Advertisment

রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনলাইন উদযাপনে একই 'ভার্চুয়াল' সূত্রে গাঁথা বিশ্বের বাঙালি

আজ লন্ডনের রবীন্দ্রজয়ন্তী যেমন অনলাইনে দেখবেন, ঠিক একই ভাবে দেখবেন কলকাতার অনুষ্ঠানও। শারীরিক উপস্থিতির কোনও প্রশ্ন নেই, হয়তো বা প্রয়োজনও নেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
rabindra jayanti online

যে যার নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে, মহড়ায় ব্যস্ত 'লেটস কীপ মুভিং ভার্চুয়ালি' দলের নৃত্যশিল্পীরা

'উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে/ চিরনূতনেরে দিল ডাক/ পঁচিশে বৈশাখ'। নূতনই বটে। সেই মঞ্চ নেই, নেই করতালি, দীর্ঘসময় ধরে মাইক টেস্টিং, অনুষ্ঠান শেষে মিষ্টির প্যাকেট, সমস্তটা বাদ এবছর। লয়, ছন্দ, তবলার বোল, সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কারণ সেই রবীন্দ্রজয়ন্তীই তো নেই। আজ এবং কাল মিলিয়ে যা অনুষ্ঠান হবে, সব অনলাইনে, 'ভার্চুয়াল' মাধ্যমে।

Advertisment

করোনার থাবায় খোলা মঞ্চে তেওড়া তালের সঙ্গে প্রকৃতি পর্যায়ের গমগমে আবহ বাদ পড়ল ঠিকই, কিন্তু ১৫৯ তম জন্মবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করা হবে না, এমনটা হতে পারে না। তাই পঁচিশে বৈশাখ কবিগুরুর গানে কবিতায় ভরে উঠবে দিন। মঞ্চ বলতে ইউটিউব, বা ফেসবুক, বা অন্য কোনও 'ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম'। করতালির বদলে সাফল্যের মাপকাঠি হবে 'লাইক' বা 'লাভ' চিহ্ন। তার সঙ্গে কমেন্ট তো আছেই।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই প্রথম নজিরবিহীন ভাবে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে দেশের এবং বিদেশের রবীন্দ্র উদযাপন। আজ লন্ডনের রবীন্দ্রজয়ন্তী যেমন অনলাইনে দেখবেন, ঠিক একই ভাবে দেখবেন কলকাতার অনুষ্ঠানও। এবং আগাগোড়া বিনামূল্যে। আর কোনও সঙ্ঘবদ্ধ অনুষ্ঠান না হলেও একাধিক শিল্পীর নিজস্ব 'লাইভ' তো আছেই। শারীরিক উপস্থিতির কোনও প্রশ্ন নেই, হয়তো বা প্রয়োজনও নেই। আক্ষরিক অর্থেই সারা বিশ্বের বাঙালি আজ একই ভার্চুয়াল সূত্রে গাঁথা।

অনলাইনে রবীন্দ্রজয়ন্তী ঠিক কীভাবে পালিত হবে? জানতে দেশ-বিদেশের বেশ কিছু অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা। 'ঘরে বসে রবীন্দ্রজয়ন্তী' শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন চিরন্তন মুখার্জি। তিনি জানিয়েছেন, "অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অনলাইনে হবে। থাকবে কবিগুরুর গান, সঙ্গে নাচ ও আবৃত্তি। এখানে আপনিও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। আজ (৮ মে) সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ১১.১৫ পর্যন্ত ফেসবুক মারফত প্রচারিত হবে এই অনুষ্ঠান।"

rabindra jayanti online 'টেগোরিয়ানস ইউকে' গোষ্ঠীর শিল্পীরা কবিপ্রণামের পাশাপাশি সম্মান জানাচ্ছেন করোনা যোদ্ধাদেরও

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েr আইন বিভাগও অনলাইনে পরিবেশন করেছে রবীন্দ্রজয়ন্তী ২০২০। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, "আমাদের পড়ুয়ারা তাদের গান, কবিতা, নাচ, যে যা করবে, তার ভিডিও করে পাঠাবে। যেভাবে সাধারণত অনুষ্ঠান হয়। সেভাবে সেই ভিডিওগুলোকে সাজিয়ে আমাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হবে। একটি পাঠ ও উদ্বোধনী সঙ্গীত থাকবে। সকাল আটটা থেকে শুরু হবে অনুষ্ঠান।"

এ তো গেল 'ঘরের' কথা। 'বাইরের' আয়োজনের ঘটাও বড় কম নয়। যেমন 'টেগোরিয়ানস ইউকে (Tagoreans UK) নিয়ে আসছে 'বিশ্বভরা প্রাণ', তাদের প্রথম অনলাইন সাংগীতিক পরিবেশনা। গান-কবিতা-নৃত্য তো থাকছেই, তবে উদ্দেশ্য শুধু কবিপ্রণাম নয়, বিশ্বজুড়ে 'করোনা সমরে' একেবারে সম্মুখ সারিতে রয়েছেন যেসব ডাক্তার, নার্স, ও অন্যান্য 'যোদ্ধা', তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও বটে। এছাড়াও থাকবে করোনাভাইরাস মহামারীতে মৃত হাজার হাজার মানুষের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা, "যাঁদের অনেকেই ছিলেন আমাদের পরিচিত", বলছে অনুষ্ঠানের বিবরণ-পত্র।

টেগোরিয়ানস-এর অনুষ্ঠান ইউটিউব এবং ফেসবুকে মুক্তি পাচ্ছে চার কিস্তিতে - প্রথমটি আজ, মে, ভারতীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়, দ্বিতীয় কিস্তি আজ, মে, ভারতীয় সময় রাত আড়াইটেয়, এবং তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি ফেসবুকে মুক্তি পাচ্ছে রবিবার, ৯ মে, যথাক্রমে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এবং রাত আড়াইটেয়। চার কিস্তিতে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য, কথায়-সুরে ভরিয়ে রাখা "রবীন্দ্রজয়ন্তী উইকেন্ড"।

অতলান্তিক মহাসাগরের ওপারে মার্কিন মুলুকের ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি দমিয়ে দিতে পারে নি নিউ জার্সির অধ্যাপিকা রাইলি রায়ের উদ্দীপনা, অথবা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের উৎসাহ। ছোটবেলা থেকেই নৃত্য-পাগল রাইলি তাঁর নিজের হাতে তৈরি ফেসবুক গ্রুপ 'লেটস কিপ মুভিং ভার্চুয়ালি' (Let's Keep Moving Virtually')-র সদস্যদের সঙ্গে মিলে পরিবেশন করছেন 'টেগোর অ্যান্ড নারীশক্তি' শীর্ষক একটি আন্তঃদেশীয় নৃত্যানুষ্ঠান, যা ফেসবুকে দেখা যাবে ১০ মে, রবিবার, ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ন'টা থেকে।

এখানেও উদ্দেশ্য একাধিক। এক, অবশ্যই কবিপ্রণাম। দুই, করোনা মোকাবিলায় অর্থ সংগ্রহ। রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপনের সঙ্গে রাইলি যুক্ত করেছেন একটি অর্থ সংগ্রহ অভিযান, যেখানে তিনি শ্রোতা-দর্শককে বলছেন তাঁর নির্বাচিত চারটি সংস্থাকে সাধ্যমতো অর্থসাহায্য করতে, দুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, দুটি কলকাতায়। "নানা দেশের নাগরিক এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন যখন, অর্থসাহায্যও নানা দেশেই যাবে," বলছেন রাইলি।

rabindra jayanti online আর সব যথাযথ, শুধু মঞ্চটা আলাদা

ওদিকে ব্রিটেনেই 'হারমনিভার্স' এবং 'ইন্ডিয়ান বেঙ্গলিজ ইন ইউকে' (আইবিইউকে) যৌথভাবে অনলাইনে পরিবেশন করছেন 'সুরাঞ্জলি', যেখানে বিভিন্ন শিল্পীর পৃথক ভিডিও রেকর্ডিং মিলে তৈরি হবে কনসার্ট। অনুষ্ঠানের প্রচারপত্র দেখলে প্রেক্ষাগৃহে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনও তফাৎ বোঝা যাবে না। তফাৎ শুধু নীচের দিকটায় - যেখানে আইবিইউকে এবং হারমনিভার্স-এর ফেসবুক পেজ এবং হারমনিভার্স মিউজিক-এর ইউটিউব চ্যানেলের উল্লেখ পাবেন। অনুষ্ঠানটি এই 'মঞ্চ'গুলিতে দেখতে পাবেন শনিবার, ৯ মে, ভারতীয় সময় রাত সাড়ে ন'টায়।

হারমনিভার্স-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা অনন্যা সরকার জানাচ্ছেন, "অনুষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য অবশ্যই বাঙালি শ্রোতা-দর্শকের কাছে পৌঁছনো, যদিও সকলেই স্বাগত, তবে আরও একটা লক্ষ্য হলো রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার। এখানে বয়সটা বড় কথা নয়। এমন অনেক ভারতীয় বাঙালি আছেন, যাঁদের খুব ইচ্ছে যে ব্রিটেনে জন্মানো তাঁদের ছেলেমেয়েরাও রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনুক, জানুক।" আরও একটি উদ্দেশ্য আছে। "আমরা চাই, ভারতে বসেও বাঙালিরা দেখুন, এই কঠিন পরিস্থিতিতেও কীভাবে কবিগুরুর জন্মদিন উদযাপন করছি আমরা।"

ঘরের কথা দিয়েই শেষ করা যাক। গতকাল থেকেই অনলাইনে অনুষ্ঠান শুরু করে দিয়েছে 'সুর ও শ্রাবণ'। রবিবার, ১০ মে, রাত একটা পর্যন্ত চলবে তাদের অনুষ্ঠান। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে তারা জানিয়েছে, "আমরা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রত্যেক বছর পঁচিশে বৈশাখ পালন করি। কিন্তু এবছর যেহেতু অনুষ্ঠান করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীরা গান করে আমাদের 'সুর ও শ্রাবণ' পেজে পোস্ট করছে।"

ফেসবুকে মূলত লাইভের মাধ্যমেই অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। অনেকে যার জন্য 'Bluejeans' অ্যাপ ব্যবহার করছেন। এছাড়া 'Zoom' ব্যবহার করে একসঙ্গে অনেকের সঙ্গে লাইভ করে সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার পরিকল্পনাও করেছেন কিছু উদ্যোক্তা।

স্মরণকালে এই প্রথম পঁচিশে বৈশাখে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে হচ্ছে না কোনও অনুষ্ঠান। করোনার কামড়ে থমকে গিয়েছে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। সেই বিষাদের সুর কি কিঞ্চিৎ লাঘব করতে পারবে ভার্চুয়াল রবি প্রণাম?

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment