Advertisment

“ধর্মের পরে দেশপ্রেম”: একটি  জাতীয়  বিশ্বাস

পুলওয়ামার নিহত জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী ও ভাই যখন বলেন, তাঁরা যুদ্ধ চান না, কারণ “যুদ্ধ যদি হয় তাহলে আরও বহু স্ত্রী স্বামীহারা হবে, দু'দেশেই আরও অনেক মায়ের কোল খালি হবে।” – তখন তাঁরা অন্তর্নিহিত ধর্মের উপরে ব্যক্তিগত শোক-ক্ষোভকে উঠতে দেন না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
gandhi thought in perspective of pulwama and patriotism

ভারতের রাজনীতি-সমাজনেতৃত্বে প্রাসঙ্গিক সমস্ত শক্তি যাঁকে উল্লেখ না করে প্রায় কোনও আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে না, সেই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী লিখছেন: “আমার জীবিতাবস্থায় হিংসাকে যদি ভারত তার নীতি হিসাবে গ্রহণ করে, তবে ভারতে বাস করার জন্য আমি মোটেই আগ্রহ প্রকাশ করব না। ভারত আর আমার মনে শ্লাঘা সৃষ্টি করতে পারবে না। ধর্মের পর হচ্ছে দেশপ্রেমের স্থান। আধ্যাত্মিক ক্ষুধার প্রয়োজনীয় খোরাক জোগায় বলে শিশু যেমন মাতৃবক্ষ সংলগ্ন থাকে তেমনিভাবে আমি ভারতকে আঁকড়ে থাকি। ভারত আত্মাকে নিত্য-প্রতিদিন প্রয়োজনীয় আধ্যাত্মিক পুষ্টি জোগায়। আমার সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্তির পরিবেশ এদেশে বিদ্যমান। আর সেই আস্থাই যদি চলে যায়, তাহলে নিজেকে ভবিষ্যতে অভিভাবককে খুঁজে পাওয়ার আশা বিরহিত অনাথ বালকের মত মনে হবে।”

Advertisment

আরও পড়ুন, সেনাবাহিনী, নাগরিক নিদ্রাভ্যাস ও সমাজবন্ধুদের আর একটা মিছিল

মহাত্মা গান্ধীকে নেতাজি সুভাষ জাতির পিতা হিসেবে অভিহিত করেন, স্বাধীন ভারতবর্ষ পরম্পরাক্রমে তাঁকে সেইরূপে সম্বোধন করে এসেছে। ভাষা-ধর্ম-উপাসনা প্রভৃতি বিবিধ পরিচিতিতে বিভক্ত এই বিশাল ভূখণ্ডে একটি সাধারণ জাতি-পরিচয় পাওয়া অসম্ভব। মুঘল আমল কিম্বা স্বাধীনতা আন্দোলনের উন্মেষলগ্ন অবধি এই দেশের মানুষের রাষ্ট্রীয় পরিচতি নিতান্তই রাজনৈতিক ছিল। শুরুর দিকের জাতীয়তাবাদী সাহিত্য সঙ্গীতও যদি দেখি, সেখানে জাতীয়তা অর্থে প্রাদেশিক জাতি-পরিচয়ই এসেছে। কিন্তু, আজকের ভারতবর্ষ শুধুমাত্র এক রাজনৈতিক ফেডারেশন নয়, আজকের গণমানসে ভারতীয় জাতি-চেতনা যথেষ্ট পরিমাণে বিরাজ করে। আর, বাস্তবিকই, কৃষক-শ্রমিক-উৎপাদক জনতার গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গান্ধীজি এই জাতির জন্ম দিয়েছিলেন। তাই, আজ যখন নতুন করে দেশপ্রেমের গুণগত ও পরিমাণগত মাত্রা নিয়ে দ্বেষ-হিংসার জিগির উঠছে, তখন বুঝে নেওয়া দরকার গান্ধীজি কেন দেশপ্রেমের উপরে ধর্মকে স্থান দিয়েছিলেন, তাঁর কাছে ধর্মের অর্থই বা কী, আর সত্যিই কি ভারতের জাতীয় অস্মিতায় দেশপ্রেমের স্থান ধর্মের পরেই?

গান্ধীজির বেশিরভাগ লেখাই ফলিত বা প্রয়োগকেন্দ্রিক। দার্শনিক সমস্যার মীমাংসা খোঁজার বদলে তিনি পর্যবেক্ষণ থেকে, চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি থেকে মানবমন, সমাজ, ইতিহাস প্রভৃতির স্বাভাবিক গতিধারা অনুভব করতে চেয়েছেন। গান্ধীজি বলতেন তাঁর সমগ্র জীবন পরীক্ষানিরীক্ষায় কেটেছে, যাঁর মধ্য দিয়ে তিনি সত্যের নিকটতর হয়েছেন।  তাই, ইতস্তত বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তত্ত্বচর্চার আগে আমরা দেখতে চাইব, তিনি নিজের জীবনে ধর্মকে কীভাবে দেখেছেন। আত্মকথার শুরুর একটি অধ্যায়ে তিনি ধর্মদর্শন সংক্রান্ত একটি বাল্যস্মৃতির উল্লেখ করছেন। যে রামনাম আমৃত্যু তাঁকে শক্তি জুগিয়েছে, একদম শৈশবে তাঁর পরিচারিকা রম্ভা তাঁকে বোঝান যে সব প্রকার আধিভৌতিক ভয়ের প্রতিষেধক সেই রামনাম।  তিনি লিখছেন- “আমার কিছু রামনাম অপেক্ষা রম্ভার উপরে বেশি শ্রদ্ধা ছিল, সেইজন্য বাল্যকালে ভূত-প্রেতের ভয় হইতে বাঁচার জন্য রামনাম জপ আরম্ভ করি। উহা বেশি দিন টিকে নাই, কিন্তু, যে বীজ বাল্যকালে রোপিত হইয়াছিল তাহা বৃথা যায় নাই। রামনাম আজ আমার কাছে অমোঘ শক্তি।” আমাদের মনে পড়ে গডসের গুলি বুকে নিয়ে তিনি এই নামেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু, আরও বড় কথা হল- রামনাম অপেক্ষা রম্ভার উপরে তাঁর শ্রদ্ধা বেশি জন্মেছে। তেমনিই ধর্ম বলতে তিনি যা বুঝেছেন, তাঁর পদ্ধতিগুলো পেয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই। তিনি আলাদা করে ভারতীয় কৃষকের কথা বলছেন, এইটা বোঝাতে। ভারতীয় কৃষকের রূঢ় আবরণের মধ্যে যে যুগান্তরের পুরোনো সংস্কৃতি আছে- যাকে গান্ধীজি বলছেন – আধ্যাত্মিকতার খনি, গ্রামসেবকদের উপদেশ দিচ্ছেন সেখান থেকে শিক্ষা নিতে। সেই ধর্মবোধই তাঁদের শক্তি দিচ্ছে বিদেশি পোষাক বর্জন করতে, অসহযোগ সত্যাগ্রহ চালাতে। গান্ধী-রাজনীতির থেকে মানুষের মধ্যেকার এই ধর্ম-চেতনাকে পৃথক করা প্রায় অসম্ভব।

আরও পড়ুন, Prof. Amartya Sen Interview: প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, এই দুই ছাড়া দেশ এগোবে না, বললেন অমর্ত্য সেন

সেই ধর্মচেতনাকে বুঝতে আমরা আর একবার তাঁর বড় হয়ে ওঠার জায়গাটা দেখব। গুজরাটি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের থেকে তিনি উঠে আসেন। বিষ্ণুমন্দির বা হাবেলির পাশাপাশি তাঁর বাবা মা জৈন ধর্মাচার্য, মুসলমান ও পারসিক উপাসকদের বাড়িতে আমন্ত্রণ করতেন। এই পরিমণ্ডল তাঁকে সবধর্মের প্রতি  সশ্রদ্ধ করে তোলে। ফলে গান্ধীজির ধর্মচেতনা কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিকে বাইরে রেখে নয়, বরং তিনি স্বীকার করে নেন, প্রত্যেক ধর্মেই কমবেশি সত্য আছে। এবং একটি লেখায় তিনি যে কোন ও ধর্মের যেকোনও ধর্মগ্রন্থকে যেকোনও অর্থনীতির বইয়ের থেকে বেশি কাজের বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, তাঁর মতে ধর্মগ্রন্থে যে ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা আছে, তাই-ই মানুষের মধ্যে আর্থসামাজিক বিভেদ দূর করতে পারে, অর্থনীতি বইয়ের হিসেব-যুক্তি তা পারে না। আরও একটা লক্ষ্যণীয় ব্যাপার, ধর্মের মধ্যে অনুশাসনগুলিকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। একজন নতুন খ্রিস্টান হয়ে খাদ্য-বস্ত্রাভ্যাস পাল্টালে তিনি বিতৃষ্ণ হন। তেমনই বিতৃষ্ণ হন মনুস্মৃতিতে আমিষ-ভোজন ও প্রাণীহিংসাজনিত শ্লোক পড়ে। সেগুলিকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর মতে জগৎ নীতি উপর প্রতিষ্ঠিত এবং নীতি সত্যভিত্তিক। সত্যের পথের চলার কর্তব্যপালনই হল ধর্ম।

ভারতে, কিম্বা হয়ত পৃথিবীতে‌ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মব্যবস্থার সূচনা হয় ভগবান বুদ্ধের হাত ধরে। তাঁর পন্থার মানুষদের তিনি যে তিনটি রত্নের সন্ধান দেন সেগুলি হল বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ। অর্থাৎ ধর্ম তাই-ই, যা বুদ্ধ ও সংঘকে এক সুতোয় বাঁধে। একটি বিশ্বাসে অবিচল থেকে সাংগঠনিক কাজগুলি চালিয়ে যাওয়ার যে পদ্ধতি, সেটিই এই ধর্ম। গান্ধীজি দেখেন সমগ্র সমাজের মুক্তির জন্য ব্যক্তির কাছে যে কর্তব্যমালা আসে, তা-ই তার ধর্ম। মানুষের প্রাথমিক কর্তব্য তাঁর পরিবারের প্রতি। ধর্ম তখনই সে পালন করবে যখন এই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে সে অন্য পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। এবং সম্ভবত অহিংসাই সেই ধর্মের একমাত্র পথ। এই প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তায় জৈনপ্রভাবের কথা আনা যায়। শৈশবের জৈন সাধুদের শিক্ষার পরে মাঝবয়সেও শ্রীমদ রাজচন্দ্র নামে এক জৈন সাধু ও কবি তাঁকে প্রভাবিত করেন। ভারতের ইতিহাসে অহিংসার দর্শন প্রতিষ্ঠা পায় জৈনদের হাত ধরে। তীর্থঙ্কর মহাবীর বলেছিলেন অনেকান্তবাদের কথা। অনেক-অন্ত থেকে, বিভিন্ন অবস্থান থেকে একই বস্তু বা ঘটনা কে দেখবার কথা। এবং ঘটনাক্রম এতই বিচিত্র যে এই দেখাগুলো বিভিন্ন হতে বাধ্য। ফলে একই বিষয়ের অনেক ভাষ্য তৈরি হবে- যত মত তত পথ। প্রকৃত সত্যকে বোঝার জন্য এই মত বা পথগুলির মধ্যে সংশ্লেষ বাঞ্ছনীয়। তার জন্য, কোনও ক্ষেত্রে ভীষণ পরস্পরবিরোধী দুটি বক্তব্যকেও আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। একটি মতের কাছে আরেকটি ঘৃণ্য, তবু তাদের প্রায় প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ প্রেম নইলে বিনিময় হয় না, আর অহিংসা না থাকলে চূড়ান্ততম বিরোধীকে সহ্য করে তার সঙ্গে কথা বলা যায় না। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে ধর্মমতাবলম্বী হিসেবে সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয়েছে জৈনরা। কিন্তু পরধর্ম আক্রমণ তো দুরের কথা, আত্মরক্ষার্থেও তাঁদের তরবারি ধরার কোনও নথি পাওয়া যায় না। হাজার বছর ধরে আক্রমণের সামনে জৈনরা আত্মাহুতি দিয়েছেন আর তাঁর বিনিময়ে পতন-অভ্যুদয় বন্ধুর ইতিহাস পেরিয়ে পৃথিবী পেয়েছে অহিংসার দর্শন। কালক্রমে অন্য ধর্মমত, অন্য চিন্তাধারাও সেই অহিংসাকে আত্তীকৃত না করে থাকতে পারে নি। সত্যকে তার সম্পূর্ণতায় দেখবার পথই এই অহিংসা। গান্ধীজি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হন নি। আমরা সকলেই জানি প্রথমবার তাঁর উপরে আক্রমণ করার পর তিনি নাথুরামকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ ধর্মের জন্য নিজের জীবনও দিতে হয়- তেমনটাই তিনি বিশ্বাস করতেন। গান্ধীজি নিজের সারাটা জীবন ধরে প্রচার করে এসেছেন, এই অনাক্রমণ কাপুরুষতা নয়, এই আত্মত্যাগ শক্তিমানের চেয়ে অধিক শক্তির পরিচয়।

ধর্মের এই ডাক ভারতীয় সমাজে চিরন্তন। গান্ধীজি বলছেন ধর্মের উদার অর্থ আত্মজ্ঞান। ধর্মের বা কর্তব্যের ডাকেই ভারতের সেনা ইতিহাসে বিদেশি শাসকের অনুশাসন অগ্রাহ্য করেছেন। ভারতের সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রনায়করা যে স্বাধীনোত্তর ভারতে বেশির ভাগ সময়েই শান্তির পথে আলোচনার পথে থেকেছেন, ইউরোপ আমেরিকার মতন অন্যদেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন নি, তা এই চিরন্তন ধর্মবোধের জায়গাটিকে ব্যাহত না করেই। এমনকী আমাদের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের মতন এদেশের গণতন্ত্র কখনো সেনাবাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হয় নি, বরং সুরক্ষিতই থেকেছে। পুলওয়ামার নিহত জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী ও ভাই যখন বলেন, তাঁরা যুদ্ধ চান না, কারণ “যুদ্ধ যদি হয় তাহলে আরও বহু স্ত্রী স্বামীহারা হবে, দু'দেশেই আরও অনেক মায়ের কোল খালি হবে।” – তখন তাঁরা অন্তর্নিহিত ধর্মের উপরে ব্যক্তিগত শোক-ক্ষোভকে উঠতে দেন না। শক্তিমানের চেয়ে অধিক শক্তির পরিচয় দেন শহিদের পরিজনরা। তেমনিই হয়ত অন্য এক পরিসরে আপন ধর্মের ডাকে সচিন তেন্ডুলকর বলেন খেলার মাঠকে পরদেশ-ঘৃণার রণভূমি না বানাতে। আমাদের দেশের এই বিভিন্ন টুকরো টুকরো ভূমি থেকে তাঁর আধ্যাত্মিকতাকে অধ্যয়ন করেছিলেন ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এই আধ্যাত্মিকতা শান্তির কথা বলে, আলোচনার কথা বলে, সংখ্যালঘুর বিশ্বাস উৎপাদন করে তাকে নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার কথাও বলে। মন্বন্তর, গণহত্যা, দাঙ্গা, দেশভাগ সব সামলে ভারত এক-জাতি হিসেবে যেটুকু গড়ে উঠেছে তার মূল উপাদান এই ধর্মবোধই। অন্য কোনও প্রলোভন বা অন্য কোনও আদর্শের অছিলায় এই ধর্মবোধ থেকে বিচ্যুত হলে আমাদের জাতীয়তা বিপন্ন হবে।

সূত্র:

১) আমার ধ্যানের ভারত- অনুবাদক শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় সর্বোদয় সাহিত্য ও সমাজ কল্যাণ সমিতি।

২) আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ- অনুবাদক সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, নবজীবন পাবলিশিং হাউস

৩) Reinterpreting Gandhi's Notion of "Dharma": An Entanglement of Duty, Religion, and Ethics- সত্যসুন্দর শেঠী, Gandhi Marg, Vol. 37, No. 2, July-September 2015

(লেখক প্রযুক্তিবিদ। মতামত ব্যক্তিগত)

religion Violence Mahatma Gandhi
Advertisment