১৮ এপ্রিল বিজেপি-তে যোগদানের মুহূর্ত থেকে সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুরের কিছু মন্তব্য দেশ জুড়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জেরে সে মন্তব্য তিনি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বটে, কিন্তু বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্নকে সামনে তুলে এনেছে ওই মন্তব্যগুলি।
যেমন, হেফাজতে অত্যাটার, ইউএপিএ আইনের ভয়াবহতা, বিশেষ করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত করে বা সন্দেহভাজনদের হাল, এনআইএ নামক সংস্থার বিতর্কিত ভূমিকা, প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্যদের হিন্দুদের ইতিহাস প্রসঙ্গ উত্থাপন করা, শিখ দাঙ্গার (১৯৮৪) কথা, সর্বোপরি ন্যায়বিচারের কথা।
পড়ুন সুজাত ভদ্রের কলামে, নির্বাচনী ইস্তেহারে যেসব নাগরিক অধিকারের কথা নেই
তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, সাধ্বীর অত্যাচার সংক্রান্ত অভিযোগ তৎকালীন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং সুপ্রিম কোর্ট তদন্ত ও বিচার করেন, কিন্তু অভিযোগের সারবত্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। অভিজ্ঞতা বলছে, হেফাজতে হিংসা প্রমাণ করা খুব শক্ত। সাধ্বীর ক্ষেত্রে তবু তদন্ত হয়েছে, অসংখ্য অত্যাচারিত সন্ত্রাসবাদী-র কপালে সেটুকুও জোটেনি। বরং সে সব নিয়ে কথা বললেই, নাগরিক-মানবাধিকার সংগঠনগুলির দিকে জাতীয়তাবিরোধী বা সন্ত্রাসবাদীদের মুখপত্র, এসব তকমা ধেয়ে এসেছে।
সাধ্বীর ঘটনা নিয়ে বিচলিত প্রধানমন্ত্রী বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু তিনি একবারও বলেননি, ক্ষমতায় আসীন মহারাষ্ট্র সরকারকে দিয়ে ঘটনার পুনর্তদন্ত করানো হবে, অত্যাচারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। বলেননি, যে 'সন্ত্রাসবাদী' অভিযোগে অভিযুক্ত সমস্ত বন্দিদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে তদন্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী এও বলেননি যে তাঁরা পুনর্বার ক্ষমতায় এলে ১৯৮৪ সালের 'অত্যাচার বিরোধী সনদ'কে সংসদে আইন হিসাবে পাশ করাবেন। সাধ্বীর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও অত্যাচারীর শাস্তি নিয়ে কোনও কথা ব্যয় করেননি প্রধানমন্ত্রী। কোথাও এ কথা উল্লেখ করা হয়নি যে শিবরাজ সিং চৌহানের আমলেই সাধ্বীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছিল। সন্ন্যাসিনীকে খুনের মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল যে বিজেপি সরকারের আমলেই, সে কথার উল্লেখ কোথাওই নেই।
এই মহারাষ্ট্রের পুলিশ, বিজেপির আমলেই মানবাধিকার আন্দোলনের অগ্রগণ্য সংগঠকদের সন্ত্রাসবাদী-মাওবাদী আখ্যা দিয়ে গত বছরের জুন ও অগাস্ট মাস থেকে মিথ্যা মামলায় বন্দি করে রেখেছে। প্রচুর তথ্যপ্রমাণের অসংগতির কথা, সুপ্রিম কোর্টের বিক্ষুব্ধ বিচারপতির রায়েই স্পষ্ট। তবু সেই সাজানো মামলাকেই বিজেপি সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সমর্থন করে আসছে। ১৪ বছর জেল খাটার পর বেকসুর নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন এমন একাধিক "মুসলিম" যুবকদের লেখা আজ জনসমক্ষে এসেছে। তাদের প্রতি ছিটেফোঁটা সহানুভূতিও প্রধানমন্ত্রী দেখাননি। তাঁরা কি নাগরিক নন?
না কি, প্রধানমন্ত্রী নিজেকে তাঁদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করেন না?
আরও পড়ুন, এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিল: রাষ্ট্রনীতি বনাম শরণার্থী
তথ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালের পর থেকে এনআইএ শুধু মালেগাঁও বিস্ফোরণ নয়, সমঝোতা এক্সপ্রেস (২০০৭), হায়দরাবাদে মক্কা মসজিদ (২০০৭), আজমের শরিফ দরগা (২০০৭), মোদাসা (২০০৮) ঘটনায় অভিযুক্তদের মুক্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে তথ্যপ্রমাণ পেশ করছে না আদালতে, ক্লিন চিট দিয়ে দিয়েছে, এবং বিচারকরা তা নিয়ে তাঁদের ক্ষোভ নথিভু্ক্ত করছেন। ফলে ন্যায় বিচার পাওয়া দূর অস্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বরং এই কার্যকলাপ আইনের আইনি দর্শনের দুটি সার্বজনীন নীতিকে ধ্বংস করে দিল। এবং তাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে নিল।
প্রথম নীতি- তুমি যতই বড়ই হও না কেন, আইন তোমার ঊর্ধ্বে।
বদলে গিয়ে এ নীতি দাঁড়াল- তুমি যদি আমার লোক হও, তাহলে আইনের স্থান তোমার নিচে।
দ্বিতীয় নীতি- আইন আইনের পথে চলবে
রূপান্তরিত নীতি- আইন রাজনীতির অঙ্গুলিহেলনে চলবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টুইটারে এবং অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে জানিয়েছেন, কোনও হিন্দু, যাঁরা পাঁচ হাজার বছরের সংস্কৃতির বাহক, কোনওদিন কোনও সন্ত্রাস কার্যের যুক্ত ছিল না, নেই। অতএব সাধ্বী যুক্ত নন, অসীমানন্দ যুক্ত নন, পেহলু খান, আখলাক সহ ৬০ জন নাগরিকের নৃশংস হত্যায় কোনও হিন্দু যুক্ত নন, গুজরাট গণহত্যা(২০০২)-এ কোনও হিন্দু যুক্ত নন, সোহরাবুদ্দিন, তুলসীরাম প্রজাপতির হত্যার ঘটনায় তাই হিন্দু অভিযুক্তরা বেকসুর।
হয়ত অচিরেই শুনব, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় কোনও হিন্দু যুক্ত ছিলেন না, শুনব মহাত্মা গান্ধীকে হত্যায় ব্রাহ্মণ গডসে বা আপ্টে সহ অন্যান্যরা যুক্ত ছিলেন না। এসবই কংগ্রেসর অপপ্রচার! শুনব, 'টেরর' শুধু একটি বিশেষ সংখ্যলঘু সম্প্রদায়েরই জন্মতিলক, শ্রীলঙ্কা বা বার্মার সহিংস বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সন্ত্রাস বা শ্বেতাঙ্গদের সন্ত্রাস- এ সবই ভুয়ো।
আরও পড়ুন, ভোট দিতে যাওয়ার আগে মনে রাখবেন…
আর প্রাচীন ভারতের হিংসা সন্ত্রাস, অথবা সশস্ত্র সংগ্রামে যুক্ত ভারতীয় হিন্দুদের জীবন বলিদানের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু ক্যারাভানে দেওয়া অসীমানন্দের স্বীকারোক্তি কি ভুয়া? কালবুর্গি থেকে গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকারী? কী তাদের ধর্মীয় পরিচয়?
দেশভাগের মুহূর্তে রাজস্থানের আলওয়ার ও ভরতপুরে মিও সম্প্রদায়কে কারা সম্পূর্ণ দৈহিকভাবে হত্যা করেছিল! কার নির্দেশে! সাধ্বীদের মামলার মতোই একই তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইয়াকুব মেমনের কী করে ফাঁসি হয়!
পাশাপাশি, সাধ্বীর ৯ বছরের জেল জীবন, নিঃসন্দেহে কষ্টের, বেদনার। রাওলাটের উত্তরসূরী ইউএপিএ কংগ্রেস সহ সব বিরোধী দল মিলে সংসদে পাশ করিয়েছে। সে আইনে বন্দির জামিন পাওয়া দুরূহ। এ আইনে অভিযুক্ত সমস্ত বন্দি আজও দুঃসহ জীবন যাপন করেছেন জেলে। তাদের কথা কে বলবে! এ আইনটি বাতিলের কথা আজও তোলা হবে না কেন!
আর মুসলিম জঙ্গি নিহত বা অত্যাচারিত হলে প্রশ্ন তোলা যাবে না, সংঘর্ষে হত্যার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করা যাবে না! তাহলে 'দেশদ্রোহিতা' হবে!
কদিন আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, আমেরিকার মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনকে তুরস্ক ধ্বংস করতে চাইলে, তিনি তুরস্ককেই ধ্বংস করে দেবেন।
এখানে একই কথার মোলায়েম প্রতিধ্বনি শুনছি, আমার মদতপুষ্ট সন্ত্রাসকে কিছু বললে তারা দেশদ্রোহী, তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
এগুলো তো 'টেরর' নয়, ধর্মযুদ্ধ।
(সুজাত ভদ্র মানবাধিকার কর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)