ন’বছর দেশান্তরী থাকার পরে যখন আমি আবার কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনি, প্রথমেই আমার প্রোমোটারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "ফ্ল্যাটের ছাদ আছে?"
প্রোমোটার অবাক হয়ে বলেছিলেন, "কেন থাকবে না? বিরাট ছাদ! সবাই ব্যবহার করতে পারে।"
আসলে আমার মাথার ওপর ছাদ নেই। কলকাতা থেকে বেরিয়ে এসে বুঝেছিলাম ভারতে ছাদের যেরকম সম্মান, পৃথিবীর আর কোথাও তা নেই। আর কলকাতার ছাদের ঐতিহ্য তো সম্পূর্ণ আলাদা। এই ছাদেই কাটতো জীবন - ঘুড়ি ওড়ানো, কাপড় মেলা, ফুলের বাগান করা, আচার শুকোনো, বড়ি দেওয়া, গরমের রাতে ছাদে শোওয়া, ছাদে বৃষ্টিতে ভেজা, পাশের বাড়ির ছেলের সাথে লুকিয়ে প্রেম করা, ডায়েরি লেখা, ছাদের পাঁচিল ভিজিয়ে কাঁদা - ছাদ তখন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল বাঙালি জীবনে। নেড়া ছাদ, অলঙ্কৃত পাঁচিল-ঘেরা ছাদ, ফুলবাগানের ছাদ, লাগোয়া ছাদ, পরের দিকে পেন্টহাউস, সমাজের মুল সাক্ষী হিসেবে থেকে গেছে ছাদ।
অথচ, ভারতের বাইরে, বিশেষ করে পশ্চিমি দেশগুলোতে, ছাদের কোন তাৎপর্যই নেই। সব বাড়ির মাথায় টোপর বসানো। কী করে ছাদ থাকবে? বছরে ছ’মাস তো ঠান্ডা, বরফ। ছাদ থাকলে বরফ জমে, জমে, দুম করে একদিন মাথায় ছাদ ভেঙ্গে পড়বে আক্ষরিক অর্থে। তাই নানা রঙের টোপর বসানো, যাতে বরফ ঝরে বা গলে পড়ে যায়। মাঝখান থেকে আমাদের মতো বাঙালিরা, যারা দেশের বাইরে অহরহ দেশকে খুঁজতে থাকে, তাদের মনে ভীষণ দুঃখ - আমাদের মাথার ওপরে ছাদ নেই!
আরও পড়ুন: ক্যানাডায় মন ভরিয়ে দিল ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’
জীবনের অধিকাংশটা সময়ে এই ছাদেই কেটেছিল আমার শৈশব ও কৈশোর। শৈশবে মামার সাথে লাটাই ধরে ঘুড়ি ওড়ানো, নেড়া ছাদের আলসেতে বসার জন্য মার খাওয়া, বিকেলে ছাদে কেটে পড়ে থাকা ঘুড়ি ধরে জমানো, ঘুরে ঘুরে বিটনুন দিয়ে পেয়ারা খাওয়া আর ছাত্র ভেবে ফুলের টবগুলোকে পড়াশোনা করছে না বলে ঝাঁটার কাঠি দিয়ে পেটানো, এই ছিল আমার শৈশব। কৈশোরে এই ছাদেই আমার সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু। ভোরবেলা খোলা আকাশের নিচে খাতা নিয়ে আমার লেখা শুরু। যৌবনে ছাদেই প্রথম প্রেম এবং ছাদেই সে প্রেমের ইতি। ছাদ আমার অনেক চোখের জলের সঙ্গী।
সেই ছাদ থেকে নেমে যেদিন রাস্তা ধরলাম, সে পথ চলতেই থাকল, চলতেই থাকলাম। আজ জীবনের অপরাহ্নে আবার সেই ছাদের সন্ধান করছি। বিদেশে না হোক, কলকাতায় আবার আমি ছাদ পেয়েছি।
ক্যানাডা, যেখানে জেনেশুনেই বেলাশেষে ঘর পেতেছি, ঠান্ডার দেশ। এখানে গরমকাল সীমিত। বিকেলে গা ধুয়ে ছাদে হাওয়া খেতে গেলে মুহূর্তের মধ্যে বরফে কাঠ হয়ে নেমে আসতে হবে। এখানে বিকেল নেই বছরের ছ’টা মাস। সোজা দুপুর থেকে সন্ধ্যে। বিকেল চারটেতেই সূর্য ডুবে যায়। রাত শেষ হয় বেলা আটটায়। আবার একছিটে গরমকালে দিন-ই-দিন। ভোর চারটে থেকে রাত সাড়ে-ন’টা অবধি সূর্যের আলো। ছাদ, বস্তুত, শুধুই মাথার ওপড় একটা কংক্রিটের বা কাঠের আচ্ছাদন। তার বেশী কিছুই নয়। তাই বিকেলবেলা ছাদে বেড়ানোর অভ্যেস ত্যাগ করার সাথে সাথে মনের কতগুলো জানলাও বন্ধ করতে হয়েছে। অন্তবিহীন ছাদের সাথে মনের স্বাধীনতা, মনের বিকাশের যে সম্পর্কটা ছিল, তা ঘাপটি মেরে গেল। ছাদ মানুষকে অনেক উদার করে দেয়, সেই মনটা অনেক সংকীর্ণ, জরাজীর্ণ হয়ে গেছে।
শুধু ক্যানাডাকে দোষ দিয়ে কী লাভ? কলকাতায় কি আজকাল ছাদের খুব একটা তাৎপর্য আছে? আজ যেখানেই দেখো, মানুষ খালি ছুটছে। দুপুর রোদে ছাদে কাপড় মেলা নেই, বিকেল নেই, সন্ধ্যে নেই, কোন অবসরই নেই। ভোর হতে না হতেই হাতে ব্যাগ নিয়ে এক দৌড়। যেন না ছুটলে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। যেন ছোটাতেই গর্ব। কাকে কৈফিয়ত দিতে হবে আর কেনই বা দিতে হবে, তা কারো জানা নেই। মানুষের জীবনে এখন একবগগা - শ্যামের বাঁশির মতন ডাকে শুধুই স্মার্টফোন, স্মার্টফোন আর স্মার্টফোন।
আরও পড়ুন, কন্যা সন্তানদের মেরে ফেললে মা হবে কারা? রোবট?
এখন স্মার্টফোনের যুগে সে ছাদ হয়ে পড়েছে অদরকারি, শুধুমাত্রই প্রয়োজনীয়। বিকেল গড়িয়ে সূর্য পাটে নেমে সন্ধে হয়ে যায় ছাদে সবার অলক্ষ্যে। ছাদের চরিত্রও অনেক বদলে গেছে সময়ের সাথে সাথে। ছাদকে আর অলঙ্কৃত করে পয়সা নষ্ট করেন না বাড়ির মালিক বা প্রোমোটাররা। অনাদরে ছাদে পড়ে থাকে শুধু জলের ট্যাঙ্ক আর অদরকারি পাইপ। ছাদে-ছাদে পাশাপাশি, মেশামেশি বেড়ে গিয়ে একাক্কার হয়ে গেছে, তার ফলে নির্জনতা, একান্ততা নেই। ছাদের পাঁচিলের সম্মুখে দিগন্তবিস্তৃত আকাশ দেখার সু্যোগ নেই। পাঁচিলে মাথা গুঁজে চোখের জল উপভোগ করার সুযোগ নেই। মানুষের জীবনযাত্রার গতি বদলে গিয়ে সে বাইরে, তথা ভিতরে তাকাতে ভুলে গেছে, যথারীতি, নানান খেলা হাতে পেয়ে। ছাদে এখন মানুষ বিকেলে যায় না... হয়তো যায় বিকেল শেষ হলে।
কলকাতার মায়েরা সিরিয়ালের লোভে সন্ধে দেখতে ভুলে গেছেন। "ও তো রোজই হয়..." শাঁখের শব্দ শোনা যায় না, জামাকাপড় ওয়াশিং মেশিনে কাচা-শুকোনো হয়। কাজেই নীল শাড়িও ঝুলতে দেখা যায় না ছাদে। বিকেলে ঘুড়িও ওড়ে না। পায়রাও ওড়ে না।
সবাই নিচে নেমে গেছে কাজে।
আমাদের এখানে ছাদ নেই, কিন্তু ডেক আছে। ডেক মানে একতলা বাড়ির পিছনে লাগোয়া একখানা কাঠের বারান্দা, তার সঙ্গে এক টুকরো বাগান। সেই ডেকে গরমকালে চুটিয়ে বারবিকিউ করে বাঙালিরা। গরমকালে যেহেতু রাত সাড়ে ন’টা অবধি সূর্যের আলো থাকে, আড্ডাটা বেশ ভালোই জমে। বাচ্চারাও নিশ্চিন্তে খেলা করে বাগানে। তাদের নানান খেলা, আমাদের মতন নয়। শীতকালে কোনো বিকেল নেই, বাইরে খেলতে যেতে পারে না, বাড়িতেই খেলে ক্যারম, লুডো, দাবা। অবাক করা তথ্য, কিন্তু কথা বলে জানলাম, বেশীরভাগ বাঙালি বাবা-মারা তাদের বাচ্চাদের হাতে প্লে-স্টেশন বা এক্স-বক্স তুলে দেন না এই পাল্লা দেওয়ার যুগেও। বাইরে খেলতে যেতে দেন কাঠামোবদ্ধ আইস হকি, কারাটে, বেসবল, বা আর্লি লার্নিং সেন্টারের নানান ক্রিয়াকলাপে। মানে ওই যে বলেছিলাম? বাঙালী বাবা-মায়েরা দেশের সংস্কৃতির প্রতি একটু বেশীই পক্ষপাতী। তাই বিদেশের ছেলেমেয়েরা বিকেলের ছাদ না থাকার কষ্ট জানে না ঠিকই, কিন্তু তাদের ছেলেবেলা হারাতে দেন নি এখানকার বাবা-মায়েরা।
আমাদের ছেলেবেলার বিকেলটা খুব ঘটা করে আসত। মা চুলে কলা-বিনুনি করে দিতেন ছাদে যাওয়ার আগে। “খোলা চুলে ভুতে ধরবে,” বলতেন আমার পিসি। কাচা ফ্রক পরে ছাদে এক্কা-দোক্কা, চু-কিত-কিত, লুকোচুরি, কুমির-ডাঙ্গা, আইস-পাইস-ধাপ্পা, এলাটিন-বেলাটিন সইলো, নানান খেলা চলতো সন্ধ্যে পর্যন্ত। ঠাকুরঘরে শাঁখ বাজার আগেই নিচে নেমে আসতে হত। তার পরেই পড়তে বসতে হবে। আর সে সময় যদি লোডশেডিং হল তো ব্যস, সারা পাড়ায় একটা সমবেত শোকার্ত আওয়াজ, “যাআহ্হ্!!” হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়ার একটা আলাদা আনন্দ ছিল। নিজেকে মহা পন্ডিত মনে হত, মায় বিদ্যাসাগরী। ঘন্টাখানেক গলদ্ঘর্ম হয়ে পড়ার মধ্যে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতাম। পরে আলো এসে গেলেই আবার সমবেত হর্ষ সারা পাড়া জুড়ে, “আআহ্হ্হ্!” আমরাও আনন্দে লাফিয়ে উঠতাম। যেনো আলো এসে যাওয়াটা আমাদের জীবনে একটা বিরাট পাওনা।
সেই লোডশেডিং-এর জন্য আজকাল খুব মন খারাপ করে। চারিদিকে সারা পৃথিবী অন্ধকার, নিস্তব্ধ। শুধু আমি আর আমার পাশে মৃদু আলোর ছিটেয় হ্যারিকেন। কেউ নেই, কোনো শব্দ নেই। শুধু আমার অস্তিত্ব, আর কিচ্ছু নেই সারা ব্রহ্মাণ্ডে! ভাবলে আজও শিউরে উঠি।
এই ছোট্ট ছোট্ট আনন্দ কিন্তু নেই আজকের ছেলেবেলায়, সে দেশেই হোক আর বিদেশেই। এদের অতি-পাওয়ার কষ্ট দেখে কষ্ট হয়। আমায় গতকাল আমার ছেলে প্রশ্ন করেছিল, “মা, নিজের জন্য কিছু কেনা কি অপরাধ?” এর উত্তর আমার জানা নেই। আমরা যে যুগে জন্মেছিলাম, তাতে না পাওয়ার আনন্দ এতো বেশি ছিল, যে সব পেয়ে সে আনন্দকে নষ্ট করার সাহস আমার নেই।