এবারের ভোট উপলক্ষে কিছুদিন আগে থেকে একটা ধরনের প্রচার খুব দেখা যাচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়। রিমেম্বার মি হোয়েন ইউ ভোট লেখা, কাশ্মীরের ধর্ষিতা কন্যা, গৌরী লঙ্কেশ, এরকম বেশ কিছু নিহতজনের ছবি দেওয়া ব্যানার শেয়ার করছেন অনেকেই। তাঁদের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট। নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি-এনডিএ-কে ক্ষমতা থেকে অপসারণ। ২০১৪ পরবর্তী সময়ের শাসনকালে হত বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই এই পোস্টার-ব্যানার-প্রচার।
এই স্মর্তব্য বিষয়টি বেশ কিছু কথা মনে পড়িয়ে দেয়। স্মর্তব্য কী হবে, তা রাজনীতিবিদেরা স্থির করার চেষ্টা করেন বছরভর, ভোটের সময়ে কিঞ্চিৎ বেশি পরিমাণে। মনে রাখবেন- আমাদের মনে রাখতে হবে- আমরা ভুলিনি, ভুলে গেলে চলবে না, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, এ ধরনের কথা যে কোনও ভাষণে, প্যামফ্লেট ও লিফলেটে দেখতে পাওয়া যায় হমেশাই- ভোটের সময়ে। অর্থাৎ জনগণকে, মানে ভোটারকে মনে করিয়ে দিতে হয়, ভোট বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের কালে কোনটি মনে রাখার মত।
বিষয়টা ভিন্ন দিক থেকে দেখা যায়। কোন ঘটনাসমূহ মনে রাখার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তেমন একটা নির্দেশিকা দেওয়ার আকাঙ্ক্ষাও থাকে এই মনে করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। তেমন কথা মনে করিয়ে দেন, যাঁদের ভোটের সময়ে বলার কথা তৈরি হয়, সে তাঁরা হতে পারেন ভোটপ্রার্থী, ভোটে দাঁড়ানো কোনও দল, বা এমনকি হতে পারে ভোটে না- দাঁড়ানো কোনও দলও। সুবিধের জন্য বিষয়টা একটু উদাহরণ সহযোগে দেখে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন, আগামী সরকার হোক অনিশ্চিত সরকার
ইউপিএ ১-এর পতন। ইউপিএ ১ ভেঙে গিয়েছিল কেন, সে নিয়ে তৎকালীন যুযুধান কংগ্রেস ও সিপিএম, কেউই কোনও কথা বলছে না, ২০১৯-এর ভোটলগ্নে। ওয়ানাড়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করে রাহুল গান্ধী বলে দিয়েছেন, যে তিনি সিপিএমের ভাইবোনেদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলবেন না। ইউপিএ ১ নিয়ে প্রকাশ কারাত ঠিক কেন নাছোড় মনোভাব নিয়েছিলেন, সে নিয়ে বিশ্লেষণসমূহ এখন কবরের তলায়, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীন শক্তি এখন সেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে নেই, এবং চিনের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক তৎকালীন অবস্থায় নেই। এবারে সারা দেশে কংগ্রেসকে সাহায্য করার মত আসনসংখ্যা সিপিএমের পাওয়ার যে বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, সে কথা দু দলের নেতারাই জানেন, ফলে কেউই হৃদয় খুঁড়ে আর পুরনো বেদনা জাগিয়ে তুলবেন না, কারণ তাতে আপাতত কোনও লাভ নেই।
দ্বিতীয় বিস্মরণ পঞ্চায়েত ভোট। এবারের লোকসভা ভোটে পশ্চিমবাংলায় সিপিএমের লাইন বিজেপি ও তৃণমূলকে প্রতিহত করার। তাঁরা মনে করছেন, বিজেপি ও তৃণমূল একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এ মনে করা হঠাৎ নয়, ২০১১ পরবর্তীকাল থেকে সিপিএম মনে করে আসছে, তাদের যারা ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে, তারাই পয়লা নম্বর শত্রু, এ রাজ্যে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট-টন্ট নিয়ে যা রাশিয়ান কথা, সেসব তত্ত্ব বিভিন্ন অন্য সময়ে আলোচ্য, একালে তাঁরা একলা পথিক হলেও ক্ষমতা থেকে যারা সরিয়েছে, তাদের উপর থেকে সিপিএমের চোখ সরবে না। তিন দশকের অধিক কাল ক্ষমতায় থাকার পরে, এবং সেখান থেকে চ্যুত হওয়ার পর যে প্রতিক্রিয়া খুবই সাধারণ ভাবেই ঘটে থাকার কথা, যা আমরা বিভিন্ন ক্লাব সংগঠনেও দেখেছি। এরই সুবাদে পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে গ্রামে-গঞ্জে, অভ্যন্তরস্থ বাংলায়, শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধী জোট দেখতে পাওয়া গেছে, যে জোটে অবস্থিত হয়েছিল সিপিএম ও বিজেপি। প্রথম দিকে "এসব অপপ্রচার" জাতীয় একটা ধুনো তোলার চেষ্টা হয়েছিল সিপিএম নেতৃত্বের তরফে, কিন্তু বেশ কিছু পোস্টার-দেওয়াল লিখন-মিছিল ইত্যাদির ছবি সামনে এসে পড়ার পর "আমরা ব্যবস্থা নেব" জাতীয় লব্জের আশ্রয় আলিমুদ্দিনকে নিতে হয়েছিল। সেসব কথা এখন চাপা, কেননা ৪২-এ৪২ না হতে দেওয়ার জন্য রাজ্যের বিরোধীরা ফের তলে তলে একজোট হবেন কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই।
তৃতীয়, ফ্যাসিবাদ ও কণ্ঠরোধ। এ রাজ্যের শাসক দল কেন্দ্রের শাসকদলের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের অভিযোগ আনছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে কণ্ঠরোধের বিভিন্ন ঘটনার কথা। এবং এ রাজ্যের সরকার পন্থী, সরকারের কৃপাধন্য হওয়ার চেষ্টাভিমুখীরা সোশাল মিডিয়ায় ভবিষ্যতের ভূত ফিল্ম বন্ধ করে দেওয়ার যুক্তি সাজাচ্ছেন, সে ছবি ফ্লপ করার হিসেব দিচ্ছেন সোল্লাসে, যা মনে করিয়ে দিচ্ছে উড়তা পাঞ্জাব ছবি বন্ধ করতে ব্যর্থ তৎকালীন সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানকে, যিনি উড়তা পাঞ্জাব ভাল ব্যবসা না-করায় হুঁ হুঁ বাবা, আমি তো বলেইছিলাম, এ ছবি ভাল না জাতীয় মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। প্রসঙ্গত পশুখামার থিয়েটার এবং হার্বার্ট সিনেমা বন্ধ করার বাম প্রয়াসকে বিদ্ধ করতে এঁরা ২০১১ পরবর্তীতে কোনও সুযোগই ছাড়েননি। এঁরা ঠিক কোনটিকে ভুলে যেতে চাইছেন তা নিয়ে সম্ভবত, রাজ্যের শাসক দলের নানা বিষয়ের মতোই ঘেঁটে রয়েছেন, রাজনীতির অভাবে।
এদিকে ৪৭ সাল থেকে প্রায় নিরন্তর দেশ শাসনের দায়িত্বে থাকা কংগ্রেস বলেছে ক্ষমতায় এলে তারা বেশ কিছু আইন তুলে নেবে বা সংশোধন করবে। এর মধ্যে রয়েছে দেশদ্রোহিতা আইন, যা সাধারণভাবে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে যাঁরা তকমাপ্রাপ্ত তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খুবই কৌতূহলপ্রদ এ প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন কংগ্রেসে পি চিদাম্বরম, যিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন, যিনি পেশায় আইনজীবী এবং যিনি ছিলেন বেদান্ত গ্রুপের চেয়ারম্যান। সেই বেদান্ত গ্রুপ, যারা নিয়মগিরিতে খনিজ পদার্থ উত্তোলন করার আকাঙ্ক্ষায় জমি অধিগ্রহণ করায যুক্ত ছিল, এবং সেখানে কোনও রকম প্রতিরোধকে মাওবাদ-নকশালপন্থা নাম দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যার সুবাদে দলিত ও আদিবাসী যুবকদের দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে গ্রেফতার করতে থাকছিল নিরাপত্তাবাহিনী, এমনটাই অভিযোগ।
এবারের ভোটে বিজেপি-র অবশ্য মনে করানোর মত তেমন কোনও সাম্প্রতিক ঘটনা নেই। নেই বলেই তাঁদের নেতারা এক্কেবারে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছেন, সেই নেহরুর সময়ে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুললেই হয় নেহরু-জিন্না প্রসঙ্গ আসছে, নয়, ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের শেকড় তাঁরা খুঁজে বের করছেন কংগ্রেস শাসনকাল থেকে। রাহুল গান্ধী দ্বিতীয় কেন্দ্র বাছায় আমেথির বিজেপি প্রার্থী স্মৃতি ইরানি বলে ফেলছেন, এ ঘটনা নাকি আমেথির মানুষের পক্ষে অপমানের। সম্ভবত তিনি নিজে ভুলে গেছেন যে এ পথ বেছেছেন তাঁদের দলের বর্তমান অবিসংবাদী নেতা নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদীও।
সব ভোটের সময়েই, বা যে কোনও সময়েই খুব কাছাকাছি সময়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি মনে থাকে। মনে পড়ে। এবারের ভোটেও আসিফা, গৌরী লঙ্কেশরা মনে রাখার পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন হয়ত, কিন্তু বাকি সব ঘটনাসমূহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিস্মরণ যেন ঘটে না ওঠে। প্রয়োজনে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ফের ইউপিএ একের কথাও মনে করিয়ে দেবেন, মনে করিয়ে দেবেন মনোমোহিনী অর্থনীতির কথাও। এবং কে না ভুলবে আধার পরিকল্পনার জননী কারা ছিলেন?
ভোট দিতে যাওয়ার আগে এসবও কিন্তু মনে রাখার কথা। এবং ভোট দেওয়ার পরেও এসব একেবারে ভুলে যাওয়ার নয়।