ছোটবেলায় অঞ্জলি দেওয়ার সময় প্রায়ই বড়দের মুখে শুনতাম, "সরস্বতী বানান কর তো, তারপর অঞ্জলি দিবি।" দুঃখের বিষয়, আজও সরস্বতী বানান জানি না। বানানটা কপি-পেস্ট করতে হল। কী জানি কেন খালি মনে হয়, সরস্বতী সয়ে-বয়ে দিয়ে শুরু। অনেক বানান, ইংরেজি ও বাংলা, আজও ভুল করি, যেমন 'occasion', 'received'। যেমন, 'রীতিমত', 'নতুন', 'মুমূর্শু'। হ্রস্ব উ না দীর্ঘ ঊ, হ্রস্ব ই না দীর্ঘ ঈ, তা নিয়ে এখনও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি স্ক্রীনের দিকে। ব্রেনের হারানো কোণায় খোঁচা মারি। তারপর দেখি অটো-কারেক্ট যা জানে তা দিয়ে ঠিক করে দিল!
এত এত লিখলাম সারা জীবন ধরে, যখনই occasion লিখি তখনই ওয়ার্ড ফাইলে তার তলায় লাল দাগ দেখায়। এবারও দেখাল। কী মুশকিল! বোধহয় মা সরস্বতী (বানানটা কপি-পেস্টেড) আমায় ঠিকমতো কোনোদিনই আশীর্বাদ করেন নি। বা আমিই হয়তো মন দিয়ে পুজো করি নি কোনোদিন। তাই কিছু বানান নিয়ে লড়াই আমার রয়েই গেল।
আরও পড়ুন, প্রবাসিনীর চিঠি: অনেক হয়েছে, এবার চললাম টরন্টো থেকে কলকাতা, ট্রেনে করে
আজকালকার বাচ্চারা নিশ্চয়ই মন দিয়ে পুজো করে। অন্তত, প্রবাসী বাচ্চারা তো করে। ছবিতে দেখুন টরন্টোর এই বাচ্চাগুলো কী নিষ্ঠাভরে পুজো করছে! ওরা নিশ্চয়ই কোনোদিন সরস্বতী (বানান কপি-পেস্টেড) বানান ভুল করবে না।
টরন্টোর ছেলেমেয়েরা শুধু নিষ্ঠা ভরে পুজোই করে না। আমাদের চেয়ে ঢের বেশি বাংলা জানে। ওরা 'কুমড়োপটাশ’ জানে, 'হুঁকোমুখো হ্যাংলা' জানে, ওরা 'পদিপিসির বর্মিবাক্স' জানে, 'পাগলা দাশু' জানে। আমরা বড়রা অনেকেই জানি না। ওন্টারিওর মিসিসাগা সেকেন্ডারি স্কুলের একটা হল ভাড়া করে 'পূর্বায়ন' বলে এক সংস্থা গত সপ্তাহে সরস্বতী পুজো করল। পুজোর আড়ম্বর তো ছিলই। কিন্তু যেটা অবাক করল সেটা এই, যে তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সেই গতানুগতিক বলিউডি গানে কলি-নৃত্য, বা একঘেয়ে লতা-কণ্ঠী, কিশোর-কণ্ঠী। এমনকি ওই ক্লান্তিকর ভারতনাট্যম, কত্থক বা ওড়িশিও না। শুদ্ধ বাংলা সংস্কৃতিকে করল তারা নতুন করে আবিষ্কার। সেটা আবার রবীন্দ্রনাথের দোহাই না দিয়েই!
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, তারা বিদেশেই জন্মেছে, ইংরেজি উচ্চারণে ক্যানাডিয়ান। বরফের রাজ্যে সাহেবদের দেশে বিভিন্ন বর্ণের বন্ধুদের নিয়ে সারাটা বছর কাটে। কিন্তু 'গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এর ভূত সেজে কী প্রচন্ড উৎসাহে তারা সারা স্টেজ দাপিয়ে বেড়ালো! কপাকপ আকাশ থেকে পড়া মন্ডা-মিঠাই খাচ্ছে ডোরা-কাটা শাড়ি আর ছোট্ট ছোট্ট ধুতি-ফতুয়া পরা খুদেরা। লাল-পাড় শাড়ি পরে 'পদিপিসির বর্মিবাক্স' এবং ধুতি-ফতুয়া পরে 'পাগলা দাশু'-র অভিনয় করে গেল অবলীলায়। আর স্কুলবাড়ির সাদা ফ্যাটফ্যাটে করিডোরে দেখলাম বাংলার রঙের প্রলেপ দিয়ে অসংখ্য আবোল-তাবোলের পোস্টার।
ভাবছেন কেমন করে পেল ওরা লাল-পাড়, ডোরা-কাটা শাড়ি আর ধুতি-ফতুয়া? আমিও তাই ভাবি, আর এই সাত-সমুদ্র-তেরো-নদীর এপারে, সাহেবদের মাড় দেওয়া দেশে যারা বাংলার ঢলঢলে, রঙিন প্রতিচ্ছবি এত সহজ করে তুলে ধরে, তাদের কুর্নিশ। শুনি কলকাতা থেকে সব নিয়ে আসে, মায় হারমোনিয়াম, তবলা, সেতার, তানপুরা পর্যন্ত! দেশে তাদের দাদু-ঠাকুমাকে প্রতি সপ্তাহে এই খুদেরা একটি করে বাংলা কবিতা মুখস্থ করে ভিডিও কলে শোনায়। শিকড় থেকে দূরে আছে বলেই বোধহয় অপরাধবোধে ভোগা বাঙালী বাবা-মায়েরা বাংলার প্রতি একটু বেশীই পক্ষপাতী। আমিও তাই আমার সদ্যযুবক পুত্রের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে বাংলায় কথা বলব বলে বাংলা কীবোর্ড ডাউনলোড করেছি। লিখতে না পারুক, বলা এবং পড়া ভুলতে দেব না কিছুতেই।
মানছি, কবিগুরু ছাড়া আমাদের চলার পথ নেই। সর্বপ্রথম কবিগুরুকে প্রণাম করে বাংলা সংস্কৃতি আরম্ভ হয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর চলতি হাওয়ার ব্যান্ডের মাঝখানে বাংলাদেশের অনেক সৃষ্টি আছে যা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালী জীবন থেকে। যেমন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'টুনটুনির বই', যেমন সুকুমার রায়ের 'হ-য-ব-র-ল', 'আবোল-তাবোল', 'পাগলা দাশু'। যেমন সত্যজিৎ রায়ের তারিনীখুড়ো, প্রফেসর শঙ্কু। যেমন লীলা মজুমদারের মজাদার কাহিনী, 'পদিপিসির বর্মিবাক্স', যেমন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের 'ঠাকুরমার ঝুলি'। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, জিয়নকাঠি-মরণকাঠি, ভীমরুলের মধ্যে রাক্ষসের প্রাণ, এসব হ্যারি পটার লেখার অনেক আগে বাংলা সাহিত্যে রচনা হয়ে গেছে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘লালকমল-নীলকমল’ কাহিনীতে রাক্ষস-খোক্কসের দুনিয়ায় প্রবেশ করলে আর কোনো বাচ্চা হাতে মোবাইল চাইবে বলে মনে হয় না, ভিডিও গেমসের প্রয়োজনও না হতে পারে। যে বাঙালির জীবনে উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার নেই, দক্ষিণারঞ্জন, লীলা, কেউ নেই, সে বাঙালির জীবনে ছেলেবেলার আক্ষেপ থেকেই যাবে।
‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’ লীলা মজুমদারের লেখা। ছোটদের জন্যে লেখা মজার এই গল্প লীলা মজুমদারকে এক ধাক্কায় খ্যাতির চূড়ায় তুলে দিয়েছিলো যখন তা ১৯৭২ সালে বাংলা ছায়াছবিতে রূপান্তরিত হয়। পদিপিসির ভূূূমিকায় ছায়া দেবীর অসাধারণ অভিনয় দর্শকদের মনে গেঁথে যায়। ছায়াছবিটির পরিচালনায় ছিলেন অরুন্ধতি দেবী। এই ছবিটা ইন্টারনেটে কোথাও পেলাম না। তবে তাঁর লেখার কিছুটা অংশ পেলাম, আর তাতেই অভিভূত হলাম।
"...পাঁচুমামার প্যাঁকাটির মতন হাত ধরে টেনে ওকে ট্রেনে তুললাম। শূন্যে খানিক হাত-পা ছুড়ে, ও বাবাগো মাগো বলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শেষে পাঁচুমামা খচমচ করে বেঞ্চিতে উঠে বসল। তারপর পকেট থেকে লাল রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে ফেলে, খুব ভালো করে নিজের হাত-পা পরীক্ষা করে দেখল কোথাও ছড়ে গেছে কিনা ও আয়োডিন দেওয়া দরকার কিনা। তারপর কিছু না পেয়ে দু-বার নাক টেনে, পকেটে হাত পুরে, খুদে খুদে পা দুটো সামনের বেঞ্চিতে তুলে দিয়ে আমার দিকে চেয়ে চিঁচিঁ করে বলল, 'ছোটবেলায় একবার ভুলে বাদশাহী জোলাপ খেয়ে অবধি শরীরটা আমার একদম গেছে, কিন্তু বুকে আমার সিংহের মতন সাহস। তা নইলে পদিপিসির বর্মিবাক্স খোঁজার ব্যাপারে হাত দেব কেন!'
"...পাঁচুমামা বলল, 'একশো বছর পরে পদিপিসির বর্মিবাক্স আমি আবিষ্কার করব। জানিস, তাতে এক-একটা পান্না আছে এক-একটা মোরগের ডিমের মতন, চুনি আছে এক-একটা পায়রার ডিমের মতন, মুক্তো আছে হাঁসের ডিমের মতন। মুঠো মুঠো হীরে আছে, গোছা গোছা মোহর আছে। তার জন্যও শত শত লোক মারা গেছে, রক্তের সালওয়েন নদী বয়ে গেছে, পাপের ওপর পাপ চেপে পর্বত তৈরি হয়েছে – সব আমি একা উদ্ধার করব!'
আমাদের ছোটবেলায় বাংলা না জানাটা একটা 'স্ট্যাটাস সিম্বল’ ছিল। "আমার মেয়ে একধম বাংলা বলটে পাঢ়েনা," বললেই সে মা সমাজে উচ্চপ্রতিষ্ঠিত। "বাংলাটা আমার ভীষণ ঢিফিকাল্ট ল্লাগে," বলতে পারলেই সমাজের নেকনজরে থাকত। আজকাল শুনছি একটু অন্যরকম। বাংলা নিয়ে সমাজে একটু-আধটু চর্চা হচ্ছে। নন্দন, রবীন্দ্রসদনে যাওয়াটা এখন সন্মানীয়। বাংলা থিয়েটার, বাংলা সিনেমা দেখার পথে হাঁটেন এখন বুদ্ধিজীবিরা। বাংলা সাহিত্য এখন শুধুমাত্র বইমেলায় সীমাবদ্ধ নয়। নানান মাধ্যমে ফিরে আসছে। ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে বাংলা কী-বোর্ড হওয়ার ফলে, দলে দলে নতুন করে আবার বাংলা বানান শিখছেন। এক প্রকাশক ‘বর্ণ-পরিচয়’ ইংরেজিতে অনুবাদ করে নতুন করে প্রকাশ করলেন গত বছর বইমেলায়। ফেসবুকে বাংলা-ভাষা দিবসে বাঙালিরা ইংরেজিতেই লিখছেন, "Let's keep our mother tongue alive... Let's make sure our children speak their mother tongue with pride..."
তাই সই। যাতে কাজ হয়...
আসলে বাংলাদেশ থেকে বেরোলেই বাংলা ভাষার গুরুত্বটা কয়েকশো ধাপ বেড়ে যায়। তখন ভাষাকে ধরে রাখাই হয়ে যায় 'স্ট্যাটাস সিম্বল'। যত বড়ই হও না কেন আর যত বিদেশি হও না কেন, শুক্তোয় কি ফোড়ন দিতে হয় না জানলে তুমি জাতে উঠলে না। এখানের অধিকাংশ বাড়ির কর্তারা মাছের ঝোল রাঁধতে পারেন, কেননা সেটা অত্যন্ত পারদর্শিতার পরিচয়। আমার বর রুটি করতে পারে, এবং তার রুটি না ফুললে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।
ক্যানাডার সাদা ম্যাড়মেড়ে বাড়িগুলোর ভিতরে গৃহশোভা স্বরূপ বাংলার আদর মাখা একটা দুর্গাঠাকুরের মূর্তি, একটা শাঁখ, একটা রঙিন প্যাঁচা বা একটি সৃজনশীল গণেশের মুর্তি না দেখতে পেলে মন ভার হয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা কতটা বাংলা ভাষা শিখছে, বাচ্চারা পুজোর প্রসাদ খাচ্ছে কিনা, তার ভিত্তিতে মনে মনে সাজানো হয় সাফল্যকাঠি। বিদেশের কাঠখোট্টা মাটিতে বাংলার মিষ্টি রস না ঢাললে যে পৃথিবীর ভারসাম্যটাই হারিয়ে যাবে!