মাঝে মাঝেই আমাকে লোকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখন আমার বয়স ৫০ এর ওপর, বিবাহিত, এক বলিষ্ঠ পুত্রের জননী, খুব যে দেখতে আহামরি তাও নয়, হাঁটুতে বাত, কোমরে ব্যথা। এই দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভাবি আহা! এরকম যদি সত্যি হত? সত্যিই প্রেম নিবেদন করতো সুদূর সাত-সমুদ্র-তেরো-নদীর ওপার থেকে! কত কত উত্তম-সুচিত্রা প্রেম-কাহিনীও ধরাশায়ী হয়ে যেত আমার প্রেম-কাহিনীর সামনে।
আসলে ঘটনাটা তা নয়। ক্যানাডার বাসিন্দা হতে গেলে একটা ছোট্ট উপায় আছে। সেটা হচ্ছে, যদি তুমি কোন ক্যানাডিয়ান পাসপোর্ট-হোল্ডারকে বিয়ে করো, তাহলে তুমি সহজেই ক্যানাডায় প্রবেশ করতে পারবে। এ কথাটা আমি প্রথমে বুঝি নি। অনেক পরে আমার এক ছোট্ট বন্ধু মনে করিয়ে দিল, "আন্টি, ও তোমাকে প্রপোজ করছে না, ক্যানাডিয়ান পাসপোর্ট-হোল্ডারকে প্রপোজ করছে।" জেনে খুব হতাশ হলাম, মনে এখনও ভীষণ দুঃখ।
ক্যানাডায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে অনেকেই এটা অবৈধভাবে করে, এবং ক্যানাডিয়ান পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি (পি আর) পেয়েই ডিভোর্স দিয়ে দেয়। অল্প-বয়েসের ক্যানাডিয়ান ছেলেমেয়েরা এর জন্য বেআইনিভাবে অনেক টাকাও রোজগার করে। অল্প বয়েসের কেন? অনেক প্রাপ্তবয়স্ক-প্রাপ্তবয়স্কারাও এটা করেন। এটা বোধহয় ক্যানাডার ইমিগ্রেশনের সবচেয়ে বড় ছিদ্র।
আরও পড়ুন, প্রবাসিনীর চিঠি: অনেক হয়েছে, এবার চললাম টরন্টো থেকে কলকাতা, ট্রেনে করে
যাঃ! ছিদ্রটা ধরিয়ে দিলাম নাকি যারা আসার চেষ্টা করছে তাদের? কিন্তু তাদের বলি, বিয়ে করার চেয়ে সহজতর উপায় আছে। সেটা হচ্ছে নিজের যোগ্যতায় ইমিগ্রেশনের জন্য দরখাস্ত পাঠানো। জানি এখন ইমিগ্রেশনে অনেক কড়াকড়ি হয়ে গেছে, কিন্তু এটাই একমাত্র উপায়। অবৈধভাবে বিয়ে করে আসার অনেক ঝুঁকি। ধরা পড়লে পাঁচ বছরের জন্য ক্যানাডা থেকে বহিষ্কার, আর ইমিগ্রেশন ফাইলে কীর্তিকাহিনী নথিভুক্ত হয়ে যাওয়া আজীবন। ইমিগ্রেশন কর্তারা বিশেষভাবে পারদর্শী হন জাল বিয়ে শনাক্ত করায়। সুতরাং যারা এখনো পাত্রী-পাত্র খুঁজছে ক্যানাডিয়ান হওয়ার জন্য, তাদের বলি, কাউকে প্রেম নিবেদন করে বিয়ে করে ঝুঁকি নিয়ে ‘স্পাউস-ভিসায়’ যদি ইমিগ্রেশন-অফিসিয়ালদের চোখে ধুলো দিয়ে আসেও ক্যানাডায়, নাগরিকত্ব পেতে সেই ১,০৭৫ দিন থাকতে হবে, পরীক্ষা দিতে হবে, ইত্যাদি। আর ডিভোর্স পেতে দু’বছর।
তবে আমায় ছেড়ে দাও বাবা। একটি নিয়েই গলদ্ঘর্ম...আমি আর জাল বিয়ে করতে পারব না!
আর যাদের একটু যোগ্যতা আছে, তারা সরাসরি ক্যানাডিয়ান ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে দরখাস্ত পাঠাতে পারে, যেভাবে আমি এসেছিলাম বেশ কিছু বছর আগে, একা, ছোট একটা ছেলেকে নিয়ে। আমার কর্তা পরে এসেছিলেন। তখন অবশ্য ওয়েবসাইটও ছিল না। হাতে লেখা এক চিঠির উত্তর দিয়েছিল ক্যানাডিয়ান হাই কমিশন। তখন আমার র্যাশন কার্ডও ছিল না, না ছিল কোনো পরিচয়পত্র। আমাদের দেশে তখনও পরিচয়পত্র চালু হয়নি। তখনকার ইলেকশন কমিশনার টি এন শেষন তার অনেক পরে এলেন, আর আমি আসার আগে-আগে ভোটার কার্ড প্রবর্তন করা হল। সে ভোটার কার্ড হাতে পাওয়ার আগেই চলে এসেছিলাম।
না পরিচয়পত্র, না পাসপোর্ট। আমি নেই, ছিলামই না। সেখান থেকে পাড়ার কাউন্সিলরের দ্বারস্থ হয়ে র্যাশন কার্ডের জন্য দরখাস্ত। র্যাশন কার্ড নিয়ে পাসপোর্টের দরখাস্ত, মাঝে জুতোর শুকতলা ক্ষইয়ে ইউনিভার্সিটির চক্কর, সার্টিফিকেট তোলার জন্য। অ্যাত্ত মোটা ফাইল জমা করার চেষ্টা, প্রথমে ট্রেনে করে দিল্লী গিয়ে তারপর পায়ে হেঁটে হাই কমিশনের অফিসে জমা করার চেষ্টা। সেখানে ধাক্কা খেলাম, ফর্মগুলোই নাকি ভুল ছিল। তারপর কলকাতায় এক এজেন্সির দ্বারস্থ হয়ে বছর চারেক চক্কর কেটে আমি দরখাস্ত জমা করি। আমেরিকায় ৯/১১ হামলার জন্য সমস্ত ফাইল আটকে থাকে, এবং তার সঙ্গে আমার ফাইলও আটকে পড়ে। তাই তার পাঁচ বছর পর আমার পিআর ভিসা হাতে আসে।
এখন তো অনেক সুবিধে হয়ে গেছে। কাগজপত্র স্ক্যান করো আর ওয়েবসাইটে আপলোড করো। ব্যাঙ্কের নথিপত্র অনলাইন আপলোড করো। কয়েক মাসের মধ্যেই ইমিগ্রেশন হয়ে যাবে। তখনকার দিনে পায়ে হেঁটে পাড়ার দোকানে কাগজপত্রের কপি করিয়ে, এজেন্সি বা পোস্ট-অফিসে গিয়ে রেজিস্টার্ড পোস্ট করতে হতো। বাসে করে টাইপিস্টের কাছে গিয়ে বসে থেকে অ্যাপ্লিকেশন টাইপ করাতে হত। না ছিল কম্প্যুটার, না স্ক্যানার। এখন ভাবা যায়?
কেষ্ট পেতে গেলে কষ্টকে কি বাদ দেওয়া যায়? তা না পারলে দেশেই থাকা ভাল। আমি যখন এসেছিলাম তখন দেশের অবস্থা ভাল ছিল না। আমার ছেলে নিতান্ত সাধারণ ছাত্র। দেশে সাধারণ ছেলেমেয়েদের কোন স্থান ছিল না। সবাইকে হতে হবে এক্সেলেন্ট! তাই পালিয়ে এসেছিলাম। একটু সাধারণত্বর খোঁজে, একটু শান্তির আশায়, সবসময় ধরপাকড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে, একটু নির্বিঘ্নে বাকি জীবনটা কাটাবো বলে। এখন তো দেশের অবস্থা অনেক ভাল। পড়াশোনার অনেক পছন্দমতন বিকল্প। এখন যে ছেলেমেয়েরা কেন দেশ ছাড়তে চায়, কে জানে।
আরও পড়ুন, প্রবাসিনীর চিঠি: কানাডায় ইউথেনেসিয়া
যাই হোক, তার জন্য যে বিধিসম্মতভাবে, দুটো দেশকেই সম্মান করে, এক দেশ থেকে এসে আর এক দেশে বসবাস করার চেষ্টা করছি, তার মানে এই নয় যে আমি ভারতীয় কোন অংশে কম। ‘জন-গণ-মন’ তে যেমন আমি উঠে দাঁড়াই, ‘ওহ ক্যানাডা’ তেও তেমন দাঁড়াই। আমি এখন দুই মায়ের সন্তান।
ক্যানাডায় এসো, তবে বুঝে এসো। হাঁ-হাঁ করে ডলার বানাতে এসো না। টাকা রোজগার করা যতটা শক্ত, ডলার বানানোও ঠিক ততটাই শক্ত। তার ওপর এখানে বুঁচির মা নেই, মন্টু নেই, ইস্ত্রিওয়ালা নেই, ড্রাইভার নেই, পাড়ার চায়ের দোকান নেই, আড্ডা নেই, অটো নেই, রিকশা নেই, রোলের দোকান নেই, আর সবচেয়ে বড় কথা, ফুচকা নেই! কেরিয়ার, শিক্ষা সব ফেলে রেখে আসতে হবে। কিছুই কাজে লাগবে না প্রথম প্রথম। রেস্তোরাঁয় ঝাড়ু দিতে হবে, গ্যাস-স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকার কাজ করতে হবে, পুজোর ছুটি নেই, মা-মাসিরা নেই, সব নিজেকে করতে হবে – জুতো সেলাই থেকে রান্না করা থেকে গাড়ি ধোওয়া, জামা ইস্তিরি, বরফ কাটা, বাচ্চা সামলানো। সব কিছু। পিঠে ব্যথা, মাথায় ব্যথা, জ্বর, কোন কিছুতেই ছাড় দেবে না জীবন। কাজ করতেই হবে।
অনেকেই শুধু ডলার বানাতে আসে। আর আসা থেকেই যেন নিজেদের অতীত ভোলার চেষ্টায় থাকে। হয় দেশে তেমন কামড় দিতে পারেনি, তার জন্য, না কী, এখানে এসে তেমন কামড় দিতে পারছে না, তার জন্য, অনেকেই নানা হীনমন্যতায় ভোগে। যার ফলে কথায় কথায় বাড়ি-গাড়ি আর যেটুকু সম্পত্তি এখানে করেছে, ফলাও করে সে কথা জাহির করতে থাকে। তাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে কথা বলা মুশকিল। দেখা হলেই শুরু করে কবে ক্যানাডায় এসে সে প্রথম বাড়ি কিনেছিল, কবে দ্বিতীয় বাড়ি, কবে তৃতীয়। এখন তার বাড়িতে কটা বেডরুম, কার ছ’টা, কার ন’টা, কার ক’টা গাড়ি গ্যারেজে। গ্যারেজে জায়গা হচ্ছে না, রাস্তায় গাড়ি রাখতে হচ্ছে, এত গাড়ি! বরফ কাটতে হচ্ছে, অবশ্য এখন বরফ গলার নানা কেমিক্যাল ছড়িয়ে দেওয়া যায়... যত কথা ঘোরানোর চেষ্টা করি, সেই ঘুরেফিরে একই প্রসঙ্গ।
মহা বিপদ! ভাবলাম বাঙালিদের মধ্যে বোধহয় তেমন কোন ব্যাধি নেই। তাদের ভাণ্ডারের তল তো অনেক গভীরে। সাহিত্য থেকে রাজনীতি, সিনেমা-গান থেকে ফুটপাথের খাবার, কলকাতার কড়চা থেকে লেকে প্রথম প্রেম, রবীন্দ্রনাথ থেকে কলেজ স্ট্রীট বইপাড়া, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কফি-হাউস, তোলপাড় করা তো বাঙালির ঐতিহ্য এবং কথা বলার প্রসঙ্গ। সেখানে নিশ্চয়ই গন্ডগোল হবে না। ও বাবা! প্রথম বাঙালি বাড়ির নেমন্তন্নে গিয়ে সাত রকমের স্টার্টার আর বাসন-কোসনের বহর দেখে চক্ষু ছানাবড়া! আর কথা সেই সম্পত্তি প্রসঙ্গেই। কে কত সম্পত্তির মালিক এখানে। শুধুই সম্পত্তি। শুধুই গাড়ি। শুধুই গ্যারেজ। শুধুই কার ছেলে কত মহান পড়াশোনায়। ছোটবেলা থেকে শুনেছিলাম নিজেকে জাহির করতে নেই। "লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়"। নিজের যা আছে অত বলতে নেই। লোকের নজর লেগে যায়। এখানে দেখি উল্টো, নজর কাড়ার প্রচেষ্টায় বাঙালিরা নিত্য নিজেদের ভুঁড়ি বাজায়।
ভারতে নিশ্চই গিজগিজ করে এমন চাল মারা লোকজন, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি মানুষ মধ্যবিত্ত মানসিকতার। বিনয়ী। অনেক পয়সা আছে, কিন্তু সাধারণ জীবনযাপন করে। ধরাছোঁয়ার মধ্যে। বিদেশে আসতে গেলে বোধহয় বড়লোক মানসিকতা হওয়ার শর্তটা অপরিহার্য্য। সেটা আছে কিনা ভেবে নিও। বিদেশে কত সু্যোগ, সেটার সদ্ব্যবহার করে কিছু করে দেখানোর মানসিকতাটাই আজব।
এসব দেখি আর ভাবি, এরকম পরিবেশে কি ওই আজব মানসিকতার কাউকে পাবো? একই জন্মে দুটো দেশের নাগরিক, কী বিরাট সুযোগ, সেটার সদ্ব্যবহার করে দু-দেশের কাজে যদি কোনভাবে লাগা যায়, এটা কি কেউ ভাবে না? অনেক পেয়েছির ভারে ধরাশায়ী ঋণী আমি ওই আজব মানসিকতা নিয়ে কিন্তু প্রতিনিয়ত দুই পৃথিবীর মাঝে সাঁকো বাঁধার চেষ্টা করি।