ডানকুনি থেকে বাসে গাংপুর নামার আগে কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করা হল নিশ্চিত হওয়ার জন্য। 'দাদা, আঁইয়া গ্রাম এটাই তো'? কন্ডাক্টরের চোখে মুখে জিজ্ঞাসা দেখে বলতেই হল, 'মানে রাবড়ি...', একগাল হেসে বাসের সিঁড়ি থেকে উত্তর এল, 'নেমে যান, সোজা রাস্তা দিয়ে চলে যাবেন। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই রাবড়ি তৈরি হয়"। হুগলী জেলার চন্ডীতলা ব্লকের গ্রাম। পোশাকি নাম একটা ছিল বটে, তবে সে নাম কেউ মনে রাখেনি। লোকের মুখে মুখে আঁইয়া এখন রাবড়িগ্রাম।
মশাটগ্রামের একটু পরেই গাংপুর। সত্তর-আশিটা ঘর মিলিয়ে ছোট্ট গ্রাম। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটা পরিবারই এখানে রাবড়ি বানায়। চাষবাসের পাশাপাশি রাবড়ি বানিয়েই হয় এদের রোজগার। শান্ত ছিমছাম আঁইয়া। ধানের গোলা, নিকোনো উঠোন, তাতে এসে পড়া রোদে শুকোতে দেওয়া ধান, ছবিটা একেবারে বাংলার আদর্শ গ্রামের।
আরও পড়ুন, ৮২ বছর ধরে কলকাতাবাসীকে ফোম দেওয়া পুডিং খাইয়ে আসছে এই ক্যাফে
দাওয়ায় বসে খুটে খুটে একটা দুটো ধান খাচ্ছে বাড়ির পায়রা। উঠোনে মেলা আছে বাড়ির মহিলাদের নরম লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি। দুপুর বেলা গ্রামের রাস্তা ধরে গেলে বাইরে থেকে আওয়াজ নেই তেমন। কে বলবে, পরের সকালে কলকাতার ওলি-গলির সব মিষ্টির দোকানে রাবড়ি পৌঁছে দেবে এই গ্রাম? অবশ্য দরজা ঠেলে হেঁশেলে পৌঁছোলেই দেখা মিলবে ইয়া বড় বড় কড়া। ভর দুপুরেও দুধ জাল হচ্ছে তাতে।
দুধ একটু ঘন হলে তালপাতার পাখা দিয়ে কড়ার ওপর জোর হাওয়া দিচ্ছেন বাড়ির মেয়ে-বউরা। চাষবাসের কাজ থেকে একটু ছুটি পেলে, অথবা দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি এসে বাড়ির ছেলেরাও হাত লাগাচ্ছে রাবড়ি বানানোয়। হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করলে কড়ায় জমছে গাঢ় সর। শোলার কাঠি দিয়ে সুনিপুণ কৌশলে তা তুলে নিয়ে জমিয়ে রাখা হচ্ছে কড়ার গায়ে।
একটু ঠাণ্ডা হলে করার গায়ে লেগে থাকা পুরু সর কেটে কেটে ডুবিয়ে রাখা হচ্ছে ক্ষীরে। নানা মাপের পাত্রে এভাবেই রোজ রাতে সাজিয়ে সাজিয়ে রাখা হয় রাবড়ি। যে দোকানের যত চাহিদা, সেই মতো আলাদা আলাদা মাপের পাত্র। ভোর না হতেই বাড়ির পুরুষ সদস্যরা বেড়িয়ে পড়বেন শহরের উদ্দেশে।
গ্রামের কেউ কেউ দু'প্রজন্ম ধরে রাবড়ি বানাচ্ছে, কেউ আবার তিন প্রজন্ম। বড়দের দেখে দেখেই হাত পাকিয়েছেন এ প্রজন্মের কারিগররা। শুভেন্দু বালতি চাকরি করেন ডানকুনির কাছে এক বেসরকারি কারখানায়। ছুটির দিন মা আর পিসিকে হাতে হাতে সাহায্য করে দেন। বাবার সাথে কলকাতার নামী দামি দোকানে গিয়ে রাবড়ি চেখে দেখিয়েছেন শুভেন্দু, যদি কেউ বায়না দেয় এই আশায়।
আরও পড়ুন, সাবান দিয়ে হাত ধুলে তবেই পাবেন ফুচকা, সঙ্গে অ্যাকোয়া গার্ডের তেঁতুলজল
"শীত পড়লে বাড়ে রাবড়ির চাহিদা। বর্ষাকালে মাঝেমাঝেই বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা। কলকাতার দোকান বন্ধ মানে আমাদেরও ব্যবসা বন্ধ", জানালেন বছর পঞ্চাশের কল্পনা বালতি। নিয়মিত ৬০ থেকে ৭০ লিটার দুধের রাবড়ি হয় গ্রামের প্রতিটা বাড়িতে। বাড়িতে কম বেশি সবার নিজেদের গরু থাকলেও ভোর হতে না হতেই জগতবল্লভপুর, জাঙ্গিপাড়া থেকে আসে দুধ। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় কর্মযজ্ঞ। নিয়মিত সাত থেকে দশ কড়া দুধ জাল হয় বাড়িতে বাড়িতে।
লোকের মুখে মুখে হালে জনপ্রিয়তা বেড়েছে রাবড়িগ্রামের। মাঝে মধ্যেই শহর থেকে আট থেকে আশির দল পৌঁছে যাচ্ছে মিষ্টিমুখ করতে। ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কিলো দরে দেদার বিক্রি হচ্ছে রাবড়ি। শহরের দোকানে এলেই অবশ্য সেই রাবড়ির দামই কম করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি। স্থানীয় অনুষ্ঠান, বিয়ে বাড়ি মুখেভাতে রাবড়ি সরবরাহ করে এই আঁইয়া গ্রাম। আশেপাশের মফঃস্বলেও বাড়িতে জামাই অথবা অতিথি এলে গৃহস্থের একমাত্র ভরসা রাবড়িগ্রাম। শহুরে জীবন থেকে বেশ খানিকটা দূরে এই লোকালয়। রয়েছে নিজের ছন্দ। ভোর থেকে রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে নাগরিক সকালগুলো মিষ্টি করে তোলে রাবড়িগ্রাম। সকাল-বিকেল ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে পড়া শহরবাসী যেন ঠোটের কোনায় লেগে থাকা ক্ষীরটুকু চেটেপুটে বেঁচে নিতে পারে একটু বাড়তি জীবন, সেই দায়ও এই গ্রামের কারিগরদের।