শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রস্থান সময়েও কোনও আলোড়ন ওঠেনি। যেমন আলোড়নহীন ছিল তাঁর থেকে যাওয়ার সময়কাল। পরমেশ্বরন থাঙ্কাপ্পান নায়ার কলকাতায় থাকলেন ৬৩ বছর। কলকাতাই তাঁর ঘর-বাড়ি, বলতেন তিনি। কেরালার আলুভায় তাঁর আদি নিবাস। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি রওনা দিলেন সেও আলুভার দিকে। কাকতালীয় বটে, এ কলকাতায় তিনি যেদিন প্রথম পা রেখেছিলেন, সে দিনটাও ছিল বৃহস্পতিবারই।
নেহাৎই একটা সাদামাটা বাসা ছিল তাঁর। ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়া রোডের পুরনো এলাকার সে বাড়ি কলকাতার ইতিহাসপঞ্জি লেখকের জন্য একদম যথাযথ যেন!
আরও পড়ুন, বিশ্বভারতী উপাচার্যের পদ কি সত্যিই কাঁটার মুকুট?
অশীতিপর এই বৃদ্ধের বাড়িতে একবারের বেশি কড়া নাড়তে হত না কাউকে। দু ঘরের যে বাসাবাড়ি তাঁর, সেই গলির পাশে চায়ের দোকানে সাধারণত বসে থাকেন বিহারি ট্যাক্সি ড্রাইভাররা। ওঁরা তাঁকে নায়ারবাবু বলে ডাকেন। ডাকেন, কেননা, ওঁদের কথায় মনে হচ্ছিল, এখনই আবছা হয়ে আসা সবজেটে রঙের দরজা খুলে দেখা দেবেন তিনি। পরে, ওদেরই একজন বলছিলেন, ‘‘আসলে ওঁকে আমরা কখনও কোথাও যেতে দেখিনি।’’
কথাটা একেবারে সত্যি নয়। ১৯৫৫ সালে হাওড়া স্টেশনে এসে নামা ইস্তক কলকাতাপ্রেম তাঁকে এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলে যে শহরের প্রায় প্রতিটি কোণায় কোণায় পৌঁছে গিয়েছিলেন নায়ার, অধিকাংশ সময়েই পায়ে হেঁটে। তাঁর আসা এবং যাওয়া, সবটাই ছিল স্থির, শান্ত। চায়ের দোকানের মালিক কুমার বলছিলেন, তাঁর স্মৃতি যতদূর যায়, সেই তিনকাল পেরিয়ে এক কাল অবধি নায়ারবাবু দেখা হলে সবসময়েই শুধুই ঘাড় নাড়তেন।
নায়ারের বাড়ির যাওয়ার রাস্তা প্রথমবার দেখিয়ে দিয়েছিলেন যিনি, সেই বয়স্ক মুদি দোকানি বলছিলেন, যে কাউকে নায়ারের নাম বললেই হবে। ‘‘কিংবা আপনি শুধু পিটি বলবেন, তাহলেও হবে।’’ পিটি যে চলে গেছেন, সে কথা জানানোর পর বয়স্ক মানুষটি সামান্য অবিশ্বাসের চোখে তাকালেন, ‘‘ফিরে আসবেন, আমি জানি।’’
বেশ কয়েকবছর আগে এক সাক্ষাৎকারে নায়ার বলেছিলেন, তাঁর সম্পর্কে লোকে যাই ভাবুক না কেন, তা নিয়ে তাঁর কিছু যায় আসে না। তাঁকে নানারকম ভাবে যে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, তা নিয়েও উদাসীনই ছিলেন তিনি। জীবনে কখনও টেলিফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করেননি নায়ার। শুধু বই ছিল তাঁর, বাড়িতে যত বই আঁটা সম্ভব।
পরমেশ্বরন থাঙ্কাপ্পান নায়ারের লেখা প্রায় ৬০টি বইয়ের সবই ইংরেজি ভাষায় লেখা। মহেন্দ্রনাথ শেঠ, বয়স ৫৯। নায়ারের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার সময়ে মহেন্দ্রনাথের বয়স ছিল ১২। ‘‘আমি আমার বাবার দোকান চালাতাম। এ বছর আমি টানা ভুগছিলাম। সে সময়ে নায়ারবাবু আমাকে প্রতিদিন বলতেন যে আমার কাজে ফেরা উচিত, আর আমি ওঁকে বলতাম যে ওঁর হিন্দিতে বই লেখা উচিত যাতে আমি সেগুলো পড়তে পারি। এবার আর কোনও চান্স নেই।’’ মহেন্দ্রনাথের গলা থেকে হতাশা ঝরে পড়ছিল।
কীভাবে নায়ার কলকাতায় এসে পৌঁছেছিলেন, কীভাবে জীবনভর রহস্যময় এক কারণে কলকাতাকে তাঁর ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেললেন, তা নিয়ে একটা আলাদা বই-ই হতে পারে। বা হয়ে উঠতে পারে একটা সিনেমাও। কেরালায় তাঁর তিন সন্তানকে বড় করে তুলেছিলেন তাঁর স্ত্রী, মাঝেমধ্যে কলকাতায় আসতেন নায়ারের সঙ্গে দেখা করতে। আর এদিকে এ শহরে একাকী এক অন্য ভালোবাসা গড়ে তুলছিলেন নায়ার, এ শহরটার সঙ্গেই। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁর কোনও নামডাক হয়নি, খুব সামান্য অর্থ উপার্জিত হয়েছিল, আর ওঁর থেকে নিংড়ে নিয়েছিল অনেকটাই। আর একটা জিনিস হয়েছিল। পুরনো কলকাতার ব্যাপারে কেউ কিছু করতে চাইলে, প্রথম যাঁর শরণ নিতে হত, তিনি পিটি নায়ার।
পুরনো এই শহর আর তার রাস্তা, এসব নিয়ে যে অধ্যবসায়ের সঙ্গে পিটি নায়ার কাজ করেছিলেন, তার সমতুল্য প্রায় কেউই আর নেই। আর কেউ না হোক, কলকাতা এ কারণে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। আরও একটু স্মরণীয় কোনও বিদায়বার্তা যথাযথ হত নিশ্চিত, কিন্তু নায়ার বাবুর নিজের কাছে ততটা গ্রহণীয় হত না সম্ভবত।
Read the Full Story in English