Advertisment

'রবীন্দ্রনাথই প্রথম লেখেন জীবনমুখী গান'

শুধু শুধু নোটেশন, স্বরলিপি ইত্যাদি দিয়ে ভয় দেখিয়ে আগামী প্রজন্মকে রবীন্দ্রনাথের গান থেকে বিমুখ করে রাখার কোনও মানে হয় না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
rabindranath tagore songs

জার্মান শিল্পী স্টেফান স্টপক, এবং প্রখ্যাত গায়িকা শ্রাবণী সেনের সঙ্গে সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিৎ রেকর্ড করেন তাঁদের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম 'টেগোর অ্যান্ড উই'

রবীন্দ্রনাথের গানের কোনও প্রথাগত প্রশিক্ষণ যেহেতু আমরা পাই নি কোনোদিন, তাই আর পাঁচটা গান যেভাবে শুনেছি, রবীন্দ্রসঙ্গীতও আমাদের কাছে সেভাবেই এসেছে। গানের মধ্যেই যে অন্তর্নিহিত যাদু ছিল, তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই। যে সময় জ্ঞানও হয় নি, তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান শোনা। কার গান, তা জানার আগেই মনে গেঁথে গিয়েছে 'পুরানো সেই দিনের কথা'। কিন্তু রীতিগত ভাবে কখনোই শিখি নি। তাই তাঁর গান শুনে বরাবর আনন্দ পেয়েছি। যেহেতু নিয়ম করে শিখি নি, ভালবেসে শিখেছি, তাই তাঁর গান আজও স্বস্তি, আরাম দেয়।

Advertisment

সেই জায়গা থেকেই রবীন্দ্রনাথের গানের, কাব্যের ভক্ত, এবং যত দিন গেছে তত মনে হয়েছে যে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের গান, যা কিনা একদিক থেকে আমাদেরও গান, তা আমাদেরও রেকর্ড করা উচিত।

প্রখ্যাত জার্মান সঙ্গীতশিল্পী-সুরকার স্টেফান স্টপক এবং শ্রাবণী সেনকে নিয়ে আমরা রেকর্ড করি আমাদের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম, 'টেগোর অ্যান্ড উই'। একেবারে আমাদের মতো করে রবীন্দ্রনাথের গান। এখানে আমরা স্বরলিপির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুগমন, বা গানের 'ম্যানারিজম'-এর মধ্যে যাচ্ছি না, কিন্তু একটা গানের যে সত্ত্বা, তার কাব্যের যে অর্থ, আমরা আমাদের সাধ্যমতো তা ধরার চেষ্টা করেছিলাম। যে কোনও কারণেই হোক, খুব জনপ্রিয় হয় অ্যালবামটি, এবং সারা পৃথিবী জুড়ে যেখানেই আমরা পারফর্ম করেছি, আমরা বুঝেছি যে এই অ্যালবামটির মাধ্যমে বহু মানুষকে রবীন্দ্রনাথের গানের দিকে আকর্ষিত করেছে। একইভাবে সফল হয় 'টেগোর অ্যান্ড উই'-র দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ডও।

rabindranath tagore songs ২০১৭ সালে জার্মানির রুডলফস্টাড ফেস্টিভ্যালে জার্মান শিল্পী স্টেফান স্টপকের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনায় সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিৎ

গত প্রায় এক দশক ধরে রবীন্দ্রনাথের গানের একটি ভিন্ন দর্শন আমরা তৈরি করার চেষ্টা করেছি, এবং তাকে ভালো যেমন বলেছেন অসংখ্য শ্রোতা, তেমন সাদরে গ্রহণ করেন নি, এমনও অনেকেই আছেন। আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে এটাই বলার, যে আকাশের রঙ কী, এটা জিজ্ঞেস করলে সবাই বলে নীল, কারণ এটাই শেখানো হয়, কিন্তু কেউ যদি আকাশের রঙকে লাল বা সাদা বা হলুদ বলে, সেটা নাকচ করার কোনও উপায় নেই, কারণ আকাশ সমস্ত রঙই হয়, সেটা শুধু দেখার চোখটা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনলাইন উদযাপনে একই ‘ভার্চুয়াল’ সূত্রে গাঁথা বিশ্বের বাঙালি 

যখনই গানবাজনা নিয়ে ভাবতে বসি, তখনই দেখি যে রবীন্দ্রনাথের গান যেন 'ভাবসঙ্গীত'। অদ্ভুত ভাবে সঙ্গীতের মাধ্যমে ভাবনার প্রকাশ, যা অত্যন্ত বিরল। ইংরেজি 'পপ' গানে বা ভারতীয় রাগসঙ্গীতে বন্দিশের কথায় হয়তো কখনও কখনও খুব জোর দিয়ে আবেগের আমদানি করা যায়, কিন্তু স্রেফ তিন-চারটি অলঙ্করণের মাধ্যমে ভাব ফুটিয়ে তোলা, রূপকের সৃষ্টি করা, তা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের একান্ত নিজস্ব।

বাদ্যযন্ত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাতে গেলে অনেকেই শুদ্ধতা বজায় রাখতে 'স্বরবিতান' খুলে বসেন, আমরা 'গীতবিতান' নিয়ে বসি। কারণ, গান অন্তঃস্থ না হলে আমরা রেকর্ড করি না বা বাজাই না, আর রবীন্দ্রনাথের গান বাজাতে বা গাইতে গেলে সবচেয়ে জরুরি তাঁর বাণীটা বোঝা। আমাদের চিন্তায়, 'জীবনমুখী গান' প্রথম লেখেন রবীন্দ্রনাথ। যে গান মানুষের কথা বলে, মনের গভীরতম আবেগের কথা বলে।

ফলে রবীন্দ্রনাথের গান, আমাদের কাছে অন্তত মনে হয় যে স্রেফ একটা ম্যানারিজম বা ধরন নয়, তাঁর কাব্য এতটাই উন্নত এবং প্রাচ্যের দর্শনে সমৃদ্ধ, যে যুগ যুগ ধরে ম্যানারিজম পুরোনো হয়ে যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের কাব্য কোনোদিন পুরোনো হবে না। এই প্রজন্মের যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন বা করেন, তাঁরা তাঁদের মতো করে আজকের সঙ্গীতের আঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথকে ধরুন, তা কিন্তু প্রয়োজন। তিনি আক্ষরিক অর্থেই কালোত্তীর্ণ। এটা আমরা সকলেই স্বীকার করব, অথচ তাঁকে সেই ১৯৪০-এর দশকের আঙ্গিকেই পরিবেশন করব, এটা তো পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল।

এও দেখেছি, যাঁদেরই আমাদের বা আমাদের মতো সমসাময়িক শিল্পীদের অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের প্রধান বক্তব্য হলো, "রবীন্দ্রনাথ থাকলে এটা করতেন না।" এখানে আমরা বলি, রবীন্দ্রনাথের কাজ তাঁর চেয়েও অনেক বড়, সুতরাং তিনি কী করতেন বা করতেন না, তা ভাবার বোধহয় এখন আর কোনও অর্থ হয় না। সারা পৃথিবীতে যে কোনও স্রষ্টা বা শিল্পী একটা সময় তাঁদের কাজ তুলে দিয়ে চলে যান আগামীর হাতে, এবং এটা আগামীর দায়িত্ব তাঁদের সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেখানে কিন্তু শিল্পীর নির্দেশ আর খুব একটা প্রাসঙ্গিক থাকে না, বা মেনে চলা সম্ভব হয় না।

আরও পড়ুন: নাইটহুড ফিরিয়ে ছিলেন, ২০২০ তে দাঁড়িয়ে জাতীয় পুরস্কারও কি ফিরিয়ে দিতেন রবীন্দ্রনাথ?

সময়ের ওপর এই ভরসাটা রাখা খুব প্রয়োজন। শুধু শুধু নোটেশন, স্বরলিপি ইত্যাদি দিয়ে ভয় দেখিয়ে আগামী প্রজন্মকে রবীন্দ্রনাথের গান থেকে বিমুখ করে রাখার কোনও মানে হয় না। এখানে আরও একটা কথা আছে, স্রষ্টা হিসেবে কেন শুধু রবীন্দ্রনাথের গানের ওপরেই কপিরাইট থাকবে, কেন তাঁর ছোটগল্পে, বা ছবিতে নয়? তাঁর ছবি বা লেখা যেমন অবাধে আমরা ব্যবহার করি, ভেবে দেখুন তো তাঁর গানের ক্ষেত্রে সেই একই কাজ করলে কী হয়। রে রে রব ওঠে না কি সঙ্গে সঙ্গে?

দুই, যে মানুষ এমন একটা সময়ে বেঁচে ছিলেন, যখন তাঁর সৃষ্টি পেয়েছে উন্মুক্ত আকাশ। তাঁর গানের মধ্যে যেমন এসেছে আইরিশ গানের সুর, তেমনই পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বা রাগসঙ্গীত, বা পল্লীগীতি, এমনকি গোঁড়া দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভাব পর্যন্ত দেখা যায়। এই যে আদানপ্রদান তিনি করেছিলেন, এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ কোনও বিশ্বভারতী পাহারায় ছিল না। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী থেকে মুক্ত হয়ে 'বিশ্বভারতের' হওয়া উচিত।

আর নোটেশনের কথাই যদি হয়, তবে বলব, ভারতীয় সঙ্গীতে নোটেশনের কড়াকড়ি কোনোদিনই ছিল না। এর একটা বড় কারণ হলো, ভারতীয় সঙ্গীত লেখা যায় না, কারণ আমাদের গানবাজনা মীড়-প্রধান, তার খটকা, গায়কী, ইত্যাদি অনেক কিছু রয়েছে। ফলে স্বরলিপি কখনোই 'সুরলিপি' হয় না। অতএব আমি যদি স্বরলিপিতে বাঁধা পড়ে যাই, তবে রবীন্দ্রনাথের গানে কোনও উত্তরণ আমি আর দেখতে পাব না। তাঁর গান জীবনের বিভিন্ন ধাপে আমাদের কাছে বিভিন্ন রূপে ধরা দেয়। সেটাই আমাদের মতে 'রাবীন্দ্রিক'। আমরা রাবীন্দ্রিক শব্দের সঙ্গে 'ম্যানারিজম' গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু 'রাবীন্দ্রিক' কথাটা একটা চেতনা, একটা দৃষ্টিভঙ্গি, একটা দর্শন। তাই 'ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে' থেকে মুক্তি আকাশে ছড়িয়ে পড়ে, একই পঙক্তিতে।

আমরা যদি রবীন্দ্রনাথকে শুধু ম্যানারিজম-এ আবদ্ধ করে রাখি, তবে হয়তো ঠিক করব না। সময় তো কপিরাইট মানে না, তাই সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সব সৃষ্টিই নতুন মাত্রা পায়। সেখানে কোনটা ঠিক অথবা ঠিক নয়, তা নির্ধারণ করার জায়গায় আমরা কেউই নেই। জন্মদিনে সবাই তাঁকে স্মরণ করি, কারণ এই কঠিন অবস্থায় তিনিই দিশা দেখাতে পারেন। তিনিই বলতে পারেন যে বিপদে 'রক্ষা' করার কৃপা চাই না, 'বিপদে আমি না যেন করি ভয়'।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment