নির্বাচনের পরে মাত্র বাহান্ন আসন পেয়ে কংগ্রেস ঝিমিয়ে ছিল। চিরাচরিত নিয়মেই পদত্যাগের ইচ্ছা (পদত্যাগ পত্র নয়) পেশ করেছিলেন রাহুল গান্ধী। অতঃপর গা হাত পা ঝাড়া দিয়ে উঠে পয়লা জুন তিনি ঘোষণা করেছেন লোকসভায় কংগ্রেসের সাংসদরা লড়াই করবেন সাহসী সিংহের মত। সর্বময় নেতা দলের সাংসদদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এই বলে যে সামনের পাঁচ বছর নাকি ব্রিটিশ শাসনের দিনগুলোর থেকেও বেশি লড়াই করতে হবে কংগ্রেসকে। তাঁদের সংসদে গলা চড়াতে হবে অনেকটা বেশি। সবশেষে রাহুল বলেছেন এক ইঞ্চি জমি ছাড়া চলবে না। অর্থাৎ লড়াই চলবে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। প্রশ্ন এই জায়গাতেই। আমাদের রাজ্যে তৃণমূল নেত্রীও ঠিক একই কথা বলেন। লড়াই করতে হবে ইঞ্চি কিংবা সেন্টিমিটারে। মুশকিল হচ্ছে ভারতের মত বিশাল দেশে দূরত্বের এই সমস্ত ছোট ছোট একক গুনলে কোনওদিনই সে লড়াই সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। ভাবুন তো সারা দেশের ক্ষেত্রফলে কতোগুলো বর্গমাইল আছে? এ তো গেল আক্ষরিক অর্থ। ভালোভাবে ভাবতে গেলেও এটুকু বোঝা উচিৎ যে এত লড়াই করে হবেটা কী? সত্যি কি এত লড়াইয়ের প্রয়োজন আছে? অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে এটাও ভাবা প্রয়োজন যে লড়াই করে কি সত্যি সব সময় জেতা যায়? তাহলে বুদ্ধিটা কী কাজে লাগবে? রাজনীতির কোন জায়গায় ব্যবহৃত হবে সমাজবিজ্ঞান? সবটাই যদি লাঠি, বোম, বন্দুক হয় তাহলে রাজনীতিটা ঠিক কোথায় পৌঁছয় তার উদাহরণ আছে প্রচুর।
ভাবুন তো একটু সিরিয়ার কথা। সাত বছর আগে ২০১২ সালে শুরু সিরিয়ার যুদ্ধ। সেই চক্করে চিঁড়েচ্যাপ্টা অন্তহীন ভয় পাওয়া অসংখ্য নিঃসহায় মানুষ। কয়েক হাজার মরেছে, আরও মরছে। সরকার কিংবা বিরোধীদের হাতে বন্দি অনেকে। আর উদ্বাস্তুদের সংখ্যা অগুনতি। এরা সব রীতিমত সচ্ছল দেশের নাগরিক। সেখানে এখন তীব্র দারিদ্র্য। রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপের উন্নত দেশগুলো এত বছর ধরে উপভোগ করছে এই হত্যালীলা। আমাদের গায়েও তার আঁচ লাগছে না। জমিয়ে দেখছি বোকা বাক্সের পর্দায় সেই ছবি। ছোট্ট মেয়ে ততক্ষণে মিসাইলের ধাক্কায় চুরমার হয়ে যাওয়া প্রতিবেশীর বাড়িতে খুঁজে বেড়াক তার শৈশবের বন্ধুর পুতুলগুলো, যে নাকি আলেপ্পোর আকাশে উড়ে বেড়ানো আসাদ যুদ্ধবিমানের টপকানো বোমায় ভ্যানিশ। পালানোর রাস্তা নেই। শহরের বাইরে গেলেই ওঁত পেতে আছে সরকারি সৈন্যরা। হয় মেরে ফেলবে, নয়তো ঢোকাবে গরাদের অন্ধকূপে। আর আমরা বছরের পর বছর ধরে চেটেপুটে খাচ্ছি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াইয়ের কোলাজ। অসহায় শিশুর মৃতদেহের ছবি, পরনে গোলাপি সোয়েটার। উপুড় হয়ে অনির্ণেয় বর্গইঞ্চির পাথর আঁকড়ে থাকা মেয়েটার মাথা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত, ভিজে গেছে অনেকটা ধুলোমাখা বাদামি চুল। শুকনো অংশটুকু ওড়ার চেষ্টা করছে আলগা হাওয়ায়। এই গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক অস্ত্রবাজারের লগ্নি। এ লড়াইতে জিতবে কে? জানে না কেউ। এ লড়াই কোন রাজনীতির? উত্তর অনুপস্থিত। কিন্তু এর মধ্যেই হেরে গেছে অসংখ্য নির্দোষ মানুষ। সাম্প্রতিক খবর বলছে ইদলিবের মত বিভিন্ন শহরে নাকি চলছে ফসফরাস আক্রমণ, জ্বলছে মাইলের পর মাইল জনপদ।
ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি অবশ্যই সিরিয়ার থেকে ভালো। আবার তুলনায় অনেকটা খারাপ উত্তর ইউরোপের শান্তিপ্রিয় দেশগুলোর থেকে। বিরোধীদের মতে দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের তীব্র জিগির তুলে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। সঙ্গে নাকি সাম্প্রদায়িকতার সুড়সুড়িও আছে ফোড়নের মত। তবে শুধু বিজেপিকে দোষ দেওয়া কেন? আমরা সবাই জানি এই অস্ত্র একা বিজেপির নয়, ভারতের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের। জাতপাতের বিভাজন, সম্প্রদায়ের বিভেদ, প্রাদেশিকতার দ্বন্দ্ব আমাদের দেশে রক্ত ঝরিয়েছে বারবার। সময়ের সারণীতে কিছু মানুষ নিয়ম করে ভাগ হচ্ছেন কয়েকটি দলে। আইপিএল হলে ক্রিকেট খেলেই গল্প শেষ। কিন্তু রাজনীতিতে সে খেলায় চলমান হিংসার প্রবণতা বেশি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে তো হানাহানির সীমা নেই। এবারের নির্বাচনের আগে পরে অন্যান্য দু-একটি রাজ্যেও প্রাণহানির খবর এসেছে। সশস্ত্র অতিবামদের সঙ্গে নিরাপত্তাবাহিনীর গুলির লড়াইতে দুপক্ষেরই প্রাণ যাচ্ছে নিয়ম করে। সংসদীয় গণতন্ত্রে হিংসার যে কোনও স্থান নেই, সে কথা জোর দিয়ে বলার মত রাষ্ট্রনেতা শুধু আমাদের দেশে কেন, বিশ্বজুড়েই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্যই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী খুব বেশি আক্রমণাত্মক থাকেন না তাঁর বক্তব্যে। তাই নির্বাচন পরবর্তী তাঁর ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াইয়ের ডাক একেবারেই বেমানান।
এই সময় বিশেষ করে ভাবা উচিৎ পশ্চিমবঙ্গের কথা। বিভিন্ন ধ্বনির সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেলে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে তা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। বামফ্রন্ট সরকার ২০০৯ লোকসভায় খারাপ ফল করার পর বোঝাই যাচ্ছিল যে তাদের ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে। খুব সম্ভবত জনগণের মনোভাব বুঝে জোর করে গদিতে থেকে যাওয়ার চেষ্টা আর করেন নি বাম নেতৃবৃন্দ। ২০১১ বিধানসভায় জেতার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও শান্তিরক্ষায় উপযুক্ত ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু এবারের লোকসভা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ততটা সরল নয়। একথা সত্যি যে বামফ্রন্ট অবশ্যই বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়ের সবথেকে বড় শত্রু। কিন্তু বামফ্রন্টের ভোট সাড়ে সাত শতাংশে নেমে আসার প্রেক্ষিতে লড়াইটা এখন সরাসরি তৃণমূল বনাম বিজেপিতে। গোপন আঁতাতের যুক্তি এই বাজারে আর খাটবে না। বিশেষ করে এই দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে। আর সেই লড়াইতে সবথেকে বিপজ্জনক বিষয় হল তৃণমূলের থেকে বিজেপিতে রাজনীতির কারবারিদের যোগদান। রাজনীতির ঊর্ধ্বে এখানে ব্যক্তিগত বৈরিতার বিপদ অনেক বেশি। এই তীব্র বৈরিতায় অস্ত্র হতে পারে একইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক এবং প্রাদেশিক বিভাজন। পশ্চিমবঙ্গের অশান্তির আঁচ পড়তে পারে অন্য রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিদের ওপরেও।
প্রশ্ন তাই আমরা কোন রাস্তায় হাঁটবো? ভারত এতটাই বড় দেশ এবং তার গণতান্ত্রিক কাঠামো যতটা মজবুত তাতে চটজলদি সিরিয়া হওয়ার ভয় ততটা নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে গৃহযুদ্ধের মত পরিস্থিতি হয়ত তৈরি হতে চলেছে আমাদের রাজ্যে। তাই নেতাদের বুঝতে হবে যে সংসদীয় গণতন্ত্রে হিংসা মোটেও সফলতম রাজনৈতিক কৌশল নয়। নেতাদের শুধু লড়াইয়ের কথা বললেই চলবে না। একটু ফিরে দেখতে হবে ইতিহাস। ঠিক কোন ইতিহাসে আজকে সিরিয়ার এই দশা সেটা সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদের পাঠ্যবইতে ঢোকানো হোক। লড়াই ইঞ্চিতে নয়, সার্বিক সংসদীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে মানবসম্পদের উন্নয়নের। দেবালয়ের তুলনায় শৌচালয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা আগে তো বেশ কয়েকবার শুনিয়েছেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। সেই শ্লোগান আবার প্রতি হপ্তায় “মন কি বাত”-এ বলুন তিনি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ভুলে দ্রুত মন দিন নিম্নবিত্তের উন্নয়নে। রাহুল গান্ধী সংসদে লড়াই না করে আগে বোঝার চেষ্টা করুন শ্রমিক কৃষকদের জন্যে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার কতটুকু বাস্তবায়িত হল। ইঞ্চি থাকুক জ্যামিতির স্কেলে, লড়াইয়ের ময়দানে নয়। মানুষের উন্নয়নে রক্ত ঝরানোর প্রয়োজন হোক বুদ্ধিটুকু খরচ করার পর।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)