সেনাবাহিনী, নাগরিক নিদ্রাভ্যাস ও সমাজবন্ধুদের আর একটা মিছিল

পৃথিবীতে যখন দেশ ছিল না, মানুষের জীবন ছিল অনেক বেশি বিপদসংকুল, তখনও মানুষ ঘুমোত, হয়ত কয়েক ঘণ্টা বেশিই নাক ডাকত তাদের, মশারি ছাড়াই।

পৃথিবীতে যখন দেশ ছিল না, মানুষের জীবন ছিল অনেক বেশি বিপদসংকুল, তখনও মানুষ ঘুমোত, হয়ত কয়েক ঘণ্টা বেশিই নাক ডাকত তাদের, মশারি ছাড়াই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Farmers Rally in wake of Pulwama Incident

দ্বিতীয় দফার লং মার্চে কৃষকরা। ফাইল ছবি

আজ থেকে বছর ত্রিশ চল্লিশ আগে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় সমাজ সম্পর্কে কিছু পড়াশোনা করানো হত। আজকের দিনে সমাজের ধারণাটাই গোলমেলে, তাই ছড়ায়-ছবিতে সমাজবন্ধুদের খুঁজে নেওয়ার বিষয়টা অনেকাংশে ক্লিশে হয়ে গেছে। সুদূর অতীতে পাতলা বইয়ের পাতায় ছবি আঁকা হত সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের। সাদা পাতার ওপর কালো কিংবা একটু ভাগ্য ভালো থাকলে ফ্যাকাসে লাল কিংবা নীল রঙের স্কেচে আঁকা থাকত সমাজবন্ধুদের ছবি। অবশ্যই সেখানে গাঢ় অক্ষরে লেখা থাকত মুচি কিংবা ম্যাথর আমাদের ভাই। অর্থাৎ খুব সহজেই বুঝিয়ে দেওয়া হত যে এই বইগুলো যারা পড়বে তাদের মধ্যে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা কম। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, এই বইগুলো যাদের পাঠ্য, তাদের সঙ্গে এই ছড়া এবং ছবিতে প্রকাশিত মানুষগুলোর সম্পর্ক দৈনন্দিন চেনাশোনার থেকে অনেক বেশি আবদ্ধ ছিল বইয়ের পাতায়।
সেদিনের শিশু আজ যৌবন অতিক্রম করে প্রৌঢ়। একটু ভাবলে দেখবেন কখনও বইয়ের পাতায় লেখা থাকত না যে সম্পন্ন প্রযুক্তিবিদ বা একজন নামী চিকিৎসকও সমাজবন্ধু হতে পারে। কানাকে কানা বা খোঁড়াকে খোঁড়া না বলার যে শিক্ষা, সেই শিক্ষাতেই জারিত এই মুচি কিংবা মেথর। অতীতে, বর্তমানে এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও এই দেশে এমনটা চলবে। আজকের দিনেও তাই স্নাতকস্তর পাশ করা কোন চর্মশিল্পী রাস্তায় বসে জুতো-জোড়ায় আঠা লাগানোর সময় মুচিই থেকে যান। উচ্চমাধ্যমিকের কলনবিদ্যা শেখা পড়ুয়া গভীর ম্যানহোলের ঢাকনা সরিয়ে বিষাক্ত গ্যাসে ভূত হয়ে গেলে স্বর্গের দ্বারে খাতা হাতে দণ্ডায়মান বিধাতা মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করেন, “কেমন আছে তোমার সকল দেশের সেরা জন্মভূমি?”

সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে সমাজবন্ধু হিসেবে অনেক বেশি করে প্রচার পাচ্ছেন আমাদের দেশের সীমান্তে লড়াই করা সৈন্যবাহিনী। এর একটি বিশেষ অনুসিদ্ধান্ত হল সীমান্তে পাহারার সঙ্গে জনগণের নিদ্রার গভীর সম্পর্ক। অবশ্যই বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনী সমাজ বা দেশকে সুরক্ষা যোগান দেয়। কিছু গোলমাল সবকিছুতেই থাকে, কিন্তু মোটের ওপর আমাদের দেশে যেটুকু গণতন্ত্র আছে তার পেছনে সশস্ত্র বাহিনীর অবদান অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তাঁদের কথা কি আমাদের সবসময় মনে থাকে? মে-জুন মাসের গরমে কলকাতার রাস্তায় যে ট্রাফিক পুলিশ যান চলাচল সুবিন্যস্ত রাখেন তাঁর কথা কতটুকু ভাবি আমরা? ঠিক তেমনই দেশের সৈন্যবাহিনীর ওপর হামলা হলে তবেই তাঁদের কথা মনে পড়ে। স্মরণে আসে যে তাঁরা সীমান্তে পাহারা দিচ্ছেন বলেই আমরা নিশ্চিন্তে দেশের মধ্যে মশারি খাটিয়ে ঘুমোতে পারছি। একটু যুক্তি দিয়ে ভাবলে অনুধাবন করা যায় যে তাঁদের সীমানা সামলানোর যে অবদান তা কিন্তু শুধুমাত্র তাঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তাঁদের ওপর আক্রমণ হোক কি না হোক, সীমানা তাঁরা সবসময়েই সামলাচ্ছেন। পৃথিবীর মানচিত্রকে যখন থেকে অনেক রঙে রাঙানো হয়েছে তখন থেকেই দুটো রঙ আলাদা করতে গিয়ে মাঝে এসে গেছে দেশভাগের রেখা। সেই রেখাকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে অবশ্যই সেনাবাহিনীকে সেখানে কড়া ঢঙে মার্চপাস্ট করতে হবে। হাতে গোলাপ নিয়ে দুই দেশের ফৌজিরা গন্ধ শুঁকবে কিংবা বিজ্ঞাপনের এক জোড়া অমিতাভের মত চায়ের পেয়ালা হাতে কারটা গরম আর কারটা ঠাণ্ডা এই নিয়ে আলোচনা করবে এমনটা কষ্টকল্পনা মাত্র।

Advertisment

আরও পড়ুন, Prof. Amartya Sen Interview: প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, এই দুই ছাড়া দেশ এগোবে না, বললেন অমর্ত্য সেন

সীমান্ত বাস্তবিকই লড়াইয়ের জায়গা। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলে তখনই সবার চৈতন্যে জেগে ওঠে সৈন্যদলের আত্মত্যাগের কথা। তা না হলে, কি নেতানেত্রী, কি সাধারণ মানুষ, কেউই দেশের সৈন্যবাহিনীর অবদান প্রতিদিন মনে রাখে না। সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের দৈনন্দিন জীবন যখন পৃথিবীর আহ্নিক গতির সঙ্গে সুস্থভাবে আবর্তিত হয়, তখন সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানুষের অবদানের কথা মনে রাখতে হয় না সাধারণ মানুষকে। ফলে মশারি খাটিয়ে আমরা সবসময়েই ঘুমোই। তার সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে সীমান্তের সেনা টহলের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হন্যে হয়ে না খোঁজাই ভালো। কোনও দেশে সৈন্যবাহিনী না থাকলে কি সেই দেশের মানুষজন কখনও ঘুমোতেন না? পৃথিবীতে যখন দেশ ছিল না, মানুষের জীবন ছিল অনেক বেশি বিপদসংকুল, তখনও মানুষ ঘুমোত, হয়ত কয়েক ঘণ্টা বেশিই নাক ডাকত তাদের, মশারি ছাড়াই।

সেনাবাহিনীকে মহৎ আখ্যা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে একটি মূল বিষয় কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে বারবার। তা হল আমাদের দেশের সৈন্যবাহিনীর একেবারে নীচের সারির কর্মীরা কি ঠিক মত সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন? তাঁদের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে নয়, অনেকটা সময় কেটে গেলেও কি সমাজ মনে রাখছে তাঁদের? দুকুড়ির বেশি সৈন্যের মৃত্যুর পর সরকারের টনক নড়েছে কিছুটা। বিপজ্জনক রাস্তায় কনভয় না নিয়ে গিয়ে বিমানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রের প্রেক্ষিতে সমাজে কৃষক, শ্রমিক, প্রযুক্তিবিদ, চিকিৎসক- এঁদের মতই সেনারাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ — সে সিরিয়াই হোক কিংবা ভেনেজুয়েলা, কাশ্মীর হোক কিংবা কন্যাকুমারীকা। আর তার সঙ্গে অবশ্যই এসে যায় তাঁদের অধিকার রক্ষার প্রশ্নও। ভারতের মত সংসদীয় গণতন্ত্রে সে প্রশ্ন অবিলম্বে আলোচিত হওয়া উচিৎ। আর সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে মাঠে নেমে দেশের জন্যে লড়াই করা সৈন্যবাহিনীর মত সমাজে অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান আছে পিছিয়ে পড়া দেশবাসীর।

আরও পড়ুন, ওরে হাল্লা রাজার সেনা…

Advertisment

দেশের একশো ত্রিশ কোটি মানুষের মধ্যে একটা বড় অংশ কৃষক এবং শ্রমিক। এঁদের অধিকাংশ অবশ্যই অবহেলিত। যতটা কাজ তাঁরা করেন ততটা আয় হয় না তাঁদের। যতই ভারত দেশ হিসেবে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে প্রজাতন্ত্রের বিজ্ঞাপন দিক না কেন, দেশের মূল কাঠামো সামন্ততন্ত্র এবং পুঁজিবাদের এক সুষম দ্রবণ। সেই জায়গায় কোন একটা ধারায় নিয়মানুবর্তী গণ আন্দোলনের প্রভাব না থাকলে এই মানুষগুলির কথা শাসকশ্রেণির না ভাবাটাই স্বাভাবিক।

তবে আশার আলো সামান্য হলেও কিছুটা আছে। শাসকশ্রেণি যে সমাজের নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের কথা ভাবতে বাধ্য হয় তার প্রমাণ গত বছর দুই ধরে লাগাতার কৃষক আন্দোলন। গত বসন্তে কৃষকদের লং মার্চের কথা আমরা জেনেছিলাম সবাই। মহারাষ্ট্র সরকার চটজলদি কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গত এগারো মাসে সেই প্রতিশ্রুতি পালনে খুব বেশি কাজ হয় নি। তাই এবার দ্বিতীয়বার পথে নামা। এই মিছিলের প্রস্তুতিতে দেবেন্দ্র ফড়নবিশের নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যাপক বাধার সৃষ্টি করেছে বারবার। কাজ হয় নি মোটেই। গত একুশে ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে গেছে এই মিছিল, নেতৃত্বে সারা ভারত কৃষক সভা, যারা সিপিএমের একটি শাখা সংগঠন। একশো পঁয়ষট্টি কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এই মিছিল মুম্বাই পোঁছনোর কথা সাতাশ তারিখে। মনে রাখতে হবে এর মধ্যে হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে হেরেছে বিজেপি। ক্ষমতায় এসেই চটজলদি ঋণ মুকুবের কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে কংগ্রেসের হাইকম্যান্ড। পেছনের পায়ে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় খেলে অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে কৃষকদের জন্যে পরিবারপিছু বছরে ছ-হাজার টাকার মূল্যের গাজরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ভোট পেতে তার দুহাজার টাকা কৃষকদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা এপ্রিলের শুরুতেই।

তবে দুহাজারের টোপ যে চটজলদি কাজে দেয় নি, তার প্রমাণ নাসিক-মুম্বাই দ্বিতীয়বারের লম্বা মিছিল। আগামী কয়েকদিন টেলিভিশনের পর্দায় আর খবরের কাগজের কালো অক্ষরে রাজ করবেন এই কৃষকরাই, এমনটাই প্রত্যাশা। পথের পাশের ঘাসে আর রাজপথের পিচে তাঁদের চোখে পড়বে বারবার। সরু বাঁশের মাথায় লাল নিশান জড়িয়ে পশ্চিম ভারতের রাস্তায় এঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি সংবাদমাধ্যমের নজর এড়ানো শক্ত। কিছুদিন পরেই গ্রাম থেকে শহরে আসা এই মানুষদের দেখা যাবে ধুলো মেখে গোল হয়ে বসে থাকতে। গায়ে গ্রামীণ পোশাক — মানে শাড়ি কিংবা খাটো ধুতি। তাদের হাতে অনেক আন্তরিকতার সঙ্গে মিনারেল ওয়াটারের বোতল তুলে দেবেন শহর মুম্বাইয়ের মানুষ। শহর মিশে যাওয়া সেই ভিড়ে খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে রঙ ওঠা ডিজাইনার জিনস, চে গুয়েভারার মুখ আঁকা ধবধবে সাদা টি শার্ট অথবা সাবলীল মুঠোফোন। নাসিক থেকে মুম্বাই পৌঁছনো রক্তিম নিশানের ছবি অন্তর্জালে মুহূর্তে পৌঁছে যাবে ইস্তাম্বুল, প্যারিস, নাইরোবি কিংবা সান ফ্রান্সিসকোর কমরেডের কাছে। সমাজবন্ধু কৃষকদের কথা ভাবতে বাধ্য হবে আমাদের দেশের তথাকথিত গণতান্ত্রিক কাঠামো। জোট না বাঁধলে নাকিকান্নার সানাই ছাড়া সমাজের কোন বন্ধুর কথাই ভাববে না এদেশের সরকার — সে বিজেপিই হোক কিংবা কংগ্রেস, অথবা অন্য কোন বাম-মধ্য-ডান মেশানো তৃতীয় জোট। কাশ্মীর থেকে নাসিক হয়ে মুম্বাই, যাদের মৃত্যুর সংখ্যা কিংবা পায়ের ফোস্কার নামতা খুব বেশি না হলে কেউ নজর দেয় না, তাদের অনেক অনেক বেশি করে বাঁচতে হবে শ্রমের দাম ফেরত নেওয়ার লড়াইতে। সে লড়াইয়ের ইতিহাসে যোগ হোক নাসিক মুম্বাই দ্বিতীয় লং মার্চের কাহিনী। আমাদের শহুরে শুভেচ্ছা রইল!

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)