Advertisment

পাথর বুড়ির থানে মুখ্যমন্ত্রী, বাহন হেলিকপ্টার

মুখ্যমন্ত্রী আসবেন পাথর বুড়িকে পুজো দিতে। পৌষ সংক্রান্তির সকালে। মুখ্যমন্ত্রী আসছেন, চাইবাসা রেডিওকে তো কভার করতে যেতেই হবে। আর এইসব মওকার জন্যই তো 'চাইবাসা চাই' দাবি করেছিলাম।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
পাথর বুড়ির থানে মুখ্যমন্ত্রী, বাহন হেলিকপ্টার

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

পাথর বুড়ি জেগে ওঠেন মকর সংক্রান্তির দিন। পাথর বুড়ির অন্য নাম 'জংলেশ্বরী'। কথাটা ছিল জঙ্গলেশ্বরী - বোঝাই যায়। আবার ঝাড়খণ্ডের এইসব লোকগুলোর মধ্যে যারা ভদ্দর লোক-ভদ্দর লোক হয়ে উঠেছে, ওরা বলে জলেশ্বরী। ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলায় একটা পাহাড়ের মাথায় একটা গুহা, এই গুহার ভিতরেই বাস করেন পাথর বুড়ি। এইদিন মনস্কামনা জানালে পাথর বুড়ি পূর্ণ করেন। তবে মনস্কামনাটি জানানোর আগেই বুড়িকে খুশি করতে হয়। কেউ কাঁধে করে নিয়ে যায় পাঁঠা, কেউ বগলে চেপে নিয়ে যায় হাঁস, কেউ বা ঝুলিয়ে নেয় মোরগ।

Advertisment

পাহাড়ের তলায় মেলা বসে। এরকম এক মকর সংক্রান্তিতে আমি চাইবাসায়। ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চাইবাসায় কাটিয়েছিলাম। আকাশবাণীর একটি কেন্দ্র আছে চাইবাসায়। আমি ওখানে বদলি নিয়েছিলাম চেয়ে বলে।

মুখ্যমন্ত্রী আসবেন পাথর বুড়িকে পুজো দিতে। পৌষ সংক্রান্তির সকালে। মুখ্যমন্ত্রী আসছেন, চাইবাসা রেডিওকে তো কভার করতে যেতেই হবে। আর এইসব মওকার জন্যই তো 'চাইবাসা চাই' দাবি করেছিলাম। চাইবাসা গিয়েছিলাম বলেই দেখেছিলাম কানহার, কিলু, কারো, রোরো, খরকাই, পুনপুন - এইসব নদীর বালি সারাদিন ধরে ধুয়ে, কুলোয় চেলে, সোনার আকর মেশানো বালি ছেঁকে নেয় স্থানীয় মানুষেরা। সেই সোনা-বালি কিনবার জন্য ব্যাপারীরা আসে, দেড়-দুশো টাকায় কিনে নিয়ে যায় সারাদিনের পরিশ্রম। দেখেছি 'বিরসাইয়ত'দের, যাঁরা এখনও বিশ্বাস করেন, 'মুন্ডারাজ' কায়েম হবেই। বিরসা মুন্ডার সমস্ত কর্মস্থান, দেখেছি করম-বাঁধনা-বাহা পরব। লুকিয়ে থাকা, আলোর পিছনে থাকা অনার্য ভারতকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।

আরও পড়ুন: মকর সংক্রান্তি, রাঢ় বাংলার প্রাণের নতুন বছর

তো, জঙ্গলেশ্বরীর কথা হচ্ছিল। মকর সংক্রান্তির দিন এরকম বহু দেবীর জাগরণ হয়। জঙ্গলেশ্বরীরা সাত বোন। মানভূম এলাকার সাত জায়গায় সাত বোনের জাগরণ হয় মকরের দিন। আসলে মকরেই ছিল নতুন বছরের শুরু। সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হয় ওই সময় থেকে। গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারে ২১ ডিসেম্বরের দিন সবচেয়ে ছোট। এর পর থেকে দিন বড় হতে থাকে। আকাশে সূর্য ক্রমশ বেশিক্ষণ ধরে বিরাজ করবেন। 'জাড়'লাগা সূয্যিঠাকুর আড়মোড়া ভেঙেছেন। নতুন বছরের শুরু। আকবর বাদশা 'হিজরি' সনকে ভেঙে বাংলা সন বানালেন। নইলে আমাদের নতুন বছর মকর সংক্রান্তির পরদিন থেকেই। আবার চলে এলাম অন্য কথায়।

জঙ্গলেশ্বরীর মেলা বসেছে পাহাড়ের তলায়। সকাল থেকেই জিলিপি ভাজা শুরু হয়ে গেছে। গুলগুলাও ভাজা হচ্ছে। গুলগুলা হলো আটার সঙ্গে গুড় মিশিয়ে ফুলুরির মতো করে ভাজা। গায়ের চাদর-সোয়েটার ইত্যাদি নিয়েও কয়েকটা দোকান বসেছে। দেশি মোরগ, পাঁঠা, ভেড়া, হাঁস নিয়েও এসেছে কয়েকজন কারবারি। হাঁস-মোরগ বাঁশের ঝুড়িতে, পাঁঠা-ভেড়ারা দড়িতে বাঁধা। ওরা ভ্যা-ভ্যা করে যাচ্ছে। ফুল নিয়েও বসেছে কয়েকজন। গাঁদাফুল আর জবা। জবাফুলের দাম একটু বেশি। জবার মালাও আছে। বুঝতেই পারছেন দাম বেশি। এইসব জবার মালা যারা কিনবে, ওরা পাঁঠা-ভেড়াও কিনবে। ওদের গলায় পরিয়ে দিয়ে কাঁধে চড়িয়ে পাহাড়ে উঠবে। পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলেশ্বরীর থান।

জবার মালা পাঁঠা-ভেড়ার গলায় এমন করে পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন নিজেদের গলার মালা নিজেরাই খেতে না পারে। তবে ওই কাঁধে-চড়া চারপেয়েদের চেষ্টাটা থেকেই যাচ্ছে। ওরা গলা বাঁকিয়ে, শরীর এধার-ওধার করে নিজের গলার মালা গলাধঃকরণের চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। দুহাতে চার পা চেপে ধরা লোকগুলো, ওদের "বুক্কা পাঁঠাটা", "শালো ভেড়াটা", "হাইটাটকা হুড়ুমচাঁদা" - এইসব গালিগালাজ দিচ্ছে। জবাফুল সমেত মুণ্ডুটাই তো উৎসর্গ করতে হবে মাকে। তার আগেই বোকাগুলোকে ফুল খেতে দেওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন: প্রকাশিত হল সুন্দরবনের প্রথম মানচিত্র

চারপেয়ে দেওয়ার সামর্থ্য যাদের নেই, ওরা দুপেয়ে নিয়ে উঠছে। হাঁস, মুরগি, কিংবা পায়রা। যারা ওপরে উঠছে, ওদের কাঁধে চনমনে প্রাণ, নিজের গলার মালাটা খাওয়ার জন্য ছটফটাচ্ছে, যারা নামছে, ওদের কাঁধে নেতিয়ে পড়া মুণ্ডহীন মনস্কামনা। মুণ্ডটা মায়ের থানে। মানুষগুলোর জামা-চাদরে রক্ত।

পাহাড়ের তলায় সাহেব-অফিসারদের সাদা গাড়ি, পুলিশের কালো গাড়ি, দমকলের লাল গাড়ি। কেননা আজ "হামারা আদরণীয় মুখ্যমন্ত্রীজি মাতৃপূজা কে লিয়ে আয়েঙ্গে।" একটা হেলিপ্যাডও তৈরি হয়েছে। জিজ্ঞাসা করি, আদরণীয় মুখ্যমন্ত্রী কি হেঁটে হেঁটে পাহাড়ে উঠবেন? ডিএম সাহেব বললেন, "হো সাকতা হ্যায়।" জিজ্ঞাসা করি, কখন আসবেন? সাহেবরা বললেন, "পাতা নেহি।" সকাল আটটার আগেই পৌঁছে গিয়েছি আমি। বেলা এগারোটা বেজে গেল, মন্ত্রীর কোনও খবর নেই। পাহাড়ের তলায় দাঁড়িয়ে আছি, বাইরে তেলেভাজার কড়াইতে তেলের মধ্যে হুড়োহুড়ি করছে বেগুনি, ফুলুরি, গুলগুলা, জিলিপির ওপর পার্টির মিটিং বসিয়েছে মাছিরা, ওয়াকি-টকিতে কথা বলছে ব্যাজ আঁটা পুলিশেরা, কোট পরা সাহেবরা।

দুজন দেহুরি এল, পরনে ধুতি, ফুলশার্ট, সোয়েটার, তার ওপর লাল টুকটুকে চাদর। বোঝাই যাচ্ছে শার্টগুলো নতুন। দেহুরি মানে আদিবাসী পূজারী। দেহুরিদের নিয়ে আসা হয়েছে, কারণ মুখ্যমন্ত্রী এসে বলতেই পারেন - বেলা হয়ে গেছে, আর পাহাড়ে উঠব না, নিচে থেকেই পুজো দিয়ে দেব। যদিও নিচে দাঁড়িয়ে পুজো দেওয়া যায় না, তবে মন্ত্রী চাইলে সব হয়। আমরা পাহাড়ে উঠতে পারছিলাম না। যদি উনি পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়েই পূজাকর্ম শেষ করে চলে যান।

আরও পড়ুন: শোভাবাজার রাজবাড়ি: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের এক অন্যতম স্তম্ভ

সাড়ে বারোটা নাগাদ জানতে পারলাম, মুখ্যমন্ত্রী রওনা হবেন এক্ষুনি, হেলিকপ্টারে। রাঁচি থেকে এখান আসতে কতক্ষণই বা লাগবে? বেশি হলে ২০ মিনিট। অফিসারদের থেকে এটাও জানতে পারলাম যে মুখ্যমন্ত্রী নিচে নামছেন না। দেখলাম পুলিশ বাহিনী পাহাড়ের ওপরে চলল। সিঁড়ি করা আছে কিছুটা, দেখা যাচ্ছে। ঘুরে যাওয়ার পর সিঁড়ি আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পুলিশ সিঁড়ির পথ আটকে দিল। এখন আর ঘাড়ে করে নতুন মনস্কামনা নিয়ে যাওয়া যাবে না। আমি বুঝতে পারছিলাম না, মন্ত্রী হেলিকপ্টার থেকে প্যারাশুটে করে পাহাড়ের মাথায় নামবেন কিনা, নাকি পাহাড়ের মাথায় হেলিকপ্টার নামার মতো সমতল ক্ষেত্র আছে। কাউকে জিজ্ঞাসা করা যাচ্ছে না। সবাই পড়িমরি করে ছুটছে। আমিও ছুটতে লাগলাম। আমার সঙ্গীদের কাছে যন্ত্রপাতি। কুড়ি মিনিটের মধ্যে পাহাড়ের মাথায় ওঠা অসম্ভব।

কিছুক্ষণ পর আর সিঁড়ি নেই তেমন। পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কাটা। পাথরে পাথরে রক্তদাগ। মুণ্ডহীন ধড়গুলি থেকে পড়েছে ফোঁটা ফোঁটা। মাথায় উঠতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। মাথায় উঠে প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছি। একটা গুহার সামনে পড়ে আছে অজস্র কাটা মাথা। গাদাখানেক কাক বসে আছে গাছে। দুটি ফেট্টিবাঁধা ছেলে কাক তাড়াচ্ছে। কাছাকাছি কোনও হেলিকপ্টার নামার মতো সমতল ক্ষেত্র দেখতে পেলাম না। গুহার সামনে একটু চওড়া জায়গা আছে, কিন্তু হেলিকপ্টার নামা সম্ভব নয়। তবে কি মুখ্যমন্ত্রী প্যারাশুটে নামবেন? ভাগ্যিস উনি দেরি করলেন, মন্ত্রীর 'প্যারাশুটাবতরণ' দেখার সৌভাগ্য হবে আমার। পুলিশ-আমলাদের সঙ্গে আমার মাথাটাও আকাশের দিকে ওঠানো। ভগবানকেও এভাবে দেখার চেষ্টা করি নি কখনও। কই আসে? কই আসে? ওই আসে, কেউ বলে। দূরে একটা কালো কিছু দেখা যায়। নাঃ, ওটা চিল। কই আসে? আশেপাশে কাক-চিল।

আরও পড়ুন: শিয়ালদহ, যেখানে অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় বসে তামাক খেতেন জোব চার্নক

এবার সত্যিই আওয়াজ পাওয়া গেল। ঈশ্বরবাবু আসছেন। আওয়াজ তীব্রতর হয়। সত্যিই হেলিকপ্টার আসছে। পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই প্রচণ্ড হাওয়ায় জঙ্গল নড়ে ওঠে। জঙ্গলে কুঁচফুলের গাছ। হাওয়ার তোড়ে শুঁটিগুলো ভেঙ্গে লাল লাল কুঁচফল ঝরে পড়ছে। কাঠবিড়ালিগুলো তুমুল ছুটোছুটি করছে। বাঁদরেরা ওদের শিশুসন্তান কোলে চেপে গাছ থেকে নেমে আসছে। কাকগুলো প্রচুর আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। বাবলা, কেন্দু, পিয়াল, শাল গাছের দেহ থেকে পাতাগুলো খসে খসে পড়ছে। হেলিকপ্টার পাহাড়ের মাথায় স্থির হলো। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা হাত। এবার কি প্যারাশুটে নামবেন মন্ত্রী? না। হাত থেকে ঝরে পড়ল দু'টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকার নোট। শাল-পিয়ালের ঝরা পাতার সঙ্গে উড়তে লাগল নোট। উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে পড়তে লাগল। কোনোটা আটকে রইল পিয়াল গাছের খাঁজে, কোনোটা বাবলা কাঁটায়, কোনোটা দুই পাথরের খাঁজে। কিছু দূরে এবার ঝুরঝুর করে পড়ল কিছু একটাকা-আট আনা-চার আনার কয়েন।

হেলিকপ্টারটা আবার ওপরে উঠল। এবং পাহাড়ের চারপাশে ঘুরতে লাগল। এটা এমনি এমনি পাক খাওয়া নয়, প্রদক্ষিণ। সাতবার হেলিকপ্টারটা তুমুল শব্দে জঙ্গলেশ্বরীর থান প্রদক্ষিণ করল।

মন্ত্রীর পুজো দেওয়া শেষ। এবার এক আশ্চর্য ব্যাপার। যে সমস্ত মানুষেরা ছিল, ওরা টাকা এবং খুচরো পয়সা কুড়োতে লাগল। কেউ কেউ উঠে গেল গাছের খাঁজে আটকে থাকা টাকাগুলো সংগ্রহ করতে। কেউ ঢুকে গেল পাহাড়ের সঙ্কীর্ণ খাঁজে। ওখান থেকে বের করে আনল টাকা ও কয়েন। কিন্তু ওদের পকেটে ঢোকাল না, ট্যাঁকে গুছোল না, ব্যাগে রাখল না। সবাই গুহামুখে একটা বড় কচুপাতার ওপরে জমা করল। নোটগুলো যেন উড়ে না যায়, সেজন্য নুড়ি চাপা দিল। এগুলো মায়ের টাকা। মানুষগুলো কী সারল্য এবং সততায় মন্ত্রীর দেওয়া মায়ের টাকা মায়ের সামনের কচুপাতায় জড়ো করছিল।

Advertisment