Advertisment

রাফাল ও বিএসএনএল মোদীমুদ্রার দুই-পিঠ

লোকসভা ভোটের আগে আম্বানিদের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী হয়তো হ্যালের হালই করে ছাড়বেন রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম সংস্থাটিরও। কেননা, জনস্বার্থের চেয়ে বণিকের স্বার্থই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

একদিকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র লক্ষ্যে তিনগুণ বর্ধিত দামে ফরাসি সংস্থাকে রাফাল যুদ্ধবিমানের বরাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, অন্যদিকে ফোর-জি স্পেকট্রাম  থেকে বঞ্চিত হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিএসএনএল পিছিয়ে পড়ছে প্রতিযোগিতার বাজারে। আপাতভাবে বিষয়দুটি অসংলগ্ন মনে হলেও, ঘটনাদুটির নিহিত-মিল কম নয়।দুটি ক্ষেত্রেই ফলপ্রসূ হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর অকৃত্রিম আম্বানিপ্রীতি। কেননা, দুটি পদক্ষেপেই লাভের গুড় ভাগাভাগি হচ্ছে আম্বানি ভ্রাতাদের মধ্যে। ফরাসি যুদ্ধাস্ত্রসংস্থা দাসো অ্যাভিয়েশনের সঙ্গে অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেডের বাণিজ্যিক চুক্তি নিয়ে রাহুল গান্ধী অরুণ শৌরী বা প্রশান্ত ভূষণরা ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ও বিচারবিভাগীয় পরিসরে বিতর্কের ঝড় তুললেও, বিএসএনএলের প্রবঞ্চনায় এখনও কেউ সেভাবে সরব হননি। নজিরবিহীনভাবে সরব হয়েছেন সংস্থার কর্মীরাই। রাহুল গান্ধী হিন্দুস্থান অ্যারোনোটিকস লিমিটেডের (হ্যাল) কর্মীদের মধ্যে রাফাল-চুক্তি নিয়ে এক-বেলার বিক্ষোভসঞ্চারে সচেষ্ট হলেও, বিএসএনএলের কর্মীরা নিজেরাই সংস্থার প্রবঞ্চনার প্রতিবাদে ধর্মঘটে নামার অভূতপূর্ব হুমকি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যে বিষয়টি ভালভাবে নেবেন না, তা অনুমান করা যায়। কেননা, বিএসএনএল চতুর্থ-প্রজন্মের স্পেকট্রাম পেলে মুকেশ অম্বানির রিলায়েন্স জিও-র অপ্রতিহত গতি রুদ্ধ হতে পারে। ফলে, বিষয়দুটিতে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব যে একই মুদ্রার দুটি দিক, তা এখন খুব স্পষ্ট।

Advertisment

গত-সপ্তাহে রাফাল মামলায় সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি-জেনারেল কে কে বেণুগোপাল যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছেন আর তাঁর ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়েছে গোপন-বিড়াল, তাতে রাফালের চুক্তিগলদ স্পষ্ট। অন্যদিকে, একই দিনে বিএসএনএলের কর্মীরা ঘোষণা করেছেন সংস্থাকে অবিলম্বে ফোর-জি স্পেকট্রাম দেওয়া না-হলে তাঁরা ধর্মঘটে নামবেন। দুটি বিষয়ে এই সত্যটিই স্পষ্ট যে, কেন্দ্র সার্বিকভাবেই সরকারি সংস্থাগুলির সমৃদ্ধির চেয়ে কুবেরদের স্বার্থরক্ষায় বেশি উৎসাহী। অবশ্য, কেবল ‘বেসরকারি সংস্থা’ বললে সবটা বলা হয় না। প্রধানমন্ত্রী আসলে চান দেশের দু-তিনটি কুবেরপরিবারের সমৃদ্ধি। যাদের অন্যতম অম্বানী-পরিবার। সেই লক্ষ্যে তিনি রাফালের বরাত যেমন তুলে দিয়েছেন অনিলকে, তেমনই বিএসএনএলের দুর্দশার মাধ্যমে  মুকেশের জিও-টেলিকমিউনিকেশনের প্রসারও তিনি সুনিশ্চিত করেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যালকে বঞ্চিত করে অনিল অম্বানীর ভুঁইফোঁড় সংস্থকে রাফালের বরাত দেওয়ার মতোই বিএসএনএল ফোর-জি স্পেকট্রাম না-পেলেও, খুব সহজেই তা পেয়ে গেছে মুকেশের নবগঠিত জিও-সংস্থাটি।সেই সূত্রেই মোবাইল পরিষেবার ব্যবসায় বছর না-ঘুরতেই তারা হয়ে উঠেছে একচ্ছত্র। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনও বিদেশভিত্তিক টেলিকমসংস্থা বিপুল কর্মীছাঁটাই করে অবস্থার সামাল দিলেও, কোনও সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিএসএনএলের প্রচারে প্রধানমন্ত্রীর বিন্দুমাত্র আগ্রহ না-থাকলেও, তিনি হয়ে উঠেছেন জিও-মোবাইলের প্রায়-বাণিজ্যদূত।জিও-র প্রচারাভিযানে দেশ, জাতি, জাতীয়তাবাদের বিপণন এমন সুকৌশলে করা হয়েছে যে, প্রান্তিক মানুষ তা সরকারি পরিষেবা হিসেবেই ধরে নিয়েছে। এইসব প্রক্রিয়া কোনওভাবেই আকস্মিক নয়, সবটাই হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। কেননা, আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর যাবতীয় পরিকল্পনাই পরস্পরলগ্ন, সুদূরপ্রসারী, চতুর। তা সে জনধন অ্যাকাউন্টই হোক বা নোটবাতিল ও জিএসটি-ই হোক।

আরও পড়ুন, পটেলমূর্তি-রামমূর্তিতে ভাবমূর্তি গড়তে চায় বিজেপি

এই পরিস্থিতিতে রাফাল যুদ্ধবিমান নিয়ে রাহুল গান্ধী বেশ-কিছুদিন ধরেই প্রতিবাদে সরব হয়েছেন।তা তিনি হবেনই। কেননা, দীর্ঘকাল আগে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ও তাঁর সহযোগী বামপন্থীরা রাহুলের পিতামাতা রাজীব-সোনিয়ার বিরুদ্ধে বোফর্স কামান নিয়ে অবিরাম  প্রচার চালিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। পরে সেই প্রচার ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। বিজেপি-ও ক্ষমতায় এসে সেই পুরনো-কাসুন্দি ঘাঁটার চেষ্টা করেও বিশেষ ফল পায়নি। ফলে, রাফাল কেলেঙ্কারি নিয়ে রাহুলের বাড়তি-উৎসাহ অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া, ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায়ও ফেঁসে রয়েছেন তিনি। ফলে, বিজেপি-কে প্রত্যাঘাত করা ছিল তাঁর স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু, আমরা দেখেছি, পরিণততর রাহুল ব্যক্তিপরিসর থেকে সরে রাফাল বিমানের হিরাফেরিটিকে জাতীয় দায়বদ্ধতায় উন্নীত করতে সফল হয়েছেন। এই অভিযানে তিনি এখনও অন্য বিরোধী দলগুলিকে পাশে না-পেলেও, বিষয়টির অভিঘাত ক্রমশ এমনই তীব্র করে তুলেছেন যে, সুপ্রিম কোর্ট রামমন্দির মামলাটিতে ভ্রুক্ষেপ না-করলেও, রাফাল মামলার চটজলদি শুনানি শুরু করেছে। আদালত প্রথম দিনই কেন্দ্রকে  সিলবন্দি খামে বিমানের দাম জানাতে বলে কেন্দ্রকে চাপে ফেলে দিয়েছে। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ শুনানির শুরুতেও অ্যাটর্নি-জেনারেলকে নাস্তানাবুদ করায় মামলার গতিপ্রকৃতি কোনদিকে যাবে, তা ধারণা করা যায়।

শুনানির শুরুতেই তিনটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন প্রধান-বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ও মামলকারী অরুণ শৌরী ও প্রশান্তভূষণ। প্রশ্নগুলি ছিল, রাফালের দেশীয়-সহযোগী পালিয়ে গেলে কী হবে, আগের ‍চুক্তি বাতিল না-হলেও নতুন চুক্তির প্রাসঙ্গিকতা কী, কোন মন্ত্রবলে বরাতের বিমানসংখ্যা ১২৬ থেকে ৩৬ হয়ে গেল? প্রশ্নগুলির সামনে দৃশ্যতই অসহায় হয়ে পড়েছেন বেণুগোপাল। কেননা, ‘গোপনীয়তার স্বার্থে’ তাঁরও বিষয়গুলি জানা নেই। প্রধান-বিচারপতি ছাড়া বেঞ্চের অন্য-দুই সদস্য বিচারপতি কে এম জোশেফ ও বিচারপতি এস কে কউলও যে বিষয়টিতে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন, তা বোঝা গেছে মামলার  শুনানিতে। সরকারপক্ষ অনিল অম্বানির সংস্থাকে আড়াল করার চেষ্টা করেও হালে পানি পায়নি।একটি মিথ্যা দিয়ে অন্যটিকে ঢাকার চেষ্টা করে কার্যত লেজেগোবরে হয়েছেন দাপুটে আইনজীবীরা।

রাফাল বিতর্কের সূত্রপাত বিমানের বর্ধিত দাম নিয়ে। ২০১২ সালে মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ সরকার ফ্রান্সের  দাসো অ্যাভিযেশনের সঙ্গে বিমানপ্রতি ৫২৬ কোটি টাকা দামে ১২৬টি বহুমুখী রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার ‍চুক্তি করেও বাজেটবরাদ্দের টানাটানিতে বিমান কিনতে পারেনি। ২০১৫ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফ্রান্সে গিয়ে জানিয়েছিলেন ফ্রান্সের থেকে ৩৬টি রাফাল বিমান কেনা হবে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-ফ্রান্স চুক্তিতে সেই ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়। রাহুল গান্ধীর দাবি অনুযায়ী প্রতিটি বিমানের দাম ধার্য হয় ১৬৭০ কোটি টাকা। ইউপিএ-জমানার চেয়ে তিন-গুণেরও বেশি দামে। অক্টোবরে দাসো ও নবগঠিত রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেডের চুক্তির পরেই বিতর্কের সূত্রপাত। কেননা, অভিজ্ঞতর রাষ্ট্রায়ত্ত অস্ত্রনির্মাণসংস্থা হ্যালকে পাশ কাটিয়ে অনিল আম্বানির সংস্থাকে বরাত পাইয়ে দেওয়ার সঙ্গে কেবল আর্থিক দুর্নীতিই নয়, দেশের নিরাপত্তারও যোগ রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও মোদী সহজাত নীরবতার ঢালেই আত্মগোপন করে রয়েছেন। বিমানের দাম জানানোর দাবি উঠলেই তিনি দেশদ্রোহিতার তর্জনী তুলছেন। উত্থাপিত অভিযোগগুলির জবাব না-দিয়ে রাহুল-সোনিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাশনাল হেরল্ডের মামলাপ্রসঙ্গ তুলে রাফাল-কেলেঙ্কারিকে মান্যতা দিতে চাইছেন। সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্র জানিয়েছে, রাফালের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক স্বার্থেই বিমানের দাম প্রকাশ্য না-করার শর্ত রয়েছে চুক্তিতে। অথচ, ইতিমধ্যেই  রিলায়েন্সের ব্যাংকনথিতে ‘জাতীয় গোপন বিষয়’ রাফালের দাম ফাঁস হয়ে গেছে। দেশের নিরাপত্তা ও আর্থিক সঙ্গতির চেয়ে এই জনবিরোধী ও কুবেরদরদি সরকার দাসো বা রিলায়েন্সের স্বার্থরক্ষায় যত-সক্রিয় হবে, ততই যে শাসকদলটির রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে পৌঁছবে, তা বেশ বোঝা যায়। শাসকদলও যে তা বোঝে না, তা নয়। সে-কারণেই তারা এইসব অস্বস্তিকর প্রশ্ন চাপা দিতে পটেলমূর্তি বা রামমন্দিরের ঢালে আত্মরক্ষা করতে চায়।

এমন জনবিরোধী নীতি যে নরেন্দ্র মোদী এই প্রথম কার্যকর করলেন, তা নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার হ্যালের মতো বিএসএনএল-ও শুরু থেকেই তাঁর সুয়োরানি। দেশে যখন বিদেশি টেলিযোগাযোগ সংস্থাগুলি ফোর-জি স্পেকট্রামের সুবাদে চুটিয়ে ব্যবসা করছে, তখনও দেশীয় সংস্থা বিএসএনএল রয়েছে হাঁড়ির হালেই। ফোর-জি স্পেকট্রাম এখনও তাদের কাছে সুদূরপরাহত। বিপরীতে মুকেশ অম্বানির অর্বাচীন সংস্থা রিলায়েন্স জিও-র প্রসারে প্রধানমন্ত্রীর সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। প্রথম থেকেই সংস্থাটি ফোর-জি স্পেকট্রামের দৌলতে কল্পতরুর মতো প্রভাব ফেলেছে প্রতিযোগিতার বাজারে। জিও-র দাপটে অন্য সংস্থাগুলির নাভিশ্বাস উঠেছে। সবচেয়ে কঠিন ও করুণ অবস্থা বিএসএনএলের। অসম-প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি।সে-জন্য  সরকারি প্রচারযন্ত্র প্রাথমিকভাবে কর্মীদের উপর দায় চাপাতে চাইলেও, দেখা গেছে মূলত ফোর-জি-র প্রবঞ্চনায়ই তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। জিও যখন ওই ফোর-জি-র সুবাদে গ্রাহককে তথাকথিত স্বল্প-খরচ কিংবা বিনা-খরচের হাতছানিতে বেঁধে ফেলছে, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি সংযোগ ছেড়ে দিচ্ছেন পুরনো গ্রাহকরা। অতীতে ইউপিএ সরকারের ভ্রান্ত নীতির দৌলতে টু-জি স্পেকট্রামের বণ্টনে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে জেলে গেছেন  কানিমোঝি বা আন্দিমুতু রাজার মতো মন্ত্রী-সাংসদ। কিন্তু, ফোর-জি-র বাজারে রিলায়েন্সের রমরমার পিছনে প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়ে মাথা ঘামায়নি দেশের প্রধান বিরোধী দলটিও।

কিন্তু, দৃষ্টান্তমূলকভাবে এবার সক্রিয় হয়েছেন সংস্থার কর্মীরা। অবিলম্বে ফোর-জি স্পেকট্রাম না-পেলে ডিসেম্বরে ধর্মঘটে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তাঁরা। সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা চিরকাল নিজেদের বেতন মহার্ঘভাতা বা বোনাসদাবির বদলে কখনও সংস্থার উন্নতিকল্পে ধর্মঘটে গেছেন, এমন দৃষ্টান্ত ‍দুর্লভ। কর্মীদের সাফ কথা, দাবিমতো ফোর-জি স্পেকট্রাম না-পেলে কেবল গ্রাহক-পরিষেবাই নয়, বন্ধ করে দেওয়া হবে সরকারি প্রকল্পের কাজও। এর ফলে বিএসএনএলের আরও গ্রাহক হারানোর আশঙ্কা থাকলেও, তারা দাবিপূরণে সমর্থ হলে অদূর ভবিষ্যতে সংস্থাটির হাল ফিরবার সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। তবে, জনবিরোধী সরকার কর্মীদের দাবি খুব-সহজেই মেনে নেবে, এমন না-ও হতে পারে। কেননা, তাতে আম্বানিদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ফলে, তারা হয়তো হ্যালের হালই করে ছাড়বে বিএসএনএলেরও।

(মতামত ব্যক্তিগত)

bsnl editorial Rafale
Advertisment