গোপা সামন্ত
মেয়েদের যা খুশি বলা যায়, যত খুশি অপমান ও অত্যাচার করা যায়। এটাই তো স্বাভাবিক, কারণ এটাই সমাজের নিয়ম। সমাজ ও সংসারকে রক্ষা করা তো আমাদের পবিত্র দায়িত্ব, তাই না? সে দায়িত্ব পালন করতে গেলে মেয়েদের স্বাধীনতা তো একটু আধটু ছাঁটতেই হয়। না’হলে পরিবার নামক অচলায়তন ঘাড়ে করে বইবে কারা বলুন? কাজে বেরোচ্ছে ভালই তো, বাড়ির রোজগার বাড়লে পরিবারের স্বাছন্দ্য বাড়ে। কিন্তু তাই বলে যখন খুশি বেরনো, যখন খুশি বাড়ি ঢোকা! কাজে বেরিয়েছ বলে সংসারের দায় দায়িত্বে অবহেলা করা! বড় বাড় বেড়েছে, দাও ওদের বাড়িতে ঢুকিয়ে। বেচাল হলেই আমাদের হাতে আছে মোক্ষম অস্ত্র – প্রথমে চড়া সুরে তাদের কর্তব্য বুঝিয়ে দেওয়া (পড়ুন চিৎকার চেঁচামেচি), না বুঝলে চড়-থাপ্পড়-লাথি, আর তাতেও না হলে ধর্ষণ, বাড়ির ভিতরে ধর্ষণ তো আর প্রমাণ করা যাবে না, সে তো স্বামীর অধিকার। শারীরিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আছে মানসিক নির্যাতনের বন্দোবস্ত। তাতে আবার যোগ দিতে পারে পরিবারের অন্য মহিলা সদস্যরাও, বিশেষত শাশুড়ি। কারণ তিনিও তখন পুরুষতন্ত্রের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বুঝে গেছেন ক্ষমতার আসল উৎস হল পৌরুষ।
পরিবারের বাইরে বৃহত্তর সমাজেরও তো একটা দায়িত্ব আছে মেয়েদের ঠিক পথে রাখার যাতে পরিবার ও সমাজ কোন সংকটে না পড়ে। তার জন্য প্রতিনিয়ত বিধানের তো কোন শেষ নেই। যে যা পারেন বিধান দিচ্ছেন রোজদিন। জনপ্রতিনিধি উপদেশ দিচ্ছেন হিন্দু মেয়েদের উচিত বিয়ে করে চারটি বাচ্চার জন্ম দেওয়া। প্রাপ্তবয়স্ক হিন্দু মেয়ে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করলে কোর্ট রায় দিচ্ছে মেয়েকে বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে। ২০১৫ সালে একটি ধর্ষণের মামলায় রায় দিতে গিয়ে হিমাচল হাই কোর্টের বিচারক বলে বসলেন মেয়েদের শালীনতা রক্ষার জন্য মেয়েদেরই সাবধান হওয়া উচিত। খাপ পঞ্চায়েত সমাজ তথা মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করছে উত্তরের বেশ কয়েকটি রাজ্যে। কিন্তু সে বিষয়ে রাজ্য সরকারগুলি নির্বিকার। কেন না তারাই তো ভোটে বাহুবলীর ভূমিকায় নামবে সরকারকে জেতাতে। এগুলো সাধারণ চোখে মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাই এসব নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে একটু হাল্লা হলেও, তেমন কেউ মাথা ঘামান না। আসল সমস্যার শুরুটা ঠিক ওখানেই। আমরা সমাজে দিনদিন যেটা খুব দেখছি তা হল পৌরুষের বাড়বাড়ন্ত। এই বাড়বাড়ন্ত চলছে পাড়া থেকে দেশ সর্বত্র।
সংবিধান সংশোধন করে মেয়েদের আনা হ’ল স্থানীয় প্রশাসনে। প্রায় তিন দশক পরেও পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় মেয়েরা আজও লড়ে চলেছে নিজেদের মত ক’রে কাজ করার জন্য। কিন্তু হচ্ছে কোথায়! চারপাশে পৌরুষের এত বাড়বাড়ন্ত যে কেউ যদি একটু চেষ্টা করে নিজের ক্ষমতা খাটাতে তাহলে সে আর পরের বার টিকিট পায় না। শত অপমান সহ্য করে, হাজার বাধা পেরিয়ে মেয়েরা যখন একটু সাহস করল তখন আবার তাদের ঘরে ঢোকানোর জন্য কত আয়োজন। হরিয়ানাতে নিয়ম হল লেখাপড়া শিখে বেশ খানিকটা শিক্ষিত না হলে পঞ্চায়েত ভোটে লড়া যাবে না। হাজার হোক সরকার চালানো বলে কথা! কলমের এক খোঁচায় অনেক মেয়ে যোগ্যতা হারাল নির্বাচনে লড়ার যারা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পঞ্চায়েতে ক্ষমতা দখল ক’রে পুরুষদের টক্কর দিচ্ছিল তাও আবার হরিয়ানার মতো পৌরুষের বাড়বাড়ন্তের রাজ্যে। কিন্তু বলা হল, তা নাকি মেয়েদের ভালোর জন্যই। হরিয়ানার মতো রাজ্যে মেয়েরা নাকি দলে দলে স্কুল পাশ করবে নির্বাচনে লড়ার জন্য ।
আরও পড়ুনঃ অর্ধেক আকাশে সন্তোষ! কেন?
রাজনীতিতে বরাবরই ছিল পৌরুষের পুজো, কারণ পৌরুষই হোল ক্ষমতার উৎস। আর ঠিক সেই কারণেই মেয়েরা এড়িয়ে চলেছে রাজনীতির উঠোন। মহিলা নেত্রীদের রাজনীতির ময়দানে এসে প্রথমেই বলে নিতে হয় যে তিনি আর যাই হোক, নারীবাদী নন। না হ’লে তিনিই তো আর পৌরুষের রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারবেন না। তিয়াত্তর ও চুয়াত্তরতম সংবিধান সংশোধনের পরে প্রায় তিন দশক পেরিয়ে গেলেও সংসদে পাশ হয়নি মহিলা সংরক্ষণ বিল। এ আসলে অস্তিত্বের সংকট, যাঁরা বিল পাশ করবেন, কে বলতে পারে তাঁদের কেন্দ্রটাই হয়ত চলে যাবে মহিলাদের দখলে! আর তারই ফলে আজ রাজনীতিতে আবার পৌরুষের এত বাড়বাড়ন্ত। দেশের প্রধান মন্ত্রীর যোগ্যতা দাঁড়িয়েছে ছাতির মাপে। যেন তিনি দেশ চালাবেন বুদ্ধি নয়, শুধু গায়ের জোরে। লোকসভা ও বিধানসভার মাননীয় জনপ্রতিনিধিরা মেয়েদের চরম অপমান করছেন প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে। দেশের ও দশের অভিভাবক নেতা-নেত্রীরা তা নিয়ে কোন প্রতিবাদ করছেন না। যেন তাঁরা শুনতেই পান নি। আমরা জানি, মৌন থাকা সম্মতিরই লক্ষণ। অর্থাৎ ভোটে জিততে পারলেই হল – কে কী বলল অত কথায় কি কান দিলে চলে!
আরও পড়ুনঃ কুমারীধর্ষণের চরম শাস্তিতে সক্রিয় সরকারঃ একটি প্রতিক্রিয়া
কিছুদিন আগেই আমরা দেখলাম দুটি সরকারি প্রকল্প নিয়ে কাজিয়া। কোন সরকারের প্রকল্প বড় তা নিয়ে লড়াই উঠল তুঙ্গে - কন্যাশ্রী বড় না বেটি বাঁচাও বড়। সেই সুযোগে আমরাও দু’দলে ভাগ হয়ে সমর্থন করলাম যে যাকে পারি। লেগে পড়লাম তুলনামুলক বিচার বিবেচনায়। একবারও ভেবে দেখলাম না যে আমরা কেন এই কাজিয়ায় অংশগ্রহণ করছি। করছি, কারণ আমরা ভেবে নিয়েছি যে দেশের ও দশের অভিভাবক হল আমাদের সরকার। সরকার যখন দায়িত্ব নিয়েছে মেয়েদের উদ্ধার করার, তখন আর আমাদের চিন্তা কী? আমরা একবারও ভেবে দেখলাম না গণতান্ত্রিক সরকারের মাথায় থাকে শুধু ভোটের চিন্তা। সেটার জন্য যা করলে সুবিধা হবে, সরকার সেটাই করবে। তবে ভোটের আগে দু’চারটি ভালো ভালো কথা সকলের জন্যই বলতে হয়, হাজার হোক দেশ পরিচালনায় মেয়েদের আর কোন ক্ষমতা না থাক ভোট দেবার তো আছে!
আরও পড়ুনঃ জেন্ডারঃ কী বুঝি – বুঝি কি?