সমস্যায় পড়েছি, গুরুতর সমস্যা। "রবীন্দ্রনাথ কোন দেশের কবি? ভারতের না বাংলাদেশের? বলা হয় ভারতীয়, কিন্তু বাংলাদেশীরা তাঁকে নিয়ে মাতোয়ারা। ভারতীয়রা নয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মমৃত্যু দিনে ভারতীয়দের কোনও অনুষ্ঠান নেই, বাংলাদেশীদের নানা আয়োজন, নানা অনুষ্ঠান। বিষয়টি রহস্যজনক, খোলাসা করুন।"
জার্মানদের প্রশ্নের একটিই উত্তর, "রবীন্দ্রনাথের জন্ম ভারতে ব্রিটিশ আমলে, মৃত্যুও ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে, তখন ছিল ভারতবর্ষ, রবীন্দ্রনাথ ভারতের, জন্ম বাংলায়। ভারত ভাগের পরে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয়, কিন্তু মূলত বাংলার। একদা পূর্ব বাংলা, আজকের বাংলাদেশ, ছিল তাঁর আপন, প্রিয়ভূমি। রবীন্দ্রনাথের গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। তাঁর গান ভারতেরও জাতীয় সঙ্গীত। এমনকি শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতের সুরও তাঁর।" বিস্মিত জার্মান বন্ধুকুল। "একজন কবি তিন দেশের জাতীয় সঙ্গীতের আষ্টেপৃষ্ঠে? পৃথিবীর কোনও দেশেই এমন ঘটনা নেই, বিস্ময়কর।"
তা হোক, কিন্তু ভারতীয় একজন রাজনীতিক বলছেন, "রবীন্দ্রনাথ বাংলার কবি (পশ্চিমবঙ্গ বুঝিয়েছেন), গোটা ভারতের নয়।" রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ইদানীং তর্ক ভারতের রাজনৈতিক মহলে, তর্কের মূলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চাঁচাছোলা মন্তব্য, সঠিক মন্তব্য ভারতের দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র-মানবতা নিয়ে। অনেকের কাছেই অসহ্য।
রাজনীতিকের কথা, 'রবীন্দ্রনাথ বাংলার কবি'। এই মন্তব্যে বাংলাদেশীরা মহাখুশি। বাংলা বলতে এখন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ নয়। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অঙ্গরাজ্য। বাংলাদেশীরা বলেন, "রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার কবি, বাংলা ভাষায় লিখেছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, ভারতের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নয়, রবীন্দ্রনাথ আমাদের, পশ্চিমবঙ্গের নয়। আমরাই রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয়সঙ্গীত করেছি, রবীন্দ্রনাথ আমাদের।"
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিদেশে বাংলাদেশীদের যে মাতম, বিস্ময় মানি। পশ্চিমবঙ্গীয়রা বলেন, "রবীন্দ্রনাথ ভারতীয়, কেন আঞ্চলিকতায় আবদ্ধ রাখব?" রাখেন না ঠিকই, কিন্তু রবীন্দ্র জন্মমৃত্যু দিনে কোনও অনুষ্ঠান করেন না, করেন বাংলাদেশীরা। জাঁকজমক অনুষ্ঠান। গান, নৃত্য, আলোচনা, রবীন্দ্রনাথের অঙ্কিত ছবির প্রদর্শনী। রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে তৈরি ছবির প্রদর্শনী।
গত বছর বার্লিনে বাংলাদেশীরা প্রতিষ্ঠা করেছেন 'ট্যাগোর সোসাইটি'। সোসাইটিতে পশ্চিমবঙ্গের কোনও বাঙালি নেই কেন?" জিজ্ঞেস করি সোসাইটির কর্ণধার মঈন চৌধুরীকে। বলেন, "এক, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন প্রশ্ন তুলেছেন, এই সোসাইটি সম্পূর্ণত বাংলাদেশীদের, পশ্চিমবঙ্গের একজনকেও কোনও 'পদ' দেওয়া হয়নি, কেবল সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে; দুই, মাসিক ১৫ ইউরো চাঁদা দিতে অস্বীকৃত; তিন, 'আমার সোনার বাংলা', বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্র জন্মমৃত্যু দিনে গাওয়া হবে, 'জনগণমন অধিনায়ক', ভারতের জাতীয় সঙ্গীত, গাওয়া হবে না; চার, রবীন্দ্রনাথকে শুধু বাংলাদেশের স্বার্থেই ব্যবহার করা হচ্ছে।"
মিথ্যে নয় এই অভিযোগ। মঈন চৌধুরীর কথা, "ট্যাগোর সোসাইটি বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, এখানে ভারত কেন? ভারতীয় তথা পশ্চিমবঙ্গীয়রা রবীন্দ্রনাথের নামে আরেকটি সোসাইটি বা কালচারাল সেন্টার করতে পারে, করবে না, করছেও না। না করার কারণ রাজনীতিও আছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির সঙ্গে ভারতীয় অন্য ভাষাভাষী যুক্ত হতে অরাজি। রবীন্দ্রনাথকে জাতীয় কবির সম্মান দিলেও, বলে, রবীন্দ্রনাথ বাংলার কবি। এই যদি ভাবনা, তাহলে রবীন্দ্রনাথকে কেন আমরা বাংলাদেশের আপনজন করব না?বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, ভারতের নয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন বাংলার চেয়ে হিন্দির কদর বেশি।"
বার্লিন সহ গোটা জার্মানিতে, ইউরোপে, এমন কী উত্তর আমেরিকায়, নিউজিল্যান্ডে, অস্ট্রেলিয়ায়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির চেয়ে বাংলাদেশীর সংখ্যা চারগুণ। পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু করে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী, মৃত্যুজয়ন্তী বাংলাদেশীরাই পালন করে। পশ্চিমবঙ্গীয়রা নয়। করলে, কলকাতার গৌতম বসুরায় বলেন, "আঞ্চলিকতার প্রশ্ন ওঠে। ভারতীয় অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষ যদি সামিল না হন, রবীন্দ্রনাথও আঞ্চলিক হয়ে যান।"
মিথ্যে নয় গৌতমের বয়ান। নয় বলেই বাংলাদেশীরা রবীন্দ্রনাথকে বার্লিনে এবং জার্মানিতে 'বাংলাদেশী' হিসেবেই গৌরবান্বিত করছেন। জন্মমৃত্যু তিথি পালন করছেন মহাসমারোহে। জার্মানরাও যোগ দিচ্ছেন শ্রোতা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের পাঠ বাংলায় এবং জার্মান অনুবাদে। গানও বাংলায়, জার্মান অনুবাদে।
বার্লিনের একটি ডাকসাইটে দৈনিকের একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, "আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ ভারতের কবি, কিন্তু বাংলাদেশীরা কেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এতটা গর্বিত, মাতোয়ারা? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিশাল অনুষ্ঠানমালা?" কী বলব, সমস্যা এখানেই।