Advertisment

সৎ অসতীর আত্মকথন

পরকীয়া, অসতী, এসব শব্দ এখনও বেশ মুখরোচক। ভালো লাগা, ভালোবাসা, শরীরী প্রেম, এসব কি কেবল হরমোনের খেলা? আর সংস্কৃতি? যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পিতৃতন্ত্র, তার ভাবনা ও অভ্যাস? অকপট হলেন কবি মন্দাক্রান্তা সেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Mandakranta Sen feature

প্রতীকী ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

মন্দাক্রান্তা সেন

Advertisment

প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। আমার লেখা একটা কবিতা নিয়ে বাংলার পাঠক সমাজে ঝড় উঠেছিল। কবিতাটার নাম ছিল, ‘একটি অসম পরকীয়া’। এই নামটি বোধহয় এই লেখার নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি বেশ সাযুজ্য রাখে। বিষয় হিসাবে পরকীয়া সম্পর্ক আমার বেশ পছন্দের। আরেকটা লেখাও ওই সময়েই লেখা। নাম ছিল ‘কাল থেকে আসব না’। এখন, দুটো কবিতার মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। প্রথমটায় ছিল ঔদ্ধত্য, একটা পজিটিভ মানসিকতা- “শহিদ মিনারে উঠে গিয়ে/ বলে দেব আকাশ ফাটিয়ে/ইন্দ্রকাকু আমার প্রেমিক’। এতে ছিল তথাকথিত সমাজের অনুশাসন তথা নৈতিকতার ধারণাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা। আর দ্বিতীয়টা, যেখানে আমি তরুণী গৃহশিক্ষিকার সঙ্গে তার চেয়ে দশ বছরের ছোট কিশোর ছাত্রের সম্পর্কের কথা লিখেছি, সেটা শেষ হচ্ছে নেগেটিভ মানসিকতায়- “কাল থেকে আসব না, অনুরাধাদিরা বড় ভালো/যেতে পারব, হাত ছাড়ো, ঘরে গিয়ে মোমবাতি জ্বালো”।

কিন্তু কবিতার প্রবণতা যেদিকেই যাক, কবির প্রবণতা আশা করি পরিষ্কার। সে সম্পর্কের তথাকথিত নৈতিকতাকে স্বীকার করে না। আর সে যতই অস্বীকার করুক, এটাও অস্বীকার করতে পারে না যে সমাজে নৈতিকতা বলে একটা চাপিয়ে দেওয়া ব্যাপার আছেই, তাই তার প্রতি এত তাচ্ছিল্য প্রকাশের দায়!

প্রেম নিজগুণেই একটি উত্তেজক ব্যাপার, তাতে বুক ধুকপুক করে। কিন্তু অবৈধ প্রেমে উত্তেজনা আরও তীব্র। সে মদে ধ্বক বেশি। সমাজ যাতে সায় দেয় না, তাতে চ্যালেঞ্জও বেশি। এই চ্যালেঞ্জ আমার নিতে ভাল লাগে। শুধু লিখে নয়, ভালবেসে দেখিয়ে দেব সমাজের এঁকে দেওয়া সীমারেখার বাইরে পা ফেলতে আমি অকুতোভয়। শুধু অকুতোভয় নয়, বিশেষ আগ্রহী।

Mandakranta Sen Feature শুধুমাত্র যৌনতাই যদি সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমার সমস্যা আছে। একটা নিয়মিত যৌনতাসর্বস্ব সম্পর্ক আমার পছন্দ নয়। (ছবি চিন্ময় মুখোপাধ্যায়)

আচ্ছা, প্রেমে আবার নৈতিকতা কীসের? প্রেম মূলত একটি অনুভূতি, যে অনুভূতি নিতান্ত আমার। তাতে হস্তক্ষেপ করবে কে, আর কী করেই বা করবে! আমাকে সমাজ বলল- ছিইইই, তুমি বিবাহিত, তুমি স্বামী ছাড়া অন্য কারও প্রেমে পড়বে কী! আমি বলব, সমাজ যদি তাই বলে, আমি তো নাচার। আমি কি রামগরুড়ের ছানার মত বলব- প্রেমের কথা শুনলে বলে প্রেমে পড়ব না না না না! ওই পুরুষটির মত চোখের চাহনি অন্য কোনও পুরুষে আমি দেখিনি, আমার মারাত্মক ভাল লেগেছে। এটা আমার দোষ, নাকি তার চাহনির দোষ! তার হাসির সময়ে একদিকের ঠোঁট সুমধুর ভঙ্গিমায় বেঁকে যায়, সেটা আমার খুব ভাল লাগছে বলে ঘাবড়ে গিয়ে অন্যদিকে তাকাব? হয় নাকি এরকম? জগতে কত সৌন্দর্যের পসরা! কত সুন্দর প্রকৃতি! কত সুন্দর মানুষ! কত সুন্দর পুরুষ! কত সুন্দর নারী! এদের থেকে নৈতিকতা বিচার করে আমায় কি পালিয়ে থাকতে হবে নাকি! নাহ্, আমি আমার প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেব তার রূপ-রস-স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শ।

যেখানে জিম করতে যাই, সেখানে অভিনভ যেদিন শর্টস পরে আসে, শারীরিক কষ্ট ভুলে আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। ও ট্র্যাকপ্যান্ট পরে এলে আমার ভাল্লাগে না। ওর সঙ্গে আমার হাই আর বাই ছাড়া কোনও বাক্যবিনিময় হয় না। জানি এটা কোনও সম্পর্কই নয়, কিন্তু নিগ্ধতাও একরকম অস্তিত্বে অস্তিত্বে যোগাযোগ। আরও জানি এটাকেও সমাজ অনৈতিক ভাবে। হায়!

প্রেম বা অবৈধ প্রেম নিয়ে সমাজ যতই ঘোঁট পাকাক, তবু ভাবের ঘরে চুরি আমাদের অজানা নয়। রাধা কৃষ্ণ তো প্রেমে অনুভবে শুধু নয়, শরীরে শরীরে মাখামাখি। রাধা কূলবধূ, তায় আবার সম্পর্কে কৃষ্ণের মামিমা। এ তো রীতিমত অজাচার। কৃষ্ণের তো রাধা ছাড়াও গুচ্ছগুচ্ছ গোপিনী। কিন্তু ওই য়ে, তাঁরা করলে লীলা- আমরা করলে বিলা। খারাপ কথা হয়ে গেল? তা কী করব পাঠকমশাই, পাঠকদেবীয়োঁ, আমি মেয়েটাই খারাপ। খুব খারাপ। আমি একটা নষ্ট মেয়ে, তবে ধর্ষণকে বলব দুষ্টু দামাল বাচ্চা ছেলেদের দুষ্টুমি, ততটা নষ্ট নই। অ্যাশলে জুড যেমন বলেছেন, আই অ্যাম আ ন্যস্টি ওম্যান, বাট নট ন্যাস্টিয়ার দ্যান ডোনাল্ড ট্রাম্প।

সম্পর্কের সঙ্গে নৈতিকতার প্রসঙ্গে যৌনতার কথা প্রথমেই মনে আসে। কিন্তু নিছক যৌনতা কোনও সম্পর্ক নয়। অন্তত আমি তা মনে করি না। আমার স্বামীর অজান্তে আমি অন্য কোনও পুরুষ বা নারীর সঙ্গে শুলাম- এতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল না। শরীর আবার এমন কী বস্তু, যাকে নিয়ে এত ‘গেল গেল’ হবে! মহাভারত অশুদ্ধ কথাটা বুঝে শুনেই ব্যবহার করলাম। কারণ এই প্রেমহীন যৌনতার কথা মহাভারতেই আমরা পাই, যাকে বলে নিয়োগপ্রথা। রানি সত্যবতী তাঁর পুত্র বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর বিধবা পুত্রবধূ অম্বা অম্বালিকাকে ব্যাসদেবের সঙ্গে সঙ্গমে বাধ্য করেছিলেন তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদেনের জন্য। এ যদি আমাদের ঐতিহ্য হয়, তবে এখন এক কথা কীসের, সমাজের অভিভাবক দাদা ও দিদিরা?

কিন্তু শুধুমাত্র যৌনতাই যদি সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমার সমস্যা আচে। একটা নিয়মিত যৌনতাসর্বস্ব সম্পর্ক আমার পছন্দ নয়। সে তো যৌনপল্লীতেই হয়। কিন্তু যৌনপল্লীতেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে কখনও কখনও, যখন শরীরের বিক্রেতা ও ক্রেতার মধ্যে অর্থের বদলে অন্য অর্থপূর্ণ একটা যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এই যোগাযোগটা হৃদয়ের। পুরুষটি যদি অবিবাহিত হয়, তবে সেটা অবৈধ সম্পর্কই বটে। কিন্তু পুরুষটির দাম্পত্য যদি প্রেমহীন হয়, তাহলে? শুধু নৈতিকতার নিরিখে প্রথমটাকে অপরাধ মনে করব?

আমি একটি নারীর দিক থেকেই কথা বলি। বলি যে, আমি সততায় বিশ্বাস করি, সতীত্বে নয়। সতীত্ব আবার কী? ব্যক্তিগতভাবে আমি শোওয়াশুযিতে তেমন আগ্রহী নই। তবে আমি যৌনতা খুব ভালবাসি। মাথার ওপর দিয়ে গেল? আসলে, আমার যৌনতা আমার মেধায়। একটি ছেলে দারুণ কবিতা লেখে। সে আমার চেয়ে ষোল বছরের ছোট। তো, তার সঙ্গে আমার দারুণ প্রেম হল। প্রেম মানে, সে এক হাবুডুবু তুফান। তার সঙ্গে গভীর রাতে চ্যাটে একলাইন একলাইন কবিতা মিলিয়ে একটা গোটা কবিতা জন্ম নিলে মনে হত তার সঙ্গে তুমুল সঙ্গমে আমি মা হলাম। তো সেই প্রেম আমার প্রকৃতপক্ষে শেষ না হয়েও বাস্তবে সম্পর্কটা ভেঙে গেল। আমার স্বামী আছে, ছিল। তারও প্রেমিকা ছিল, অ্যাদ্দিনে বোধহয় বউও হয়ে গেছে। তাতে কী এল গেল! কী যায় আসে! আমি তাকে বলেছিলাম, আমার সঙ্গে যতক্ষণ থাকবি, তোর প্রেমিকা ফোন করলে মিথ্যে কতা বলবি না, বলে দিবি এখন একঘন্টা তুই আমার কাছে থাকবি। সেটা অবশ্য হত না। লাজুক ছেলেটি প্রেমিকাকে আমার সামনে সত্যি কথাটা জানাতে বাধ্য হত, আর তার প্রেমিকা খিস্তি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিত। এত চেঁচাত যে সেটা ওর মোবাইল থেকে আমি স্পষ্ট শুনতে পেতাম। ছেলেটা বলত, আমি যাই, না হলে ও আমায় ক্যা@বে। আমি বলতাম যাঃ#লা, ভাগ ক্যা@নে।

বাড়ি এসে আমি আমার বরকে সব কথা জানাতাম। ও হয়ত কষ্ট পেত। হ্যাঁ, এই নিরপরাধ ছেলেটাকে এমন শাস্তি দেওয়া, এটা অবশ্যই অনৈতিক। কিন্তু ওই যে, সততায় বিশ্বাস করি বলে এটা আমি করে থাকি। প্রায়ই।

তাহলে মোদ্দা ব্যাপার কী দাঁড়াল? প্রেম (যৌনতাসহ) কখনওই অনৈতিক সম্পর্ক নয়। কিন্তু প্রেমহীন যৌনতা (বিশেষ করে যা কারও প্রতি বিশ্বস্ত নয়) তা অনৈতিক।

কিন্তু নৈতিকতার এই ধারণা আমার মধ্যে, বা অন্যভাবে অন্য কারও মধ্যে গড়ে ওঠে বা উঠছে কী করে? অন্যান্য প্রাণীদের (পেঙ্গুইন-সহ কিছু প্রাণীকে বাদ দিলে) মধ্যে তো তা নেই! ছোট গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাচীন মানবসমাজেও তা ছিল না। সেখানে সহোদর ভ্রাতা-ভগ্নী, মাতা-পুত্র, পিতা-কন্যা সবার মধ্যেই যৌনতা ঘটত। তাকে অনৈতিক মনে করা হত না তো! এখনও বারতবর্ষের কোনও কোনও অঞ্চলে মামা-ভাগ্নী কিংবা বিধবা বৌদি-দেওরদের বিয়ে হয়। দাম্পত্য মানে আবশ্যিক যৌনতা, প্রেম থাক চাই না থাক। এসবও তো অনৈতিক নয়!

কাজেই নৈতিকতা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চলুন প্রেমে পড়া যাক। আমি আপাতত একটু অন্য প্রেমে ব্যস্ত আছি, নইলে আগ্রহী দাদারা, দিদিরা, ফোন নাম্বারটা এখানে দিয়ে দিতাম।

Advertisment