হ্যারি পটারের শেষ অঙ্কে স্নেপের মৃত্যু-মুহূর্তে স্নেপ হ্যারিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে, “টেক ইট... টেক ইট...”।
হ্যারি একটা টেস্ট-টিউবে করে স্নেপের চোখের জল খানিকটা নিয়ে নেয়। তারপর সেটা পেন্সিভ ডিশে ফেলে হ্যারি দেখতে পায় স্নেপের সম্পূর্ণ জীবন কাহিনি। তার ব্যথা, বেদনা, তার ভালোবাসা, তার বুদ্ধি, তার ন্যায়বোধ, নীতি, সব কিছু। যাঁরা হ্যারি পটার নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা জানেন উপন্যাসটা প্রযুক্তিগতভাবে কতটা এগিয়ে। যা কল্পনা, প্রযুক্তি তার ধারে-কাছে পৌঁছোতে পারবে কিনা আগামী কয়েক শতকে তা বিচারাধীন।
ব্রেন-ম্যাপিং বলে একটা বিষয় আছে। মানুষের মস্তিস্কের ম্যাপিং এর শাস্ত্রীয় এবং তাত্ত্বিক গবেষণা । সাইকোলজির নানান দিক আছে মানুষের মনের গবেষণা করার জন্য। কিন্তু তা মানুষ বেঁচে থাকতে থাকতে। কোন প্রযুক্তি আজ অবধি ঘোষণা করা হয়নি যা দিয়ে মানুষের মনের কথা একটা পেন-ড্রাইভে তুলে নেওয়া যায়, হার্ড-ডিস্কে রেখে দেওয়া যায়, মানুষ মারা যাওয়ার অনেক, অনেক বছর পর পর্যন্ত।
অতি সম্প্রতি আমার এক সহকর্মীকে হঠাৎ হারালাম। হতাশায় বেকুব বনেছিলাম। তার মৃত্যু আমাকে এক বিরাট প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। মানুষ কোথায় যায় মারা গেলে? তার সাংবাদিকতার এবং লেখার এই বিশাল জীবন, এতো বিদ্যা, সারা জীবনের এতো জ্ঞান, এতো অভিজ্ঞতা, এতো বিচার, বিবেচনা, তত্ত্বকথা, মতামত, সব কি ধুলিসাৎ হয়ে গেল এক নিমেষে? সব শেষ? তার অভিজ্ঞ মস্তিষ্কের এবং সর্বদা হাসির কিছুটা অংশ রেখে দিলে পরের প্রজন্মের অনেক অনেক কাজে লাগতো। কিন্তু আমরা তা করতে পারলাম কই?
কী করে শেষ হয় এরকম চাবুকের মতন প্রাণ? ফেসবুকে এমন প্রশ্ন রাখাতে সবাই আমাকে বোঝালো এনার্জি, অর্থাৎ, মানুষের তেজ মিলিয়ে যায় পাঁচ স্তরে। তার পর রিসার্চ করে জানলাম, প্রথমে প্রাণবায়ু (Prana Vayu) বেরিয়ে যায়, যেটা ডাক্তাররা বলেন, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস। হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। তার পরে সমানবায়ু (Samana Vayu) নির্গত হয়। সমানবায়ু মানুষের শরীরের সমানতা, অর্থাৎ তাপমাত্রা ও তেজের ভারসাম্য বজায় রাখে। মাথা থেকে পা অবধি। সেটা নির্গত হতে শুরু করলে মানুষের শরীর ক্রমে ঠান্ডা হতে থাকে। এরপর আপনবায়ু (Apana Vayu), অর্থাৎ জ্ঞানেন্দ্রি়য়, তারপর উদানবায়ু (Udana Vayu) যার দ্বারা কুন্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হয়, এবং Vyana বায়ু (যেটার বাংলা অর্থ কোথাও পেলাম না), যেটা স্নায়ুতন্ত্রের রক্ত এবং সচেতনতা সঞ্চালন নির্দেশ করে। ক্রমেই এই পাঁচ বায়ু নির্গত হয় দেহ থেকে। মানুষ মারা যায়।
উফ! এটা রিসার্চ করতে এবং লিখতে গিয়ে আমার প্রাণবায়ু নির্গত হবার উপক্রম!
কিন্তু, সবই তো বুঝলাম। এটা তো বিজ্ঞান, বা পুরাণের কথা। কিন্তু বিজ্ঞান তো হৃদপিণ্ডর কথা বলছে। হৃদয়ের কথা কই? তার মনের কথা কোথায় যায়? তার সারা জীবনের স্মৃতি, দুঃখ, কান্না, বেদনা, অভিমান, ভালবাসা, গোপন কথা কোথায় যায়? আত্মা তো জানি অবিনশ্বর। এক শরীর থেকে আর এক শরীরে প্রবেশ করে। শাহরুখ খানের “ওম শান্তি ওম” এর মতোন একজন মরলো আর সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মা পাশের বেডের বাচ্চার শরীরে হাতের উল্কি-টুল্কি নিয়ে প্রবেশ করল, এমন হয়তো নয়, কিন্তু অনেক তর্ক-বিতর্ক এবং অনেক জাতিস্মর ভিডিও দেখার পর আমার ধারণা হয়েছে যে মানুষের পুনর্জন্ম আছে। কে জানে? বিজ্ঞান তো স্বীকার করে না। কিন্তু বিজ্ঞান তো একসময় পৃথিবী ‘গোল’ তাই মানতোনা। বিজ্ঞান আজও বিধাতাকে মানেনা। প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্টিফেন হকিং তো বলেই গেলেন মারা যাওয়ার আগে যে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হওয়ার পিছনে কোন মহা-শক্তির হাত নেই। এমনি এমনিই হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁরা যা প্রমাণ করতে পারেননা, তা মানেন না।
আর পরজন্ম প্রমাণ করা হইনি এখনো অবধি। তাই আমরাও জানিনা। জেনেই বা কী লাভ। সবাই তো আর জাতিস্মর হয়না। “নায়ক” ছবিতে উত্তম কুমার যেমন বলেছিলেন, “আমি যে আমিই হচ্ছি পরজন্মে, সেটা জানবো কি করে?” তাই যাগ্গে। এসব ভেবে লাভ নেই। “আনন্দ” এ রাজেশ খান্নার মতন ভাবি বরং, “মেঁয় হি নহিন রহুঙ্গা তো মুঝে ক্যায়া ফরক্ পড়েগা?”
কিন্তু তাও ভীষণ রাগ হয়। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ওপর রাগ হয়। মান্না দে-র গান টা ভাবি। “হৃদয়ে লিখো নাম সে নাম রয়ে যাবে...” ধুস! হৃদয়ে লিখে কী হবে? হৃদপিণ্ড তো শরীরের সাথে পুড়ে যাবে, বা মিশে যাবে মাটির সঙ্গে। কে মনে রাখবে? বরং পাথরে লেখ নাম, কাগজে, অর্থাৎ ইন্টারনেটে কোথাও লিখে রাখো সে নাম, বা মনের কথা, সে নাম রয়ে যাবে।
কে জানে, একদিন হয়তো এমন প্রজন্ম আসবে যারা আমার এই লেখা পড়ে বলবে, “সে কী? ২০১৮ সালেও মানুষ পরজন্মে যাতায়াত করতে পারেনি?”, “হৃদয়ের কথা দান করে যেতে পারতো না?” বা, “ধ্যাৎ, কী অশিক্ষিত ছিল লোকজন! ঈশ্বর যে আছে কি না তা নিয়ে তর্ক করছে।” যেমন আমরা বলি এখন, গ্যালিলিওর সমাজ কতটা বোকা ছিল, যে উনি পৃথিবীটা ‘গোল’ বলছেন সেটা মানতেই পারছিলনা।
আমি জানি আমি কী করছি। আমি মহাশূন্যের বুকে এই লেখাটা লিখে রাখছি, যা হয়তো থেকে যাবে। আমি থাকবনা, সেটা নিশ্চিত।
মানুষ সবার থেকে নশ্বর। সব কিছু থেকে। আমাদের ডিজাইনার জামাকাপড়ের থেকেও নশ্বর, আমাদের লেটেস্ট আইফোনের থেকেও নশ্বর, আমাদের গেজেট-গয়নার থেকেও ক্ষয়শীল, মায় আমার যে স্টিলের বাসনগুলো আছে তারাও থেকে যাবে, আমি থাকবোনা। আমাদের ফ্রিজে ১০ বছরের গ্যারান্টি আছে, জীবনে নেই। মৃত্যু এলে কোন ডাক্তার-মোক্তারের বাবার ক্ষমতা নেই তাকে রোকার। যতই ট্রেডমিলে দৌড়ও, যতই ফোঁসফাঁস করে প্রাণায়াম কর, যতই অর্গ্যানিক খাও, মৃত্যু এলে তাকে ঠেকাতে পারবেনা।
কি ফ্রাস্ট্রেটিং!
অর্থাৎ, যা লোন নিয়েছ তুমি প্রকৃতি থেকে, তোমার শরীর, মন, তেজ, সব কিছু, তা তুমি চাও বা না চাও, প্রকৃতিকেই ফেরত দিতে হবে তোমার সময় যখন ফুরিয়ে যাবে। কি ভয়ঙ্কর! আমাদের জীবন আমাদের নয়, প্রকৃতির। অথবা, যারা ভগবান বিশ্বাস করেন, ভগবানের।
তাহলে মানুষের কি কিছুই করার নেই? এতো প্রযুক্তির ফলে যে জ্যান্ত মানুষ মঙ্গলগ্রহে নামাতে চলেছে, তার ক্ষমতা নেই মানুষ জ্যান্ত থাকতে-থাকতে তার এতো বিচার, জ্ঞান, এতো বুদ্ধি, এতো ভালোবাসা, এতো বিদ্যা, এতো সম্পর্ক, তার আত্মকথা, এতো স্মৃতি, দুঃখ, জ্বালাযন্ত্রণা, মান, আভিমান, আশা-ভরসা, অর্থাৎ যা বিজ্ঞান চোখে দেখতে পায়না, সেটা পারেনা একটা কম্প্যুটারে ভরে রাখতে? বা দান করে যেতে? যেটা পরের প্রজন্ম যখন খুশি ফ্লাশব্যাক মতন চালাবে আর সিনেমার মতন দেখতে পাবে?
ফেসবুকে ছোট্ট করে তার খানিক প্রচেষ্টা আছে, সেটা এখন মানতে বাধ্য হচ্ছি। তবে হয়তো ফেসবুক নিজেই জানেনা তার মাহাত্যটা মানবজাতীর ওপর। মার্ক জুকারবার্গ তো খালি তার মুনাফা দেখে। আর হ্যাকাররা বসে থাকে কখন কাকে ধরে তার ব্যাঙ্ক থেকে পয়সা লুটবে বলে। আরে, হ্যাকারগণ! তোরা থাকবিনা, তোদের কাল-কর্ম থেকে যাবে। লক্ষ মানুষের অভিশাপ থেকে যাবে, কি বোকা তোরা!
আমরা ফেসবুক-কে, ইন্সটাগ্রাম-কে, গুগল ড্রাইভ-কে নিজের পার্সোন্যাল ডাইরির মতোন ব্যাবহার করি। এটা কিন্তু এক দিক থেকে একটা অভুতপূর্ব অবদান এই নশ্বর মানবজাতির প্রতি। আমাদের সব চিন্তা, ভাবনা, বিচার, বিবেচনা, ছবি, ভিডিও সব কিন্তু আমরা ব্যোমে, অর্থাৎ ঈথারে অন্তর্গত করে যাচ্ছি আমাদের নিজেদের অজ্ঞাতে। পরের প্রজন্মের সার্থে । আমরা থাকবনা, ঈথারে আমাদের নাম রয়ে যাবে। তবে এতো বিরাট জীবন, এতো অভিজ্ঞতা; কেউ যদি লিখতে না চায়, কেউ যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু না পোস্ট করে, তো সব শেষ?
এ তো মানা যাচ্ছেনা। আমার লেখা জানিনা কোন প্রযুক্তি-বৈজ্ঞানিকের নজরে পড়বে কি না, তবে আমরা হ্যারি পটারের সেই পেন্সিভ চাই, যাতে আমাদের সমগ্র স্মৃতি, সব জ্ঞান, সব অনুভূতি কয়েদ করে রাখতে চাই। একটা চিপ লাগিয়ে সারা জীবনের সব স্মৃতি ধরে রাখতে চাই কোন একটা হার্ড ডিস্কে। সিনেমার মতন, যেমন ভাবে আমাদের মনের পটছায়ায় দেখতে পাই যখন চাই, সেরকম ভাবে দেখব, যখন ইচ্ছে। দান করে যাবো যাকে ইচ্ছে। এটা আমার বায়না। আমি থাকবনা একদিন, আমার বায়না রেখে গেলাম মহাশূন্যে।
পুনশ্চঃ এই লেখাটি আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু, ভাই এবং সহকর্মী, জাপান কনস্যুলেট জেনারেলের রাজনৈতিক বিষয়ক কর্মকর্তা, হিন্দুস্থান টাইমস এবং স্টেটস্ম্যানের অত্যন্ত খ্যাতনামা সাংবাদিক, সাম্প্রতিককালে বাংলানাটক ডট কমের সাথে জড়িত, ভাস্কর নারায়ণ গুপ্তর উদ্দেশে উৎসর্গ করলাম। গত শনিবার, জানুয়ারি ১৩, ২০১৯, মাত্র ৪৮ বছর বয়েসে তার আকস্মিক এবং অকালপ্রয়াণে সাংবাদিক মহল গভীরভাবে শোকার্ত এবং মুহ্যমান।