সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্বে শাসক দলের রাজনৈতিক ব্রহ্মাস্ত্র হল “জাতীয়তাবাদ”, যাকে অনেকে “দেশপ্রেম” নামে অভিহিত করতে চাইছেন, যদিও শব্দদুটির ব্যঞ্জনা আলাদা। কীভাবে এবং কেন এই আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও তার সঙ্গে যুক্ত ঘৃণার রেটরিক নির্মিত হল, কেন ধর্ম বা উন্নয়নের গল্প ফেলে সিংহাসন রক্ষার্থে এর ওপরেই নির্ভর করছেন শাসক দল, তা এই সিরিজের পঞ্চম পর্বে (“নির্বাচনমুখী জাতি ও জাতীয়তা”) সংক্ষেপে আলোচিত হয়েছে। সেই প্রাক-কথনের ওপর ভিত্তি করেই আজকের কথাবার্তা। নির্বাচনের ঠিক মাস দেড় দুই আগে জাতীয়তাবাদী গণনাট্যের ক্লাইম্যাক্স দেখার অভিজ্ঞতা বিষয়ে দু-এক কথা।
দেশের রাজনৈতিক হাওয়া যেভাবে বইছিল, তা বিজেপির পক্ষে বিশেষ আশাব্যঞ্জক ছিল না। “নোটবন্দি” নামক অর্থনৈতিক অ্যাডভেঞ্চারের ওপর বড় অংশের নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ প্রথমে আস্থা রেখেছিলেন ব্যক্তিগত কষ্ট সত্ত্বেও। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, এর ফলে কালো টাকার কারবারিরা বিপদে পড়বেন এবং দরিদ্র মানুষ কিছুটা অর্থনৈতিক সুবিচার পাবেন। বাস্তবে সেসব কিছুই হল না। কালোবাজারিরা দিব্বি নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিলেন, মাঝখান থেকে নগদ টাকার ভরসায় চলা কিছু ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল এবং কাজ হারালেন কয়েক লক্ষ মানুষ। এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে শেষ শ্বাসটি নিলেন কিছু বৃদ্ধ। পরবর্তীকালে যখন বোঝা গেল বড়মাপের ঋণখেলাপীদের ঋণ শোধে বাধ্য না করে সাধারণ মানুষের টাকায় ব্যাংকগুলোকে পুনরায় সচল করার একমেবাদ্বিতীয়ম সদুদ্দেশ্য নিয়ে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল, যাতে ভবিষ্যতে ব্যাংকগুলি আরো অনেক টাকা অফেরতযোগ্য ঋণ হিসেবে ধনীতম ব্যবসায়ীদের দিতে পারে, তখন সেইসব জীবিকা বা প্রাণ হারানো মানুষের অভিসম্পাত দেশের বাতাসকে ভারি করে তুলল। অর্থনীতিবিদ নই, তা জিএসটির ভালো মন্দ কিছু বলব না, কিন্তু জিএসটির কারণেও ছোট ও মেজো বহু ব্যবসায়ীর (এমনকি বহু ক্রেতারও) দীর্ঘশ্বাস ভারতীয় বায়ুমণ্ডলে মিশেছে, সেকথা নিয়মিত টের পেয়েছি। শাসকদলের পক্ষে হয়ত সেই বাতাসে শ্বাস নেওয়াই কঠিন হয়ে যেত, যদি রাজনীতির অভিমুখ না ঘুরিয়ে দেওয়া যেত।
আরও পড়ুন, মোদী বাংলার ক’জন ভোটারকে বুথে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন?
সেই বদল আনার চেষ্টায় মেরুকরণের পুরনো ও নতুন রাস্তায় হাঁটা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। কিন্তু তাতেও যথেষ্ট কাজ হচ্ছিল না। শুধু চাকুরিজীবী বা ব্যবসায়ী মহলে নয়, অসন্তোষ জমা হচ্ছিল কৃষক মহলেও। কৃষকদের আত্মহত্যা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন আবহে অখিল ভারতীয় কিষাণ সভা একত্র করে ফেললেন প্রায় পঞ্চাশ হাজার বিক্ষুব্ধ কৃষককে। ৬ মার্চ ২০১৮ নাসিক থেকে শুরু হল কিষাণ লং মার্চ, যা শেষ হল ১২ মার্চ মুম্বাইতে। সরকারি আশ্বাস পেয়ে তবেই মিছিল আর ঘেরাও থেমেছিল, কিন্তু সরকার কথা রেখে উঠতে পারেননি। ২০১৮র ২৯ নভেম্বর রাজধানী দিল্লিতে শুরু হল সারা ভারত থেকে আসা কৃষকদের আরেক মিছিল এবং সংসদ ঘেরাও করার কর্মসূচি। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত বা জামায় লেখা “মোদি সরকার হোশ মে আও” স্লোগান সরকারের কানে মধুর বীণা বাজায়নি নিশ্চিতভাবে।
দলিত ভোট নিজেদের ঝুলিতে টানার কিছু চেষ্টা করলেও দলিত রাজনীতিতেও বিজেপি ক্রমে কোণঠাসা হচ্ছিল। ভীমা কোরেগাঁওয়ের মতো ঘটনা সরকারকে কী পরিমাণ চাপে রেখেছিল, তা বোঝা যায় বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করার তাড়াহুড়ো দেখেই। সেই পুলিশি তৎপরতাও শেষ অব্দি রাজনৈতিকভাবে সংঘ পরিবারের পক্ষে যায়নি। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক দল একজোট হয়ে বিজেপি বিরোধী তৃতীয় ফ্রণ্ট তৈরি করে ফেলল ২০১৯ শুরু না হতেই। রাফাল বিমান ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে রাহুল গান্ধীও নিজের কেরিয়ার গড়তে উঠেপড়ে লেগেছেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, রাহুল না মমতা, তা নিয়ে বিদ্বজ্জনসুলভ সান্ধ্য চায়ের আড্ডা শুরু হয়ে গেছে টিভি চ্যানেলে, যা ক্রমশ চ্যালেঞ্জ করছে জনমানসে কয়েক বছর আগে ঝড় তোলা নির্বিকল্প নমো হাওয়াকে।
এমতাবস্থায় বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রে সরকারের প্রতিশ্রুতিভঙ্গে রুষ্ট হয়ে যখন ২০১৯এর ২০ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি নাসিক থেকে মুম্বাই দ্বিতীয় কিষাণ মার্চের ডাক দেওয়া হয় হয় এবং তার কদিন পর ৩রা মার্চ দিল্লির বুকে “মজদুর অধিকার সংঘর্ষ অভিযান”-এ সারা দেশের বহু সহস্র শ্রমিক বঞ্চনার প্রতিবাদে সামিল হবেন বলে আগাম কর্মসূচি ঘোষিত হয়, তা গদি বাঁচাতে চাওয়া রাজাকে বিব্রত করবেই। এই মিছিলগুলো যদি বিশাল আকার ধারণ করত এবং সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট প্রচার পেত, তাহলে এরা হতেই পারত সরকার পতনের কারণ। কিন্তু তেমন হল না, কারণ তার ঠিক আগে ঘটে গেছে জাতির বুক কাঁপিয়ে দেবার মতো অন্যকিছু।
আরও পড়ুন, এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিল: রাষ্ট্রনীতি বনাম শরণার্থী
ঘটনার প্রেক্ষাপট বা কার্যকারণ যাই হোক না কেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা হল পুলওয়ামার ভয়াবহ গাড়ি-বোমা বিস্ফোরণে চল্লিশজন সেনা-জওয়ানের অকালমৃত্যু। এক কথায় স্তম্ভিত করে দেবার মতো ঘটনা। এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে সেই মুহূর্তের রাজনৈতিক হাওয়াকে প্রবলভাবে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে নির্দিষ্ট নৌকার পালের দিকে, মূলত রেটরিকের সাহায্যে। অন্যান্য পক্ষও নানাবিধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। আর এই সমগ্র ঘটনা প্রবাহ আমার মতো মূর্খ ও হতভম্ব সাধারণ ভারতবাসীকে দাঁড় করিয়েছে অজস্র প্রশ্নের সামনে।
নিজের দেশের চল্লিশজন সৈনিকের মৃত্যুতে যে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া মানুষের হবে বলে ধরে নেওয়া যায়, তা হল সুগভীর শোক। এই একটিমাত্র প্রতিক্রিয়া, যা প্রকৃত অর্থে মানবিক এবং ভবিষ্যতে মানুষের এজাতীয় অপমৃত্যু আটকানোর জন্য উন্নততর রাজনীতির জন্ম দিতে পারে। অথচ পুলওয়ামা কাণ্ডের পর ক্রোধ থেকে বিদ্রূপ, লাভের গুড় খাবার লোভ থেকে শুরু করে দার্শনিক নির্লিপ্তি অব্দি সবরকম প্রতিক্রিয়াই চোখে পড়ল রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে, শুধু এই “শোক” নামক দুর্বল, পেলব, ভেজা-ভেজা অনুভূতিটাই যেন হারিয়ে গেছে একবিংশ শতাব্দীর মানুষের হৃদয় থেকে। হয়ত মন থেকে হারিয়ে গেছে হৃদয় ব্যাপারটাই। নিহত সৈনিকের রক্ত আর তাঁদের পরিবারের চোখের জল বেবাক হারিয়ে গেল রাজনীতির ঘোলা জলের তোড়ে।
পুলওয়ামার ঘটনার পর ভারতের রাজনীতি বইতে লাগল দুটি প্রধান খাতে। বিজেপি ও সংঘ পরিবারের নেতৃবৃন্দ, তাঁদের পেটোয়া সংবাদমাধ্যম, আইটি সেলের মাহিনাভুক কর্মচারী এবং জনতার মধ্যে মিশে তাঁদের কর্মী ও গুণ্ডা (সড়কযুদ্ধের ভ্যানগার্ড বললেও হয়) সমবেতভাবে যুদ্ধের ধুয়ো তুললেন মুহূর্তে। এমন অস্বাভাবিক দ্রুততা এবং নিপুণতায় তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন, যাতে অনেকেরই মনে হয়েছিল যেন এই ঘটনাটি ঘটবে তা তাঁরা আগেই জানতেন এবং এর সুযোগ নেবার জন্য রীতিমতো প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। রিপাবলিক টিভির মতো সংবাদ চ্যানেলগুলো এত উচ্চগ্রামে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন যে তা জনগণকে বাঘের পিঠে চাপিয়ে দেবার পাশাপাশি যেন প্রকারান্তরে সরকারকেও যুদ্ধ করার জন্য চাপে ফেলে দেবার আয়োজন।
আরও পড়ুন, নির্বাচনী ইস্তেহারে যেসব নাগরিক অধিকারের কথা নেই
কোনো দ্বিধা নেই যে তাঁরা বিজেপির পক্ষেই নিজেদের প্রচার যন্ত্রকে ব্যবহার করছিলেন, সরকার বিরোধী সকলকে পাকিস্তানি দাগিয়ে দিয়ে, সব প্রশ্নকর্তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে সরকারকে সাহায্য করতেই চাইছিলেন, কিন্তু তাঁদের আওয়াজের পরিমাণ আদালত নির্ধারিত দূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। যেন অপ্রয়োজনে বেশি চিৎকার করছিলেন কিছু বিখ্যাত সাংবাদিক। তাঁদের আচরণে দম্ভের প্রকাশ ছিল অতিরিক্ত। এত বেশি অহংকারসর্বস্ব আগ্রাসী সাংবাদিকতা শেষ অব্দি সরকারের পক্ষে গেল কিনা, তা ভোটের ফলই বলবে, কিন্তু সাংবাদিকতার মূল্যবোধের ক্ষেত্রে তাঁরা কিছু বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিলেন, যা আগামী দিনে সংবাদসংস্থা ও সাংবাদিকদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি উন্মাদনা বজায় রাখতে গিয়ে তাঁরা এমন কিছু তথ্য পরিবেশন করলেন, যা জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে খারাপ। যেমন ধরা যাক উইং কম্যান্ডার অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর সামনে যে প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে অস্বীকার করেন, আমাদের সংবাদমাধ্যম সেই উত্তর সর্বসমক্ষে পরিবেশন করেন। অথচ, কি আশ্চর্য, জাতীয় নিরাপত্তাই এঁদের চিৎকৃত অধিবেশনগুলির প্রধান উপজীব্য ছিল। মূল ধারার সংবাদমাধ্যম এবং সোশাল মিডিয়া মোটের ওপর জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধের জিগির তুলে অন্যান্য সব ইস্যুকে চাপা দেবার কাজে প্রাথমিকভাবে সফল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পুলোয়ামা, অভিনন্দন এবং বালাকোট এঁদের সুনামিতে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ঢেউ জুগিয়েছে। তবে সেই সুনামি আপাতত খানিক থিতিয়ে পড়েছে। তার জলে যেসব উপকূল ভেসেছিল, সেখানে জল দাঁড়িয়েছে কিনা, তা মাসখানেক পরে বোঝা যাবে।
আদালত এবং নির্বাচন কমিশনের নিষেধ সত্ত্বেও সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি প্রবলভাবে চলতে থাকল পুরো সময়টা জুড়ে। সেনার বীরত্ব বা দেশপ্রেমকে হাতিয়ার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার অনৈতিক প্রচেষ্টা দেখা গেল সরকারপক্ষের মধ্যে। এই সংবিধানবিরোধী কাজের জন্য কারো কোনো বড় শাস্তি হল না। সংসদীয় রাজনীতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর এই সংযুক্তির প্রয়াস গণতন্ত্র ও জাতীয় নিরাপত্তা উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর। একটি নির্বাচন জেতার জন্য আমাদের নেতারা দেশের যে ক্ষতিগুলো করে দেন, তা অনেক বড় মাপের এবং দীর্ঘস্থায়ী।
আরও পড়ুন, নির্বাচনমুখী জাতি ও জাতীয়তা
এই প্রসঙ্গে সরকারের আচরণে বিচিত্র দ্বিচারিতা লক্ষ্য করা গেল। বালাকোটে বিমান হানার পর তাঁরা সেনা অভিযানের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আত্মসাৎ করার চেষ্টায় ছিলেন। তাঁদের বক্তৃতায়, প্রচারে, বারবার উঠে এসেছে বালাকোট এবং কতজন জঙ্গি নিহত, তার ফাঁপানো পরিসংখ্যান। কেউ কেউ সরাসরি হিসেব কষে বলেছেন যে এই বিমান হানার ফলে তাঁরা কতগুলো বাড়তি আসন পাবেন। অবাক কাণ্ড, যে সরকার সেনার সাফল্যের পূর্ণ কৃতিত্ব নিজেরা নিতে চান, সেই একই সরকার পুলওয়ামায় নিহত চল্লিশজন নিরস্ত্র সৈনিকের নিরাপত্তা বিধানে বিপুল ব্যর্থতার দায় নিতে একেবারেই রাজি নন। এ নিয়ে প্রশ্ন করতে গেলেই হারেরেরে রবে তেড়ে এসে প্রশ্নকর্তাকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু একজন দেশপ্রেমিক ভারতীয় হিসেবে আমিও জানতে চাই কী করে অমন অবহেলায় অপঘাতে মারা যেতে দেওয়া হল আমার দেশের এতজন বীর সৈনিককে? এ ক্ষতি অপূরণীয়। এঁরা আমাদের ঘরের ছেলে। পাশের বাড়ি গিয়ে কজনকে মেরে এলেই ঘরের ছেলের মৃত্যুশোক অত সহজে ভুলব না। বিমান হানার দাবিদাওয়া শোনার এবং মেনে নেবার পরেও থাকবে সেই একই প্রশ্ন। কার গাফিলতিতে এই অঘটন ঘটল? অতগুলো নিয়ম ভেঙে এই ঘটনা ঘটতে দেবার পিছনে কারণ কী? জৈশ-ই-মহম্মদের শাস্তি হোক, কিন্তু ভেতরের লোক ষড়যন্ত্রে জড়িত নয় তো? কে সেই ভেতরের লোক? কী তার স্বার্থ? কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থ রক্ষার জন্য বলি দেওয়া হল না তো? দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো। আমরা নিশ্চিত হতে চাই, আমাদের দেশের সুরক্ষার ভার যাঁদের উপরে, সেই সৈনিকেরা দেশের অভ্যন্তরে নিজেরা সুরক্ষিত। আমরা নিশ্চিত হতে চাই যে রাজনীতির বেনো জলে ভেসে যাবে না তাঁদের শব।
অনেকে ইতিমধ্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে নির্বাচনে সুবিধা পাবার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে গোয়েন্দাদের সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে জৈশকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে পুলওয়ামার হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য। ভবিষ্যতে যদি কোনোদিন প্রমাণিত হয় যে এই সন্দেহই সত্যি, তবে তার ফল হবে ভয়াবহ। আশাকরি তা প্রমাণিত হবে না। এমনটা সত্যি ঘটে থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে তা নিয়ে সত্যিকারের তদন্ত হবে না এবং এত খারাপ সত্য কেউ প্রকাশ করবেন না। করলে বিভিন্ন স্তরের অনেক বড় বড় মাথা কাটা পড়ার পাশাপাশি ভেঙে পড়বে সেনাবাহিনীর মনোবলও। সুতরাং এসব সত্য জানলেও প্রকাশ্যে না আনার মতো বুদ্ধিটুকু উপরমহলের সকলেরই আছে বলে মনে হয়। কিন্তু পাশাপাশি এই শঙ্কাও মনে আসে, এই পরিণতিবোধ আর বুদ্ধির ওপর ভরসা রেখে, গোপনীয়তাকে কাজে লাগিয়ে প্রাক-নির্বাচনী পর্যায়ে সেনা-জওয়ানের প্রাণের বাজি ধরার রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবার থেকে পরম্পরা হয়ে উঠবে না তো?
সন্দিগ্ধ মানুষের এই ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ঠিক হোক বা ভুল, পুলওয়ামা উত্তর পর্যায়ে সরকার ও শাসক দল যে রাজনীতি করেছেন, তা নিন্দনীয়। সেনাবাহিনীকে ভোটের প্রচারে যুক্ত করা ঘোর অন্যায় হয়েছে। তাঁদের অনুগত গুণ্ডাবাহিনী দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে কাশ্মীরিদের ওপর হামলা চালিয়ে কাশ্মীর সমস্যাটিকে আরো জটিল করলেন এবং এই প্রসঙ্গে ভারতের ভাষ্যটিকে দুর্বল করে দিলেন। “কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ”, এই স্লোগানটি কি তাঁরা কখনো শুনেছিলেন? এই স্লোগানটিকে দুর্বল করে দিয়ে যে তাঁরা পাকিস্তানের হাত শক্ত করলেন, তা কি তাঁরা জানেন? পাশাপাশি কাশ্মীরিদের মনে হিন্দুস্তানীদের প্রতি সন্দেহ আর ঘৃণা আরো খানিকটা গভীর করে দিলেন। সন্দেহ হয়, শাসকদলের এই কর্মীরা পাকিস্তান সরকার বা আইএসআইয়ের এজেন্ট নন তো?
আরও পড়ুন, ভোট দিতে যাওয়ার আগে মনে রাখবেন…
এই পর্বে আম নাগরিক আর বিরোধী দলগুলির ভূমিকাও আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে পারত। সেই প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র আলোচনা প্রয়োজন, যা পরবর্তী সময়ের জন্য তোলা রাখতে হচ্ছে স্থানাভাবে। পরবর্তী সময়ে আমাদের জন্য তোলা থাকছে হয়ত আরো ভয়াবহ কিছু অভিজ্ঞতা। এই লেখা যখন শেষ করছি, তার আগেই কলম্বো কেঁপে উঠেছে একাধিক বিস্ফোরণে। নিহত দু'শ জনেরও বেশি, আহত পাঁচশ মানুষ। আমরা, ভারতীয়রা, খুব ভালোভাবে পরিচিত সিরিয়াল ব্লাস্ট ব্যাপারটার সঙ্গে। অথচ আজ আমরা আশ্চর্য ভাবে নির্লিপ্ত, নিরুচ্চার। যে ঘটনা থেকে ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের কোনো রাজনৈতিক মাইলেজ পাবার আশা নেই, সেই ঘটনা যত বড় মাপেরই হোক না কেন, তা আমাদের ব্যস্ত করতে পারে না আজকাল। আমাদের (রাজ)নীতি আমাদের এমনই নীতিহীন প্রান্তরে এনে দাঁড় করিয়েছে। অথচ বোমা কখন কার বাড়িতে ফাটবে, তা কেউ জানে না। হিংস্রতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গেলে পৌঁছতে হবে এক উন্নততর মানবিক রাজনীতিতে, যার প্রথম ধাপ হল সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ছেঁদো রাজনীতি বন্ধ করা। তার জন্য আগে বুঝতে হবে একটা নির্বাচন পেরিয়ে আরো অনেকটা ভবিষ্যৎ পড়ে থাকে। একবার ভোটে জেতার জন্য সমগ্র দেশের বাকি জীবনটাকে বিব্রত করে তোলা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়।