Advertisment

উচ্চবর্ণে গরীবের সংজ্ঞা এবং দশ শতাংশ ছাড়

আর্থিক অবস্থার নিরিখে উদ্ভূত সংরক্ষণ কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন উঠবেই। এই সংরক্ষণের যেটুকু সুবিধা তার বেশিটাই ভোগ করবে আট লাখের খুব কাছাকাছি যাদের রোজগার তারাই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ফাইল ফোটো

শুরুতে কিছু পাটিগণিতের অঙ্ক কষা যাক। পাটিগণিতের অঙ্ক মানেই যে সহজ এমন নয়। তৈলাক্ত বংশদণ্ডে বাঁদরের ওঠানামা গুনতে গিয়ে অনেক সময়েই সবশেষে উত্তর বেরোয় তিনের-চারটি বাঁদর। বাঁদরের সংখ্যা কিভাবে ভগ্নাংশে এলো তা বোঝার আগেই পরীক্ষার সময় শেষ। কালিমাখা হাতের আঙুলে কলমের ডগা, পেছনটা ভাগ্যিস চিবোনোর প্রয়োজনে দুপাটি দাঁতের মধ্যে গোঁজা থাকে। অন্তত দাঁতকপাটি লেগে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা। বাপ ছেলের বয়সের অঙ্কে বাপের বয়স ছেলের থেকে কম, এমনটা মাঝে মাঝেই ঘটে থাকে। তার থেকে আরও বেশি বিপজ্জনক, বয়স যখন ঋণাত্মক।

Advertisment

ঐকিক নিয়মের মায়াজালেও পাটিগণিত অনেক সময় মারাত্মক আকার ধারণ করে। তিনজন শ্রমিক তিন দিনে যতটা কাজ করতে পারে, সমপরিমাণ কাজ দুজনে কতদিনে করবে সেই অঙ্কের সমাধানের থেকে খেটে কাজটা করে ফেলাই জনগণের পক্ষে মঙ্গল। তবে সবথেকে গোলমেলে ব্যাপার বোধহয় শতাংশের অঙ্কে। ব্যাঙ্কে সুদের হার কমলেও শতাংশের সুদকষা মোটেও সরলতর হয় না।

তবে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া মোদী সরকার সাধারণ মানুষের অর্থকষ্টের সঙ্গে অঙ্ককষ্টের কথাটাও ভেবেছেন। ভাবুন তো, এতদিন পর্যন্ত কীসব গোলমেলে শতাংশ দাপিয়ে বেড়াত! তপশিলি জাতি পনেরো, উপজাতি সাড়ে সাত, অন্যান্য পিছিয়ে থাকা লোকজন সাতাশ, যোগ করলে সাড়ে ঊনপঞ্চাশ। একেই শতাংশের অন্দরে পরোক্ষভাবে মুখ লুকিয়ে থাকে দশমিক, তার ওপর আবার সাড়ে সর্বনাশ প্রত্যক্ষ ফুটকি। আগের শাসকেরা সম্ভবত সুযোগ পেলে দুষ্টুমি করে শতাংশের সঙ্গে পৌনঃপুনিক গুঁজে দেওয়ারও চেষ্টা করত।

সেদিক দিয়ে মোদী সরকার অনেক বেশি সোজা অঙ্ক ধরিয়েছে - উচ্চবর্ণের গরীব মানুষের জন্যে দশ শতাংশ সংরক্ষণ। দশ দিয়ে গুণ কিংবা ভাগ করা দুটোই সহজ। অঙ্কে কাঁচারা দশ শতাংশ কষার সময় দশ দিয়ে গুণ করে আবার একশো দিয়ে ভাগ করবে। কিন্তু বর্তমান বিজেপি সরকার জনদরদী। তাই দুঃখী উচ্চবর্ণের মানুষদের সরকারি চাকরির সম্ভাবনায় একবার দশ দিয়ে ভাগ করলেই চলবে। একটি সরকারি চাকরি যদি কোথাও ফাঁকা থাকে, তাহলেই বাকি সকলের জন্যে যাই থাকুক না কেন, পিছিয়ে থাকা উচ্চবর্ণের ভাগে তেল-শুকনো পিদিমে ঘাড় উঁচু করা সলতের একের মত ১-টা থাকবেই। আবছা ০.১-এ বাঁদিকের 'শূন্য দশমিক' মনে না রাখলেই ভাল।

তা গরীবের জন্যে সংরক্ষণ তো হল। এখন দেখতে হবে গরীব বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। বিজেপি রাজত্বে উন্নতির আবহে দারিদ্রসীমার সরলরেখাগুলো লাফঝাঁপ দিয়ে এমন এদিক ওদিক ছিটকে গেছে যে ট্রাম্প টাওয়ার কিংবা বুর্জ খলিফার সাতচল্লিশ তলায় বসে থাকলেও তা মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে। উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ পেতে গেলে বাৎসরিক রোজগার হতে হবে আট লাখ টাকার নীচে, জমি থাকতে হবে পাঁচ একরের কম, বাড়ি থাকলে তার ক্ষেত্রফল হাজার স্কোয়ারফুট পার হলে চলবে না। সংরক্ষণের শতাংশ কিংবা রোজগারের পাটিগণিতে তেমন জটিলতা না থাকলেও জমিবাড়ির জ্যামিতিরা এখানে বেশ ভোগাবে। সেটুকু সামলে নিতে পারলে উচ্চবর্ণের দারিদ্রসীমার অঙ্কটুকু পরিষ্কার।

সংবিধান সংশোধন নিয়ম মেনে করা হচ্ছে কিনা, আর্থিক কারণে সংরক্ষণের যৌক্তিকতা কতটা, উচ্চতম ন্যায়ালয়ের নিদানে পঞ্চাশ শতাংশ পেরোন আইনানুগ কিনা, এইসমস্ত বুঝতে অবশ্য শুধু অঙ্ক জানলে হবে না। তার জন্যে ইতিহাস, আইন, সমাজবিজ্ঞান, এরকম অনেক কিছু পড়তে হবে। সেসব তো দুষ্টু লোকের কারবার, যারা নাকি এইসব কুযুক্তি আমদানি করে একাধারে উচ্চবর্ণের এবং নিম্ন-আয়ের জনসাধারণকে সংরক্ষিত হওয়ার পথে বাধা দিতে চাইছেন। সহজ অঙ্কে সাত লাখ নিরানব্বুই হাজার নশো নিরানব্বুই টাকা এবং নিরানব্বুই পয়সার মধ্যে আয়টাকে সামলে রাখতে হবে। খোঁজ নিতে হবে এটা আয়কর বাদ দিয়ে কিনা। নাহলে ডিএ কমানোর দাবিতে আন্দোলন চলবে যাতে বছরের শেষে মোট মাইনে আট লাখের সামান্য নীচে নামিয়ে দেওয়া যায়। গ্রামের ভুলে যাওয়া সম্পত্তির খেরোর খাতায় চাষজমি পাঁচ একরের এক ছটাক কম। দরকারে জোর করে কিছুটা বাদ দিয়ে আল কাটতে হবে। দক্ষিণ কলকাতায় নশো নিরানব্বুই স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের চাহিদা সবথেকে বেড়ে যাবে। ক্ষেত্রফল যদি হাজার ছুঁয়ে ফেলে তাহলে একছুটে পুরসভার আধিকারিকের দপ্তরে। দলিলটা কি বদলানো যায়? দরকারে একদিকের ঝুলে থাকা বারান্দাটাকে শাবল দিয়ে বিয়োগ করে দেব। একচিলতে রোদ্দুরে আর জামাকাপড় শুকোনো হবে না, এটুকুই যা ক্ষতি।

একটু বেশি করে নজর দেওয়া যাক বাৎসরিক আট লাখ টাকা রোজগারের দিকে। এটা আসলে এসেছে অন্যান্য পিছিয়ে থাকা শ্রেণীর স্বচ্ছল মানুষদের সংরক্ষণের সঙ্গে সংগতি রেখে। ওবিসি-দের (আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস) মধ্যে 'ক্রিমি লেয়ার' বলে একটি বিষয় আছে। ইংরিজি থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এটা অঙ্ক নয়, বরং দুধের ওপরে সরের রসায়ন। সরের মধ্যে থাকলে, অর্থাৎ বাৎসরিক আয় আট লাখ বা তার বেশি হলে কিন্তু বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়া হয় না ক্রিমি লেয়ারের ওবিসি-দের। সেই অঙ্কেই উচ্চবর্ণে সংরক্ষণের আর্থিক উর্দ্ধসীমা আট লাখ করা হয়েছে।

বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বছরে আট লাখ টাকার আশেপাশে (কম হোক বা বেশি) রোজগার হলে খুব বেশি আর্থিক সঙ্কটে থাকার কথা নয়। তাই আর্থিক অবস্থার নিরিখে উদ্ভূত সংরক্ষণ কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন উঠবেই। এই সংরক্ষণের যেটুকু সুবিধা তার বেশিটাই ভোগ করবে আট লাখের খুব কাছাকাছি যাদের রোজগার তারাই। একেবারে যারা দরিদ্র তাদের তো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগটাই নেই। সরকার যদি সত্যিই এই ভীষণ দরিদ্র মানুষদের জন্যে সংরক্ষণ চাইতো তাহলে বাৎসরিক দুলাখ টাকার নীচে রোজগারের মানুষদের জন্যে এই সুবিধে দেওয়া যেতে পারত।

এবার আসা যাক স্থাবর সম্পত্তির কথায়। জমি বাড়ির ক্ষেত্রফল কখনই আর্থিক সংগতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। তা নির্ভর করে স্থান মাহাত্ম্যের ওপর। মুম্বাইয়ের কোন অভিজাত এলাকায় একটি চারশো স্কোয়ার ফিটের বাসস্থানের দাম এক কোটি টাকার বেশি হতে পারে। অর্থাৎ চাষের জমির পরিমাণ বা বাসস্থানের মাপ দিয়ে আসলে গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে গোটা বিষয়টাকে। রাজনৈতিক দল সাধারণ নির্বাচনের আগে জনসাধারণের মন জয় করতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। এতে দোষের কিছু নেই। তবে মানুষ যদি এই ঘোষণায় বিশ্বাসযোগ্য কিছু খুঁজে না পায় তাহলে কিন্তু বিপদ। অনেকে মনে করছেন যে অসংরক্ষিতদের জন্যে এ পর্যন্ত যে ৫০.৫% আসন সংরক্ষিত ছিল তাকেও কমিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা শুরু হল।

সবশেষে আসা যাক এর বাস্তবায়নের কথায়। ঠিক কোন সময় কোন পড়ুয়ার অভিভাবকের মাইনে আট লাখ টাকার নীচে হলে সে শংসাপত্র হাতে পাবে এবং সংরক্ষণের সুযোগে কোন সরকারি জায়গায় ভর্তির সুযোগ পাবে সেই পরিকাঠামো সৃষ্টি করা অসম্ভব বললেও কম বলা হয়। আর্থিক সংরক্ষণের এক অলীক বামপন্থী তত্ত্ব খড়কুটোর মত চেপে ধরে সামনের লোকসভা ভোটে বাঁচতে চাইছে দক্ষিণপন্থী বিজেপি। ভোটের দায় বড় দায়। তাই অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যও অস্পষ্ট। উচ্চবর্ণের অভাবী মানুষদের কাছে অবাস্তবতার স্বপ্ন ঠিক কতটা বিক্রি হল, তা আত্মস্থ করতে সময় লাগবে কিছুটা। তবে পরের কেন্দ্রীয় সরকার (সে বিজেপি হোক কিংবা অবিজেপি) এর রূপায়ণ করতে গিয়ে যে নাজেহাল হবে সেকথা বলাই বাহুল্য।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Quota Bill
Advertisment