Advertisment

পায়ের ফাঁকে মিসাইল আর লেনিনকে এক ঘুষি

সহজ যুক্তি হল রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকবে পেশাদারি দলের খেলোয়াড় হিসেবে আর সৌজন্য থাকবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। কিন্তু দলের কর্মীদের লড়তে হবে অস্ত্র হাতে, যুক্তি দিয়ে নয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Balakot, PM Narendra Modi

বালাকোটে বিমান হামলা প্রেক্ষিতে আবহাওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে

কাশ্মীরে জিপের সামনে মানুষ বেঁধে গাড়ি চালানোর গল্প শুনেছি আমরা, ছবিও দেখেছি কিছু। সম্ভবত সে ছবিগুলো অন্তর্জালের জগতের মিথ্যে ছবি নয়, সত্য ঘটনারই দলিল। তারপর থেকে ভারতের রাজনীতিতে কাকে কোথায় সেঁটে ঠিক কোন ধরনের যানবাহনে চাপানো হবে সে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে অনেক, তবে সাম্প্রতিক মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ বিষয়টিকে প্রযুক্তির অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।

Advertisment

ভোট উৎসবে আকুল মুখ্যমন্ত্রী প্রচারসভায় ঘোষণা করেছেন যে যদি বিজেপি সরকার বালাকোটে পড়শি দেশের উগ্রবাদীদের কাঁচি-আক্রমণের প্রমাণ দিতে হবে একথা আগে জানত, তাহলে প্রশ্ন তোলা বিরোধী নেতাদের মিসাইলের সঙ্গে সেঁটে পাঠিয়ে দিত সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে। বিজ্ঞান এখানে পরিষ্কার। আপনাকে কেউ বলল এই পুকুরের তলায় ল্যাঠা মাছ আছে। আপনি বললেন নেই। সেক্ষেত্রে মাছ যে আছে সেটা প্রমাণের উদ্দেশ্যে আপনাকে জালে জড়িয়ে পুকুরের তলদেশে পৌঁছে দেওয়া হবে। আপনার ফুলকো আছে, কি ফুসফুস, সে দায় আপনার। অক্সিজেন মুখোশ রাষ্ট্র যোগান দেবে এমন কথা সংবিধানে লেখা নেই।

পড়ুন সুজাত ভদ্রের কলামের দ্বিতীয় লেখা, সাধ্বীর বেলায় আঁটিশুটি!

অর্থাৎ ব্যাপক জাতীয়তাবাদী হয়েও যদি আপনি জৈশ ঠ্যাঙ্গানোর প্রমাণ চান, সেক্ষেত্রেও মহা বিপদ। আপনার হয়ত পড়শি দেশের ওপর ব্যাপক রাগ। সৈন্যবাহিনী সেখানে অত্যাধুনিক হাউই পাঠাল জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করতে। সফল সরকার তারপর জানাল তিনশো তেত্রিশ পূর্ণ একের তিন জন জঙ্গি পটকে গেছেন। কিন্তু আপনি আবার অন্য সূত্রে খবর পেয়েছেন যে সংখ্যাটা নাকি পৌনে পাঁচ কম। সেক্ষেত্রে সেই প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আপনাকে ডেকে নেওয়া হবে সামরিক ঘাঁটিতে। দু পা সামান্য ফাঁক করে গুঁজে দেওয়া হবে মিসাইল। সামনে অবশ্যই ধরার জায়গা থাকবে, নাহলে স্থিতিজাড্য গতিজাড্যর গোলমালে (আমি না, নিউটন বলেছেন) আপনাকে পিছিয়ে পড়তে হবে। বালাকোট পৌঁছতে পারবেন না। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রমাণের যে অসাধারণ পথ দেবেন্দ্রজি পেশ করেছেন, তা জল-বাতাসা বা নকুলদানার অত্যাধুনিক সংস্করণ। প্রশ্ন করলেই অসুখ সারানোর জন্যে থাকবে ওষুধ। অর্থাৎ ভারতের একবিংশ শতকের রাজনীতিতে কথা কম, কাজ বেশি। হাত থাকতে মুখ কেন? কোদাল থাকতে কলমের প্রয়োজন কি?

এবার শুনুন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর বাণীর পরবর্তী অংশ। তাঁর হুঙ্কারের মধ্যে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর নাম চলে এসেছিল। সাধারণ মানুষকে মিসাইলে চাপালে তো ক্ষতি নেই, তাদের গলা কিংবা অন্যান্য জোর কম। কিন্তু রাহুল গান্ধীর নাম বলে ফেলায় চিন্তন দল বকে দিয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি আবার নরম ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফড়নবিশ। তিনি নাকি মজা করে বলেছেন কথাটা। এর মধ্যে কোন নকুলদানার গুলি নেই, চামড়া ছাড়িয়ে ঢাক পেটানোর চড়াম চড়াম শব্দ নেই। শুধুই বেলের পানা আর বেটোফেনের কোমল রাগ।

পড়ুন জয়ন্ত ঘোষালের কলামের প্রথম লেখা, মোদী বাংলার ক’জন ভোটারকে বুথে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন?

অর্থাৎ বড় নেতাদের যে মিসাইলগুলোতে চাপানো হবে সেগুলো বালাকোটের ওপর দিয়ে ঘুরে এসে আবার ভারতের মাটিতে মসৃণভাবে ল্যান্ড করবে। আর সত্যি যারা প্রতিবাদ করেন, যেমন ধরুন বিদ্বজ্জনদের ভুলতে বসা গৌরী লঙ্কেশ, তাঁদের চড়িয়ে মিসাইলগুলো পাইন গাছের গুলতি মার্কা দু ডালের মাঝখান খুঁজে সোজা জঙ্গি ঘাঁটিতে গোঁত্তা খাবে। বিদেশ কিংবা স্বদেশ, দল মত নির্বিশেষে শত্রু খতম। গণতন্ত্রের মূল শক্তি বকরবকর করার অধিকার, সে যত ভুলই বকি না কেন। শুধু ভুলই তো বকছি, হয়ত থুতু ছিটে লাগছে সামনের লোকটার গায়ে, বড়জোর কিছুটা গয়ের ছিটকে গিয়ে অ্যামিবার মত ঝুলতে পারে সর্বাধিকারীর সাদা পাঞ্জাবির পকেটে। তার বেশি তো কিছু নয়। কথার তো হাঁসুয়া হয় না, যে যখন তখন কোপ দিয়ে ভোট শহিদের সংখ্যা বাড়ানো যাবে। তবে শব্দের শক্তি নিশ্চয় আছে। ক্ষমতা অবশ্যই আছে সাদার ওপর কালো কিংবা অন্যান্য অক্ষরে আঁকা পিঁপড়েগুলোর। নাহলে কথার জবাবে পেটাতে হচ্ছে কেন? কদাচিৎ মুখে কথা বললেও যুক্তির বদলে হুমকি ব্যবহার করতে হচ্ছে কেন প্রতিটি মুহূর্তে?

তবে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নির্ভীক ভোটারদের যা সম্পর্ক, ভিন্ন দলের উচ্চপদাধিকারীদের নিজেদের ভাব ভালোবাসা তার তুলনায় অনেক বেশি। দেশের প্রতিষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া এতটাই ভালো যে সাধারণভাবে দলবদলগুলোর দিকে নজর রাখলেও বোঝা যায় ঠিক কী ঘটছে।

পড়ুন শুভময় মৈত্রের লেখা, স্বদেশি রাজনীতি, বিদেশি প্রচার

যদি দুটো দলের মধ্যে দেখা যায় দলবদলের ধারা দুদিকেই ক্রমবর্ধমান, সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে দলদুটির রাজনৈতিক ধারা একই রকমের। এখানে রাজনৈতিক আদর্শ বা তত্ত্বের কথা বললে বারো হাঁড়ি রাবড়ির থেকেও বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কারণ ভারতের রাজনীতিতে আদর্শ বিষয়টা বিকোয় কম। সেই পাটিগণিতেই এক দলে টিকিট না পেলে খুব সহজে অন্য দলে চলে যাওয়া যায়। সেই রসায়নেই দেবেন্দ্র ফড়নবিশ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গলা তোলার পরেই আবার মোলায়েম হয়ে যান। মোদী আর অক্ষয়কুমারের মিষ্টি আলোচনায় ভেসে আসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কথা। সংবাদমাধ্যমে চোখ বোলালেই দেখতে পাওয়া যাবে যে লোকসভা ভোটের আবহে কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে ঠিক কতগুলো বোড়ে থেকে মন্ত্রী হাতবদল হয়েছে। আমাদের রাজ্যেও তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস আর বামফ্রন্টের মধ্যে বিভিন্ন উপায়ে দলবদল অব্যাহত।

আপাতত আজকের দিনে নতুন করে এখন কংগ্রেস বা সিপিএমে যোগ দেওয়ার জন্যে অন্য দলের নেতা খুঁজে পাওয়া শক্ত। বরং তৃণমূল সরকারে আসার পরেও মানুষের ভোটে জেতা বাম নেতাদের কিয়দংশ ডিগবাজি খেয়েছেন তৃণমূল কিংবা বিজেপিতে। এই যে প্রতিটি ভোটের আগে আন্তর্দলীয় (অ-কার নয়, আ-কার) নেতানেত্রীর আদানপ্রদান, তা সব দলেরই রাজনীতি থেকে আহরণ করা ক্লোরোফিল।

পড়ুন সুজাত ভদ্রের কলামের প্রথম লেখা, নির্বাচনী ইস্তেহারে যেসব নাগরিক অধিকারের কথা নেই

সেই কারণেই দুই দলের নেতা নেত্রীর মধ্যে রসগোল্লা এবং লাড্ডুর হাতবদল সৌজন্যের শিক্ষা। উচ্চমানের পোশাকের দান-প্রতিদান ভালো মনের পরিচয়। যদি দুজন মানুষ পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্দ্বিধায় বক্তব্য রাখতে পারেন খোলা মঞ্চে, লড়াই করতে পারেন ভোটের ময়দানে, আবার রাষ্ট্র কিংবা রাজ্য শাসনে যদি নিজেদের মধ্যে কথা বলে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত সম্পর্ক রাখতে পারেন, সে তো অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু তাহলে নিজেদের দলের সমর্থকদের সেকথা বলা হচ্ছে না কেন? কোনও মঞ্চ থেকে তো শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না যে “আমাদের বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকলেও তাদের সমর্থকদের মিছরি ভেজানো জল খাইয়ে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে দিন।” কেন একই পরিবারে একজন অন্যদলকে ভোট দিলে তার গলায় লেবুজলের বদলে রাসায়নিক অম্ল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে? বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করলে হাসিমুখে নাকের ডগায় হাঁসুয়া দোলাচ্ছে কারা?

সহজ যুক্তি হল রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকবে পেশাদারি দলের খেলোয়াড় হিসেবে আর সৌজন্য থাকবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। কিন্তু দলের কর্মীদের লড়তে হবে অস্ত্র হাতে, যুক্তি দিয়ে নয়। কাউন্সিলর কিংবা পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিকে লিড দিতে হবে হাজার হাজার ভোটের। নইলে রাস্তা বানানোর টাকা জুটবে না, জল আসবে না কলে। শুধু আমাদের চেনা বঙ্গ নয়। দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যে ভোটের আগে ছড়ানো হচ্ছে টাকা। উত্তর-পূর্বের ছোট্ট প্রদেশে এক কেন্দ্রে এমন নির্বাচন হয়েছে যে নির্বাচন কমিশন পিছিয়ে দিয়েছে অন্য কেন্দ্রের ভোট। আর সেই কেন্দ্রে যে কী করা হবে সেটাই জানা নেই কোনও বিশেষজ্ঞের।

পড়ুন শুভময় মৈত্রের লেখা, কেন বামপন্থী এই লোকসভা নির্বাচন

আসলে আজকের রাজনীতির পুরো বিষয়টাই লেনিনের জন্মদিন পালনের মত। ছোট্ট একটা ঘরে কিছু বামপন্থী গত ২২ এপ্রিল এই নেতার জন্মজয়ন্তী পালন করছিলেন। লেনিনের সামনে দাঁড়ানো এক বয়স্ক মানুষ মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরেছেন নিজের কাঁধের পাশে। বাইরে দিয়ে যাচ্ছিল ভোট প্রচারের এক বড় মিছিল। তাদের যুবনেতা মিছিলে সামিল কর্মীদের বলল, “দেখেছিস, আজকাল শিক্ষিত বামপন্থীরাও লেনিনকে ঘুষি দেখাচ্ছে। তাহলে আর আমাদের মারপিটে দোষ কী?”

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

General Election 2019
Advertisment