গতকাল, মানে শনিবার, ছিল পার্সি নববর্ষ, 'নওরোজ'। জানতেন? উত্তর যদি না হয়, তাহলে হয়তো এও জানতেন না যে বৌবাজারের গলিতে কলকাতার একমাত্র পার্সি ধর্মশালায় শুধু নওরোজের দিন কেন, যে কোনও দিন গেলেই বিশুদ্ধ পার্সি খাবার পাবেন, এবং আবার, কলকাতায় একমাত্র। ধর্মশালার ম্যানেজার দারা হানসোটিয়া একগাল হেসে বলবেন, "আকুরি (পার্সি স্টাইলে ডিমের ঝুরি বা স্ক্র্যাম্বল) খাবেন? দশ মিনিট লাগবে।" অবশ্য আরও অনেক পার্সি খাবারই পাবেন এখানে, কিন্তু শুধু খাওয়ার জন্য গেলে অনেক কিছু না পাওয়া থেকে যাবে।
১৯০৯ সাল থেকে কলকাতার জীবনের অঙ্গ এই ধর্মশালা, 'মানেকজি রুস্তমজি ধরমশালা ফর পার্সি ট্র্যাভেলার্স', মানেকজি রুস্তমজির স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং অনুরাগীদের সাহায্যে নির্মিত। ১৯৩৬ সালে মূল ভবনটি ভেঙে বর্তমান ভবনের নির্মাণ হয়। ধর্মশালায় মার্বেলের ফলকে লেখা রয়েছে, মোট তিনটি ধর্মশালা নির্মাণ করা হয়েছিল - বম্বেতে, কলকাতায়, এবং চিনে। সে যুগে কলকাতার পদমর্যাদা কী ছিল, এ থেকেই স্পষ্ট। ৯, বো স্ট্রিটের এই ধর্মশালায় এখন অবশ্য আর তেমন কোনও 'পার্সি ট্র্যাভেলার' আসেন না, যদিও তাঁদের থাকার জন্য দিব্যি সুন্দর গোছানো এসি, নন-এসি ঘর এখনও রয়েছে।
যা বলছিলাম, শুধু খাওয়ার জন্য যাবেন না, আলাপ করবেন ম্যানেজার দারা হানসোটিয়া এবং তাঁর সদা হাস্যময়ী স্ত্রী মেহেরের সঙ্গে। পাঁচবার ব্রেন টিউমারের সার্জারি হয়েছে মেহেরের, দৃষ্টি খুইয়েছেন একটি চোখে, কিন্তু প্রাণশক্তি এতটুকু কমে নি তাতে। সুদূর আহমেদাবাদ থেকে কয়েকদিনের নোটিসে ধর্মশালার চাকরি নিয়ে চলে এসেছিলেন কলকাতায় ২০১৩ সালে, সম্বল বলতে ছিল নতুনকে জানার ইচ্ছে, এবং আহমেদাবাদে তাঁদের প্রাক্তন জীবন থেকে মুক্তির আস্বাদ। তাঁদের মুখে শুনবেন তাঁদের জীবনের গল্প, বম্বের অভিজ্ঞতার গল্প, নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের গল্প।
কলকাতায় জীবন কাটে এই ধর্মশালাকে ঘিরেই, সঙ্গী বলতে বেশ কিছু পাখি, বেড়াল, এবং একটি কুকুর। অতিথি যত কমই আসুন, দেখাশোনা করতে হয় কিছু পার্সি 'সিনিয়র সিটিজেনদের', এই শহরে যাঁরা স্বজনহারা, একেবারেই একা। সুতরাং ধর্মশালার পাশাপাশি বৃদ্ধাবাসের কাজও চলে। সকালে একবার টুক করে কাছাকাছি মেটকাফ লেনে কলকাতার একমাত্র পার্সি ফায়ার টেম্পল ঘুরে আসেন মেহের এবং দারা, যা কিনা শহরের আনুমানিক ৪০০ জন পার্সি বাসিন্দার অনেকেরই জমায়েত স্থান।
"একসময় কলকাতায় অন্তত ৩,০০০ পার্সি থাকতেন," মাথা নেড়ে বলেন দারা। "কিন্তু এখনকার প্রজন্ম থাকতে চায় না। কেন থাকবে? কাজ নেই, রোজগার নেই, সব বাইরে চলে যায়।" অর্থাৎ কিনা বৃহত্তর কলকাতারই প্রতিচ্ছবি।
তবে পার্সি ধর্মশালায় কিন্তু কাজ আছে। বয়স্ক আবাসিকদের দেখাশোনা, যার খরচা দেয় ধর্মশালার পৃষ্ঠপোষক ট্রাস্ট, জলখাবার বানানো, শহরের বেশ কিছু জায়গায় টিফিন সরবরাহের কাজ, তাছাড়াও ফরমায়েশি লাঞ্চ বা ডিনারের অর্ডার থাকলে তা তৈরির কাজ। মেনুতে আছে হরেকরকম পার্সি খাবার - ধনসক, পাতরানি মচ্ছি, সাল্লি গোশ্ত, প্রনস পাতিও, খারা রস, পালেতি, লগন নু কাস্টার্ড...তালিকা দীর্ঘতর করাই যায়। লাঞ্চ বা ডিনারের অর্ডার দিতে হলে একদিন আগে দিতে হবে, তবে জলখাবার খেতে চাইলে যে কোনও দিন চলে যান। প্রয়োজনে পার্টিও দিতে পারেন ধর্মশালার সামনের ল'নে।
খাবারের দাম এখনও এতটা সাধ্যের মধ্যে কী করে রাখেন? "পাঁচ বছরের পুরনো মেনু," বলেন মেহের। "বহুবার ভেবেছি দাম বাড়ানোর কথা, কিন্তু তারপর মনে হয়, চলছে চলুক। ডাল-রুটির খরচা তো উঠে যাচ্ছে।" নিজেরা বাঙালি খাবার খেয়ে দেখেছেন কি এই ছয় বছরে? "খুব ইচ্ছে," ফের একগাল হাসেন দারা। "কিন্তু এখান থেকে বেরোনো খুব সমস্যা। আমার চলাফেরায় কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু মেহেরের অসুবিধে হয়।"
এবছর নওরোজের দিন অবশ্য অনেক 'নন-পার্সি' অতিথিকে ভুরিভোজ করান এই দম্পতি। ধীরে ধীরে কলকাতা জানছে তাঁদের কথা, বলছেন মেহের। একজন-দুজন করে অতিথি সংখ্যা বাড়ছে। আপনিও তাঁদের মধ্যে সামিল হতে চাইলে ফোন করুন 'মেহের ক্যাটারার্স'-এ, ফোন নম্বর ৯৮৩১৪ ০৩৮৬৩, ৯০৫১৭ ৫৬৯৯৯, ২২১১ ৬৩১১। শুধু পার্সি খাবারের নয়, কলকাতার ইতিহাসের স্বাদও পাবেন।