Advertisment

দেশের তপ্ত কড়ায় ক্যানাডাকে একটু সেঁকে নি বরং

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Letter from Canada

অলংকরণ- অরিত্র দে

আমাদের আই ই বাংলা পোর্টালে একটা খবর চোখে পড়ল। তাতে লেখা হয়েছে,

Advertisment

কিছু বছর আগে বইমেলা কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতার অভিযোগ তুলে, বাংলা স্টলে ইংরেজি নাম লেখা হচ্ছে বলে যাঁরা মারমুখী হয়ে ঘুরে বেড়াতেন, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুমধুর সম্পর্কের সুবাদে তাঁরা মঞ্চালোকে।

পড়েই খুক-খুক করে হাসি পেল। যে বাংলায় এতো সংকোচমুক্ত, বৃহৎ মনের মানুষের জন্ম হয়ে গেছে, সেই বাংলা আজ ছাপোষাতে ভরে গিয়েছে, আর সে ছাপোষারা কথায় কথায় ‘গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল’ হয়ে ঝান্ডা নিয়ে সারাক্ষণ সাধারণ মানুষকে চমকে বেড়াচ্ছে। কলসির তলায় কয়েক ছিটে জ্ঞানের গন্ধ নিয়ে ভাবছে গোটা বাংলা সাহিত্যের ভার তাদের কাঁধে। ওরে মুর্খ! কী এসে যায় বাংলা স্টলে দুটো কথা ইংরেজিতে লিখলে? তাতে কি বাংলা সাহিত্যের মান কমে যায়? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, স্বয়ং বিভূতিভূষন তাঁদের সাহিত্যে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যাবহার করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তর প্রথম লেখা ইংরেজিতে ছিল, যদিও পরবর্তী কালে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে প্রচুর কাব্য-গ্রন্থ রচনা করেছেন। “হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন...” তাঁরই লেখা। কেউ বাংলাকে অবহেলা করতে পারবেনা। বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার এতই গভীর যে তার তল খুঁজতে গেলে কয়েক জন্ম লেগে যায়। যারা বুঝেছে, তারা বুঝেছে। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে। যারা বোঝেনা, তারা মুর্খ, তাদের বোঝানোর ভার নাহি তোমাদের ঘাড়ে, ওরে ভীরুর দল! তোরা থাম!

কলকাতায় বই-মেলা শুরু হয়ে গেছে, বোধহয় শেষের দিকে। এদিকে বিতর্কপুর্ণ বাজেট, মমতার ধর্না আর তপ্ত নির্বাচনের হাওয়া! এই গরম তাওয়ায় এখন মনে হচ্ছে ক্যানাডাকে একটু সেঁকে নিলে কাজ দিত। এদিকে তো ভেতো বাঙালীগুলো যে শৈত্যবীর-বীরাঙ্গনা হয়ে উঠছে নিত্য শৈত্যপ্রবাহের সাথে লড়াই করতে করতে। মাইনাস ৪২ সেলসিয়াস থেকে মাইনাস ১০ এর মধ্যে আসন্ন হিমযুগ লোফালুফি করছে মাছে-ভাতে বঙ্গবাসীদের! দেশের কি কারুর মনে কোন দয়া নেই?

আরও পড়ুন, আমার বইবেলা

এটা বলতে দ্বিধা নেই যে হিমযুগের হাওয়া ক্রমেই ক্যানাডাকে গ্রাস করে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। পোলার ভোর্টেক্স একদিকে ওন্টারিওকে ভাসিয়ে দিচ্ছে সাদা বরফে, অন্যদিকে ভ্যাঙ্ক্যুভারে সবুজ মাটিতে ফুল ফুটছে। সত্যি! তাপমাত্রা সেখানে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জানুয়ারিতে বসন্তের হাওয়া। অন্য আর এক দিকে রেজিনা এবং ক্যালগ্যারিতে হিমবাহর উৎপাতে তাপমাত্রা মাইনাস ৪২; ওপরের তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ এর বেশি ঊঠছেনা। রেজিনাতে খোলা ত্বক কয়েক মুহুর্তের মধ্যে নিথর হয়ে যেতে পারে, যাকে বলে ‘ফ্রস্টবাইট’।  বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, ক্যানাডার এই চরম আবহাওয়া কোন ব্যাতিক্রম নয়, নতুন নিয়ম হতে পারে, সরকারের প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। এবার কি করা যায়? দেশে গরমে টিকতে পারছেনা, এখানে ঠান্ডায়। যাবেটা কোথায় বাঙালী?

আর্ক্টিক গলতে শুরু করার ফলে সারা বিশ্ব প্লাবিত হবে চরম গরমে। ক্যানাডায় তা শুরু হয়ে গেছে। পোলার ভোর্টেক্সের দরুন একটা “ওয়েভিনেসস” তৈরি হচ্ছে যাতে ঠান্ডা ক্রমশ আরও দক্ষিণ ও মধ্য ক্যানাডার দিকে যেতে পারে এবং উপকূল বরাবর উত্তরে উষ্ণ বাতাস চলতে পারে।

একমাত্র ভরসা ঘরের মধ্যে, গাড়ির মধ্যে, শপিং মলের মধ্যে, অফিস-কাছারিতে, সর্বত্র যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত, যার জন্য এখনও লোকে ক্যানাডায় থাকতে পারছে । তা না হলে, এখানে কয়েক সেকন্ডের মধ্যে ত্বক ফ্রিজ করে যায়। যেখানে ক্যানাডার বা আমেরিকার মতন উন্নত দেশে মানুষ বাইরে ঠান্ডায় জমে মারা যায়, সেখানে তো ছ’মাস তুষারযুগে প্রবেশ করে থাকা মানে তো সারাক্ষন বুক দুর-দুর করা। একমাত্র বিদ্যুৎ ই আশা-ভরসা। ছ-মাস তো সার্ভাইভাল মোডে। একটা পায়রা আমার বারান্দায় বছর কয়েক আগে ফ্রিজ করে মারা গেছিল। ভয়ঙ্কর মর্মাহত হয়েও সেই আমাকেই তার মৃতদেহর সৎকার করতে হয়েছিল। আর কে করবে? সেই যে ‘ঠক’ করে আওয়াজ হয়েছিল দেহটা জঞ্জালের বাক্সে পরার সময়, সেই আওয়াজটা এখন আমার কানে বাজে। ঠান্ডায় ফ্রিজ করে শুধু পাখিরা মরছেনা, মানুষও মারা গেছে প্রচুর। আমেরিকা-ক্যানাডা মিলে প্রায় ২০ জন মানুষ মারা গেছে এই এক শীতে। এতো উন্নত দেশে, এতো যেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত, এতো যেখানে কড়াকড়ি, সেখানে মানুষ ফ্রিজ করে মারা যাচ্ছে, এটা কি করে মেনে নেব?

কেনই বা নেবনা? দেশে থাকতে কি শীতে বা অত্যাধিক গরমে মানুষ মারা যেতে দেখিনি, বা শুনিনি? এখন এই গরম দেশে আরো প্রবল হচ্ছে। ঠান্ডা আরো প্রবল হচ্ছে। ভৌগলিক উষ্ণতার গহ্বরে আমরা কিন্তু আক্ষরিক অর্থে প্রবেশ করে গেছি। গ্লোবাল ওয়ারমিং আসছে না, এসে গেছে। প্রতিদিন, প্রতি বছর একটু একটু করে আমাদের গ্রাস করছে।

শয়ে শয়ে। কিছু মানুষ মরছে, সুনামি, ভুমিকম্প, আগ্নেয়গিরির জেরে কিছু কিছু প্রাদেশ ধ্বংস হচ্ছে। আবার সব সয়ে যাচ্ছে। এইভাবেই পৃথিবী তার ভারসাম্য বজায় রাখছে। আমাদের কিছু করার নেই। কবিগুরুর গানটা মনে পড়ে? “তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার, ওরে ভীরু! হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার, ওরে ভীরু!” হালের কাছে মানে, কালের কাছে। কালের কাছে মাঝি আছে, আমরা বেঁটে বেঁটে হাত দিয়ে ছটফট করে নৌ বাইবার চেষ্টা করলে কি আর খুব একটা কিছু হবে? যা ধ্বংস করার তো করে ফেলেছি। এখন শুধু কালের ফলাফলের প্রতীক্ষা!

যা আজ তুমি ভাবছো, কবিগুরু তা ভেবে গেছেন শত বর্ষ আগে। সুতরাং, ভাবনা ছেড়ে বরং পুবের ওই লাল আকাশের রঙ দেখো চেয়ে। আমাদের প্রিয় ট্রাম্প ঠিকই বলেছেন --- গ্লোবাল ওয়ারমিং নেই-ই! সব ভাঁওতা। ফেক্‌ নিউজ। সত্যকে অস্বীকার করার মতন আরাম আর কিছুতে নেই। শান্তিশিষ্ঠে অফিস থেকে বেড়িয়ে প্রচন্ড তুষারপ্রাতের মধ্যে বরফে ঢাকা পিচ্ছিল হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরেই স্যাঁতস্যাঁতে শরীর-মন গরম হয়ে ওঠে। কারণ? দেশের কড়াইয়ে তেল সব সময় ফুটছে! ভারতীয় খবরের চ্যানেল চালালেই হল। মোদী কি করল! আবার মমতা ধর্না দিল! এই যাঃ! রাহুল আবার কি সব বলেছে!

এই রে! দেশে মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙ্গে গেল!

এই কোথায় ট্রেন উলটে যাচ্ছে, এই বাগরী মার্কেটে আগুন!

এই ক্রিকেট!

ও মা! বিজয় মালিয়াকে ধরল শেষবেশ! এবার দাউদ?

সর্বক্ষণ গরম হাওয়া। হোয়াটসঅ্যাপে সঙ্গে সঙ্গে খবর চালাচালি। মধ্যরাত অবধি কথাবার্তা।

ক্যানাডার খবর তো প্রায় নেই-ই, যেটুকুন আছে, তাতে বাঙালীর মন গরম হয় না।

একে তো মাঝরাতে “গুড মর্নিং”এর এত্ত এত্ত মেসেজ, ছবি, তত্ত্বকথা আসে আমাদের ওয়াটসায়াপে, তার ওপর দেশের খবরের হাওয়া ক্রমেই গরম হতে থাকে যত বেলা বাড়ে। মেসেজেরও শেষ নেই। শেষকালে, নাঃ, কাল আবার ভোরে ওঠা, ওই বরফে গাড়ির থেকে বরফ ঝেরে, চেঁচে ফেলা, আবার ওই হড়হড়ে হাইওয়ে দিয়ে অফিস যাওয়া। নাঃ, ঘুমোতে যাই, বলে ক্যানাডিয়ান ভারতীয়রা তাদের টিভি বন্ধ করে শুতে যান। কিন্তু দেশের এই উত্তাপ আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। অবশ্যম্ভাবী সত্যকে ভুলিয়ে রাখে। স্যাঁতস্যাঁতে মন সেঁকে নি দেশের আঁচে। ভারতের উষ্ণতায় আমরা উষ্ণিত হই রোজ রোজ!

Advertisment