপজ্জনক হতে পারে। কিছু অংশ পৃথিবীর পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক হবে। বিরোধীরা যদি দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের প্রক্রিয়াটিতে সামিল হন, তবেই তাঁরা উন্নয়নের বিকল্প জনমুখী সংজ্ঞা ও প্রক্রিয়া জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে পারবেন এবং সরকারকে অন্তত অংশত সেইসব শর্ত মানতে বাধ্য করতে পারবেন। যদি বিরোধীরা এই প্রক্রিয়াটি থেকে বিযুক্ত থেকে কথার মারপ্যাঁচ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তবে আগামী পাঁচ বছরে অনেক কিছুই অনেকের নাগালের বাইরে চলে যাবে।

আমাদের দেশ ও পৃথিবী উন্নততর ভবিষ্যতের দিকে যাবে নাকি ধ্বংসের দিকে, তা আগামী এক দশকের মধ্যে স্থির হয়ে যাবে। পৃথিবীর সর্বত্র শাসক এবং বিরোধী সব রাজনীতিবিদের পক্ষেই সৎ ও আন্তরিক হবার শেষ সুযোগ এই দশ বছর। পরিস্থিতি যা, তাতে দুনিয়া জুড়েই এক বিশেষ ধরণের শক্তি ক্ষমতায় আসছে, যাদের কাছে উন্নয়নের একটিই মানে ও মডেল। এঁদের হাতে পৃথিবী সম্ভবত নিরাপদ নয়। বিরোধী রাজনীতির দায়িত্ব তাই এখন সর্বোচ্চ।

Advertisment