Rabindranath Tagore Birth Anniversary Today: বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুই মাস পরে, কলকাতায় গিয়েছি, প্রেসিডেন্সি কলেজের একজন অধ্যাপিকার সঙ্গে পরিচয়। আলাপের শুরুতেই ঝগড়ার সুর, "আপনারা ভাই সব পারেন। আমাদের প্রাণের গানটি আর গাইতে পারব না, পাবলিকলি গাওয়া নিষেধ, এমনকি রেডিওতেও বাজানো চলবে না, কোনো গায়ক গায়িকার রেকর্ডও বেরুবে না।" শুনে হতভম্ব। নিশ্চিত ধাঁধা। জিজ্ঞেস করি, কোন গান? কার লেখা?
অধ্যাপিকা: "রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা'। আপনাদের, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। আহা! কী গান! ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়কালে লেখা। এই গান তখন বাংলায়, মানুষের প্রাণে কী জোয়ার এনেছিল ইতিহাস সাক্ষী। এই গান আমাদের, প্রতিটি বাঙালির রক্তে, শিরায়-উপশিরায়, মজ্জায়।"
বলি, "'আমার সোনার বাংলা' বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে লেখা, বঙ্গ ভেঙে গেছে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে, পূর্ব বঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পরে বাংলাদেশ। বঙ্গের পূর্ব নেই, পশ্চিম আছে। রবীন্দ্রনাথই বিশ্বের একমাত্র কবি, যাঁর গান দুটি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত, ভারতে ও বাংলাদেশে। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতেরও সুর রবীন্দ্রনাথের। আমাদের সৌভাগ্য রবীন্দ্রনাথ বাঙালি।"
অধ্যাপিকা: "নিশ্চয়ই আমরা গর্বিত। কিন্তু গোটা ভারত কি? রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত ছাড়া রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ, নাটক ভারতের অন্যান্য ভাষায় কতটা পঠিত? আলোচিত? সঠিক অনুবাদও হয়নি। প্রচারিত হয়নি রবীন্দ্রনাথ। এখনও যেন দুই বঙ্গেই আবদ্ধ। 'যেন' বলছি এই কারণেই, রবীন্দ্রনাথকে গোটা ভারতে ছড়িয়ে দেয়নি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।"
আরও পড়ুন: ইউরোপের সময়কাল, এখন রাজনৈতিক
বললুম, "সমস্যাও আছে। বিশেষত যথাযথ অনুবাদ। রবীন্দ্রগান, কবিতা, সাহিত্য, এতই বিপুল, ভারতের নানাভাষীর সাধারন্যে পৌঁছে দেওয়া সহজ-সরল নয়, অতীব কঠিন। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদও মাতৃভাষার মতো হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ জটিল।"
কতটা জটিল টের পেয়েছিলুম রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে। বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে (দশদিন ব্যাপী উৎসব) এক সন্ধ্যায় আলোচ্য রবীন্দ্রনাথ। বক্তা পঙ্কজ মিশ্র। আজকের বিশ্ব সাহিত্যে নাম করেছেন। লেখেন ইংরেজি ভাষায়। বহু পুরস্কারে সম্মানিত। কেন পুরস্কার পান, পুরস্কারদাতারা জানেন।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সাহিত্য (আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্য) নিয়ে কোনও জ্ঞানগম্যি নেই। প্রমাণ পাই বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে রবীন্দ্র সেমিনারে। স্কুলে পড়াকালীন ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের লেখা, জেনেছেন, স্কুলে গেয়েছেন। ব্যস, এইটুকুই। এই নিয়ে গপ্পো। বক্তৃতা তথা আলোচনা। আরেকজন আলোচক আলতাফ টায়ারওয়ালা। ইংরেজি ভাষায় দুটি উপন্যাস লিখে খুবই খ্যাতিমান। বার্লিনে ডাড (DAAD) স্কলার। তিনি বম্বের। পঙ্কজের চেয়ে অনেক বেশি রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন। বুঝতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস নাটক প্রবন্ধে ভারতের মূল চরিত্র।
আলতাফের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ বৈশ্বিক সমকালীন। কতটা প্রয়োজন, কতটা মানবিক। কতটা ভারতীয়। কতটা সামাজিক, রাষ্ট্রীয়।
সেমিনারে (তথা আলোচনায়) সঞ্চালক এবং প্রধান বক্তা ছিলুম, বলতেই হয়, রবীন্দ্রনাথ কেন বাংলা, ভারত, বিশ্বের কবি। একজন কবি কী অভিধায় বৈশ্বিক। কেন দেশকাল বিভাজন সত্ত্বেও বৈশ্বিক, মানবিক। রবীন্দ্রনাথের মানবতা, তাঁর লেখায়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আজ সর্বজনীন - শ্রোতাদের নানা প্রশ্নে মোদ্দা কথা বলি, আমাদের সাহিত্যের, জনজীবনের ভাষা রবীন্দ্রনাথের। আমাদের সামাজিক, মৌলিক চিন্তায় পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষে রবীন্দ্রনাথ। আমাদের জীবনধারায় মিশ্রিত। সব বাঙালি জানে না, বোঝেও না। আজকের রাজনৈতিক প্রহেলিকায় রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাঙালির মুক্তি নেই। রবীন্দ্রনাথ এমনই মহামানব।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা ঝামেলার 'ইতিহাস' আমরা জানি। রবীন্দ্রশতবর্ষে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হরেক হুজ্জতি। পাকিস্তানপন্থী ইসলামিরা রবীন্দ্রবিরোধী। রবীন্দ্রপ্রেমিকরা বিপ্লবী। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা অনুষ্ঠান। কবি জিয়া হায়দার কবিতায় লেখেন, "রবীন্দ্রনাথ আমার অস্তিত্বে ঈশ্বর।" বিখ্যাত 'সমকাল' সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত এই কবিতা মুহুর্তে ছড়িয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর, ঈশ্বরে পরিণত। পাঠকের মুখে মুখে। সরকারের কোপানলে জিয়া হায়দার।
মনে হয় এখন, তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানে, ষাটের দশকে, রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধকরণে, রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ে, ঘরে ঘরে। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনাই চড়া দামে বিক্রী, বাজার থেকে উধাও। বহু প্রকাশকও 'রাতারাতি' বই ছাপেন। নিষিদ্ধ বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ, গোপনে বিক্রি বেশি।
আরও পড়ুন: সত্যজিৎ ও ঢাকাইয়া কুট্টি
পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রবিদ্বেষের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষও দুই ভাগে বিভক্ত। কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক অধ্যাপক বুদ্ধিজীবিরাও বিভক্ত। প্রগতিশীল শিল্পীসাহিত্যিক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবি কুলের বড় অংশ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে। ছাত্রসমাজ রবীন্দ্রনাথের পক্ষে। প্রগতিশীল রাজনীতিকরাও। এমনকী শিক্ষিত মানুষের অধিকাংশই।
রবীন্দ্রবিদ্বেষে আরও একটি মস্ত ঘটনা, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রচর্চার বাড়ন্ত, অন্যদিকে বিস্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী 'নব উন্মেষে জাগ্রত'। শহর গঞ্জ মফস্বলে নতুন গায়কগায়িকা। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে (গত দুই দশকে) প্রতি বছর, প্রতিটি মেলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিযোগিতা। একটি দৈনিক পত্রিকার পরিসংখ্যানে জেনেছিলুম, দেশজুড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি নবীন শিল্পী এখন রীতিমতো নামীদামী। টিভি চ্যানেলে আকছারই দেখা যায়। প্রতিবছরই বহু শিল্পী বিশ্বভারতীর স্কলারশিপ পাচ্ছেন, সরকারি স্কলারশিপ, ভারত সরকারের। অনেক শিল্পীর কদর দুই দেশেই। অনেকে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গে, ভারতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন।
বিদেশেও এখন (বাঙালি শহরে) রবীন্দ্রসঙ্গীতের জমাটি আসর। নিউ ইয়র্কে, লন্ডনে, শিকাগোয়, টরোন্টোয়, প্যারিসে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্কুল। দিনে-দিনে ছাত্রছাত্রী বাড়ছে। আসলে ভাষাকে কাছে কাছে পাওয়া, দেশকে কাছে পাওয়া, 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা', 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। রবীন্দ্রনাথকেও ভালোবাসে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাঙালি পঙ্গু, অথর্ব - এই ভালোবাসা না কী, কে একজন লিখেছিলেন, "ফ্যাশনে পরিণত"। ফ্যাশন যে কত দেশ মাটি জল হাওয়া সংলগ্ন, রবীন্দ্র জন্মদিনে কবির ছবিসম্বলিত রকমারি রঙ্গীন টি-শার্টের ছড়াছড়ি, বিক্রী। গায়ে চড়িয়ে রবীন্দ্র অনুষ্ঠানে হাজির। কাগজে, টিভিতে ছবি দেখেছি। গত তিন বছরে, রবীন্দ্রছবির টি-শার্ট উপহার পেয়েছি চারটে, ঢাকা থেকে পাঠিয়েছেন বন্ধুরা। এবারও পাব, জানিয়েছেন কেউ কেউ। রবীন্দ্র টি-শার্ট গায়ে দিয়ে বার্লিনে ঘুরব, আহা! কী আনন্দ। ও আমার দেশের মাটি। আমার রবীন্দ্রনাথ।