ভেঙে ফেললাম একটা চালু রীতি। হ্যাঁ, ধন্দে পড়তে পারেন পাঠকরা। তাই একটু গৌরচন্দ্রিকা। শিরোনামে বিস্ময় চিহ্ন একটা খটকা। এর সঙ্গে মুক্তধারা। এই রূপকটি নাটক থেকেই ধার করা আর শেষের চিহ্নটি আমার চিন্তনের অবাক অভিব্যক্তি। কেন আমাদের বাংলা থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথ কেবলই নাটককার হয়েই রইলেন(তাও তেমন সফল কেউ নন)। কেন আমরা ঔপনিবেশিক লেগ্যাসির হ্যাংওভার কাটাতে এতটা সময় নিলাম...বারেবারেই বিশ্বের থিয়েটারী প্রতিভাদের প্রযোজনা সংক্রান্ত মতামতে শিশুসুলভ উদ্গীরণে উদ্বাহু নৃত্য করলাম! অথচ আমাদের ঘরের ভেতরেই তো ছিলেন তিনি---বাংলার আধুনিক থিয়েটারের পথিকৃৎ--নাট্য-নকশাকার এবং অভিনেতা যিনি তৎকালীন সমস্ত মঞ্চসফল থিয়েটারি অভিব্যক্তিকে বাতিল করে নতুন এক থিয়েটারি যাত্রা শুরু করেছিলেন একেবারে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মগ্ন আনন্দে।
মনে হয় আমাদের মননে এই গোলমাল বাধিয়েছেন কিছুটা রবীন্দ্রনাথ নিজেই। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব বারেবারেই স্ব-মূল্যায়নে টিপ্পনি কেটেছেন নানান উপলক্ষে। যেমন--তিনি নিছকই কবি এবং বাঙালি, যদি তাঁর সমস্ত কৃতি অস্বীকারও করা হয় তবু তাঁর গানকে আঁকড়ে থাকবে দীর্ঘদিন। অবশ্য পরে নিজেই,সক্ষোভে বলেছিলেন কবি হওয়ার কারণেই সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি রাজনীতি বিষয়েও তাঁর কোন মতামতই সমকালীন সাধারণ্যে তেমন গুরুত্ব পায়নি। যেন কবিরা এমনি দায়হীন বাস্তবতার বিচারহীন মতামত দিয়েই থাকে। আর দ্বিতীয়টির প্রায়োগিক উদাহরণ তো ভুরি ভুরি।'দাদার কীর্তি 'ছায়াছবিতে প্রেমিকযুগলের ছোটবেলার বরবউ খেলার চিত্রকল্পে নেপথ্যে বাজে 'মনে পড়ে কতো না দিনরাতি আমি ছিলেম তোমার খেলার সাথী'! 'জীবনদেবতা' কবিতার সেই অন্তর্লীন চির-আমির কাছে কবির সুরে গাঁথা আর্তি... 'আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে দোলাও'---তারই সঞ্চারীর এমন হাস্যকর প্রয়োগ---হতাশায় বুক ভাঙে। রবীন্দ্রসংগীত এইভাবেই বাজে সকাল বিকেল। একেবারে ছেলে ভুলোনো ভাববিপর্যয়ে।
সে যাক লিখতে বসেছি থিয়েটারের কথা। ১৯১২..লেখা হলো ডাকঘর। তারপর ১৯১৩...নোবেল পাওয়ার ছ'মাস আগেই আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে অ্যাবে থিয়েটারে যাকে বলে world premiere লেখকের নিজস্ব প্রযোজনার আগেই। এই প্রথম কোনও পশ্চিমি থিয়েটার কোম্পানি প্রযোজনার জন্যে বেছে নিল একজন আধুনিক ভারতীয় নাটককারের রচনা। সারা পৃথিবীতে অসংখ্য দেশে অসংখ্য ভাষায় অভিনীত হয়েছে ডাকঘর। এমনকি নাৎসি জার্মানির জেলেও। বাংলা থিয়েটারে গর্ব করে এ কথা বারবার উচ্চারিত হয়নি তো! তর্কের খাতিরে বলাই যায় অনেক ঋদ্ধ লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু এতটা গুরুত্ব কি দেওয়া হয়েছে যাতে থিয়েটারের নবীন প্রজন্ম প্রাথমিক আলাপনেই বুঝে নিতে পারে রবীন্দ্রনাথ তাদের থিয়েটারের সহযাত্রী! বরাবরই তাঁর থিয়েটারি কর্মকাণ্ড ওই আশ্রমের পড়ুয়াদের নিয়ে একটা অ্যামেচারি বিনোদন হিসেবেই দর্শিত থেকেছে, এবং থেকেছে উপেক্ষিতও। সেসব প্রচেষ্টা সমূহের কোনও সংকেতই আমাদের থিয়েটারে বহন করে ঋদ্ধ হইনি আমরা।
একটু কি রূঢ় হয়ে পড়ছি? হয়ত বা। কিন্তু দুনিয়া জুড়ে প্রতিবাদী থিয়েটারের মানুষজন প্রোসেনিয়মের ঘেরাটোপ ভেঙে যে কোনও পরিসরকেই থিয়েটারি পরিসর করে তোলার কথা ভাবছেন.... ভাবছেন এমন একটা পরিপ্রেক্ষিতে, যখন দেখা যাচ্ছে যে থিয়েটার একমাত্র সামাজিক শিল্প...পারস্পরিক জীবন্ত আলাপচারিতাই যার শক্তি, তাকে বেঁধে ফেলা হয়েছে একটা চৌকো বাকসে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধানে। অথচ আমাদের হাতের কাছেই আছেন রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর অভিজ্ঞতার নির্যাস।
১৬ বছর বয়সে জ্যোতিদাদার বঙ্গীকরণে ম্যলিয়েরের Le Bourjois Gentilhomme নাটকে অভিনয় করার সুবাদে থিয়েটারের সংগে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। প্রায় আমৃত্যু সেই সংযোগ ছিল বর্তমান। ছবি আঁকার মত হঠাৎ মন দেওয়া কোন মাধ্যম ছিল না থিয়েটার তাঁর কাছে। ১৮৮১ থেকে ১৮৯৭ এই ষোলবছরে লেখা হল মোট ৯টি নাটক। এই পর্বের সব প্রযোজনাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। তার মধ্যে দুটি নাটক এখনও প্রযোজনায় কদর পায়..বাল্মীকিপ্রতিভা এবং বিসর্জন। বিশেষত শেষেরটি-- যে টেক্সট লেখা হয়েছিল ১৫৮ বছর আগে, যে কথা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে প্রায় অকল্পনীয় মনে হয়! থিয়েটার যদি সমকালের দর্পণ হয় তবে বলতে হয় আজও বিসর্জন সমকালীন। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে মননের জগতে কতটুকু এগিয়েছি আমরা? আয়নায় মুখ দেখতেই হয়।
১৯০১ সালে পাকাপাকি চলে এলেন শান্তিনিকেতনে। অন্যান্য অসংখ্য সৃষ্টিশীল কাজ আর কঠিন দায়দায়িত্বের বোঝা সঙ্গে নিয়ে। এর মধ্যে থিয়েটার নামক শিল্প মাধ্যমটি যে তাঁকে চঞ্চল করে রেখেছে তার প্রমাণ পাই ১৯০২ সালে লেখা 'রঙ্গমঞ্চ' নিবন্ধে। তিনি বলছেন পশ্চিমি দুনিয়ায় থিয়েটার নির্মাণে আনুষঙ্গিক খরচে এমন টাকার ঝনঝনানি যে কবি আর অভিনেতার সৃষ্টিশীলতা তার ছায়ায় ঢাকা পড়ে। আমাদের দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে সে কোনও কাজের নয়। বাদল সরকার কে মনে পড়ছে না?
রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবনা symbolism...সাংকেতিক চিহ্ন, যাকে খুঁজতে হবে জনমানসের পরম্পরার সূত্রে। সংস্কৃত নাটক(এলিটদের) অথবা আমাদের যাত্রায় (সাধারণের) এমন অসংখ্য দিকচিহ্ন ছড়ানো। এখানে একটা অন্ধ গলিতে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কখনওই যাত্রার নকল চাইছেন না...চাইছেন ওই পরম্পরার সংকেতে আদ্যন্ত একটা আধুনিক থিয়েটার। চাইছেন সামান্য দৃশ্যপটে প্রস্তাবিত কল্পনার বিস্তার...এককথায় থিয়েটারে নান্দনিক বিমূর্ততার বিকাশ। থিয়েটারি সজ্জায় পরিসর বিন্যাসে নিখুঁত বাস্তবের তীব্র বিরোধী ছিলেন তিনি। তাঁর মতে এতে দর্শক বাস্তবের হুবহু অনুকরণ দেখতে চাওয়ার ফাঁদে পড়ে। পড়েই তো! বাথরুমের দরজার পাশে গামছা ঝোলানোর দড়ি, সিটি দেওয়া প্রেসারকুকার, টিউবওয়েলে জলপড়া... এই দেখতে হল ভরিয়ে দেয় পাবলিক... হারিয়ে যায় থিয়েটারের মূল শক্তি...তার বিমূর্ত কল্পনার ভাষা।
আজ থেকে ১১৭ বছর আগে এই শান্তিনিকেতন পর্বে রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি বাতিল করেছিলেন প্রোসেনিয়ম আর্ক। উপেক্ষা করেছেন কলকাতার পেশাদারি মঞ্চে প্রযোজনার হাতছানি। অভিনয়ের জন্যে বেছে নিয়েছিলেন খোলা মঞ্চ --অনাড়ম্বর পরিসর সজ্জা---প্রায় কিছুই নেই--ডাকঘরে ঝোলানো হলো একটা শূন্য খাঁচা। বাস্তবতাবর্জিত। ১৯০৯ থেকে ১৯২৬...আবার ন'টি নাটক....যেন ল্যাবরেটরি থিয়েটার...নাটকে দৃশ্য, নির্দেশিকা অতি সংক্ষিপ্ত। শুধু 'পথ' বা অন্ধকার ঘর বা কুঞ্জবনের ধারে এমন কিছু আভাস অর্থাৎ নকশাকারই(পরিচালকের আধুনিক প্রতিশব্দ) ব্যাপারটা বুঝে নেবেন। এর মধ্যে মুক্তধারার আরম্ভে পরিসরটি একটু বিশদে বর্ণিত। মজার ব্যাপার ডাকঘরে তেমন কিছুই নেই। শুধু ১,২,৩ এমত শিরোনামে সংলাপের ঘাতপ্রতিঘাত। এত অত্যাধুনিক বয়ান যেখানে নাট্যের লিখিত বয়ান তার সাহিত্যিক মূল্য নস্যাৎ করে প্রযোজনার কার্যকর পাণ্ডুলিপি মাত্র হয়ে ওঠে। থিয়েটারের গোপন শক্তি যে তার প্রযোজনায় সাহিত্যের ভাষাকে থিয়েটারের ভাষায় অনুবাদ করা...এই আধুনিক সংজ্ঞা তিনি অনুভবে বুঝেছিলেন। তাই text লেখার সময় এত অস্থির থাকতেন। মহড়ায় কতবার পাল্টে ফেলতেন সংলাপ ...আয়তন...কখনো ছাঁটতেন কখনো বিশদ হতেন। রাজা হয়ে গেল অরূপরতন কিংবা রাজা ও রাণী হলো তপতী। অর্থাৎ উপস্থাপনার ভাবনা যেন লিখিত বয়ান ধারণ করতে পারে। যেমন সুরকে ধারণ করতেই তাঁর গানে বসলো কথা তেমনি। শুধু আধুনিক নয় এ হলো অত্যাধুনিক চলন। আর অভিনয়ে বাতিল করেছিলেন হেনরি আরভিং এর' 'অনুকরণীয় বাস্তববাদ'(imitative naturalism) এর ধারাকে। সে সময়ে দাঁড়িয়ে naturalism বর্জনকে যুগান্তকারী বলেই আখ্যায়িত করা যায়। মুক্তধারায় অভিজিতের ভেসে যাওয়ার মেলোড্রামা নেই...আছে ঘটনার রিপোর্টিং...অ্যালিয়েনেশন।
কথা শেষ হতে চায় না। বিশেষত যখন প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ । তবু থামতে হয়। কিন্তু নতুন প্রজন্মের রবীন্দ্র প্রযোজনার একটা দুটো অভিজ্ঞতা না বলে থামি কেমনে? 'ঊহিনী' র প্রযোজনা 'মুক্তধারা'(নির্দেশনা-অদ্রিজা দাশগুপ্ত)...বিন প্রোসেনিয়ম যে কোন পরিসরে শুধু কিছু ওড়না লাঠি আর একদল অভিনয় শিল্পী। এমনকি চরিত্রের ওপরেও কারোর মৌরসf পাট্টা নেই...একেবারে মুক্তছন্দে সংলাপ অভিব্যক্তি পায়...মুগ্ধ হয়েছি। আর পথসেনা র 'রক্তকরবী'। সেও একদম খোলা পরিসরে। কিচ্ছু নেই শুধু কয়েক গুচ্ছ সরু দড়ি...কখনও জাল কখনো কলস...গোল পরিসর দাপিয়ে বেড়ায় অভিনয় শিল্পীরা। আর নন্দিনী একেবারে শহুরে পালিশহীন মাটির মেয়ে...অমার্জিত তার অভিব্যক্তি।
প্রকৃতপক্ষে পরিসরের নিছক ত্রিমাত্রিক বয়ানে রবীন্দ্রনাথ আঁটবেন না। চাই চতুর্থ মাত্রা। অর্থাৎ পরিসর তার সম্ভাবনা এবং সীমাবদ্ধতায় লিখিত বয়ানের থিয়েটারf সাংকেতিক ভাষার আভাস দেবে। পড়তে হবে তাকে। যেমন নন্দলাল বলেছিলেন ---'গাছ আঁকবে তো যাও প্রার্থনায় বসো। বলো বৃক্ষদেবতা তোমার স্বরূপ দেখাও।' তেমনি অনুভব করতে হবে পরিসরের চতুর্থ মাত্রাকে। তবেই প্রোসেনিয়মের বাকসো থেকে মুক্ত হবে রবীন্দ্রনাটকের ধারা ... মুক্ত হবেন রবীন্দ্রনাথ, আমাদের থিয়েটারে। কেমন সে থিয়েটারের শরীর? সে কথা হবে অন্য একদিন অন্য অবকাশে।
(কাবেরী বসু নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে। অ্যাজিট প্রপ দিয়ে শুরু করে এখন তাঁর যৌথ যাত্রা পরিসর-নির্ভর থিয়েটারের পথে, চতুর্থ মাত্রায়)