সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ফের ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদী। পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও মোদীর পক্ষে যে এতটা সমর্থন থাকবে, তা ভারতের বিরোধী দলগুলির ভাবনার অতীত ছিল। বিজেপি একাই যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল, তাতে প্রশ্ন উঠছে, এবার মোদীর দ্বিতীয় অধ্যায়ে এনডিএ শরিকদের গুরুত্বই থাকল কি? অনেকের ধারণা ছিল, মোদী জিতলেও আসন সংখ্যা ২০১৪ সালের ২৮২'র তুলনায় কম হবে, সেক্ষেত্রে শরিকদের গুরুত্ব বাড়বে। কিন্তু সেটাও হলো না।
আবার অন্য আঞ্চলিক দলগুলির অবস্থাও যে খুব ভালো, তাও নয়। মোদী-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলিও ধাক্কা খেয়েছে। যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস ধাক্কা খেল। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে বিজেপি আসন পেল ১৮টি। অন্ধ্র প্রদেশে তেলুগু দেশম কিছুই করতে পারল না। চন্দ্রবাবু নাইডুর জায়গায় জগনমোহন রেড্ডি দখল করলেন সে রাজনৈতিক পরিসর।
কিন্তু কীভাবে এই ফলাফল হলো? রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, বিরোধী দল যেভাবে 'মোদী হঠাও' অভিযানে নামে, তাতে পুরো নির্বাচনটা মোদী কেন্দ্রিক হয়ে যায় - বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো ফেডারেল ফ্রন্ট গঠন করতে পারেনি, উলটে মোদী সুকৌশলে 'মোদী হটাও'-কেই ভোটের প্রচারের হাতিয়ার করে দিলেন। কর্মহীনতা, কৃষকদের সমস্যা, রাহুল গান্ধী'র তোলা 'ন্যায়'-এর বিষয়, সব গুরুত্ব হারাল। দেখা যাচ্ছে, যেসব রাজ্যে মোদীকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, সেসব রাজ্যেই মোদী ভোট পেয়েছেন বেশি। এবারের ভোট তাই অনেকটাই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো হয়েছে।
মোদী প্রধানমন্ত্রী থাকবেন কী থাকবেন না, সেটা নিয়েই গোটা দেশে ভোট হয়ে গেল। বিরোধী শিবিরে মোদীর কোনো একজন বিকল্প খুঁজে পাওয়া গেল না। ২০১৪ সালের তিনবছর অতিবাহিত হওয়ার পর মোদীর বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, কিন্তু মোদী এবং অমিত শাহ এমন এক কৌশল রচনা করলেন যে এই অসন্তোষ নির্মূল হয়ে গেল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বালাকোট আক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও বদলে দিল। মোদীর 'ব্র্যান্ড ইকুইটি'র সঙ্গে মিশে গেল হিন্দু রাষ্ট্রবাদ। মানুষ এক শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন।
কংগ্রেস নেতা পৃথ্বীরাজ চৌহানের বক্তব্য, মোদী এবং বিজেপি ধর্মের নামে মেরুকরণ করে তার ফায়দাও পেয়েছে, কিন্তু কংগ্রেস একথা বললেও বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যেও সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টির বোঝাপড়া হয়েছিল জাতপাতের ভিত্তিতে যাতে ভোট হয় তা নিশ্চিত করার জন্য। দলিত, মুসলিম, যাদব, জাট সব ভোট যাতে একত্রিত হয়ে যায়, কিন্তু সেটা হয় নি। এত বছর ধরে জাতপাতের ভিত্তিতে যে ভোট হয়েছে, তার অনেকটারই ভাঙন হয়েছে। মোদীর ভাবমূর্তির কাছে এই জাতপাতের ভোট রাজনীতি পরাস্ত হয়েছে।
রাহুল গান্ধী নিজে কেরালা থেকে জিতলেও আমেথি থেকে হেরে গেছেন। তিনি সাংবাদিক বৈঠক করে মোদীকে অভিনন্দন জানালেন। এমনকি ভোটের ফল বেরোবার আগেই আমেথির জন্য রাহুল স্মৃতি ইরানিকে অভিনন্দন জানালেন। সেটা রাজনৈতিক দিক থেকে রুচির পরিচায়ক, কিন্তু কংগ্রেসের এই হাল কেন হলো, তারও বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। শতাধিক বছরের প্রাচীন এই দলটি ৭০ বছর ধরে দেশ শাসন করেছে। কোথায় গেল কামরাজের তামিলনাড়ু, কোথায় গেল বিজুবাবু থেকে জেবি পাটনায়ক এর ওড়িশা, কোথায় গেল বিধান রায়ের বাংলা।
এবার মোদীর জয়যাত্রার পেছনে তাই একদিকে যেমন আছে মোদী নামক ব্যক্তির 'ব্র্যান্ড ইকুইটি', অন্যদিকে তেমনি আছে রাহুল গান্ধীর জোট না করার মানসিকতা। মোদীর বিরুদ্ধে কোনো জোট জাতীয় স্তরে গঠন হলো না। কোনো সমন্বয় কমিটি গঠন হলো না। কোনো আহ্বায়ক হলো না। শুধু মোদী হঠাও স্লোগান তোলা হলো, আর সব বিরোধী নেতাই ভাবতে লাগলেন যে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন, কিন্তু কোনো বিকল্প কর্মসূচি নেই। এভাবে মোদী মোকাবিলা হয়?
উত্তর ভারতে শুধু পাকিস্তান নয়, মোদীর বিভিন্ন প্রকল্পের যে সুযোগ সুবিধা মানুষ পেয়েছেন, সেটা নিয়েও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। উত্তর প্রদেশে যেভাবে মেয়েদের জন্য শৌচালয় হয়েছে, যেভাবে মানুষ ঋণ পেয়েছেন, যেভাবে ঘর পেয়েছেন, তারও একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিজেপির পক্ষে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, নির্বাচনে জয়-পরাজয় ভারতের মতো বৃহত্তম গণতন্ত্রে কোনো একটা কারণে হয় না। জয়ের পিছনে অনেক কারণ থাকে।