ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এল। রাষ্ট্রপতি ভবনের চূড়ায় নানা রঙের আলোর ঝলকানি। এক অসাধারণ ঐতিহাসিক স্থাপত্যের সামনে উপবিষ্ট হয়ে দেখলাম দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের খেলা শুরু করতে আসরে নেমেছেন। মোদী শপথ নেওয়ার পর এক এক করে অন্যান্য মন্ত্রীরাও শপথ গ্রহণ করলেন এবং তৈরী হয়ে গেল নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভা।
এই মন্ত্রীসভার গঠন যাই হোক না কেন, একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, সেটি হল, এটি নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভা। নরেন্দ্র মোদীই হলেন সেই সর্বোচ্চ নেতা যিনি দেশ ও রাষ্ট্রের রাজনীতি এবং প্রশাসনিক অভিমুখ নির্ধারণ করবেন। তিনি একাই একশো। তাঁকে নানা দিক থেকে, নানা ভাবে পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা আবিষ্কার করে চলেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি হলেন দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট নেতা। আবার কারও মতে, তিনি যথেষ্ঠ উদারবাদী নেতা, বহুক্ষেত্রে গরিব মানুষের জন্য সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকেন। সেই সামাজিক প্রকল্পগুলি একটা জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। তাই নরেন্দ্র মোদী নামক রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিত্বে আছে অনেক ধরনের শেড, অনেক ধরনের স্তর। তাই মোদী তাঁর মন্ত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় বা পূর্বশর্ত (pre condition) দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন তা বিবেচনা করা খুবই জরুরি।
আরও পড়ুন- মমতার কেন এমন হলো?
প্রথমত, তিনি কর্মক্ষম ক্ষিপ্র মন্ত্রী চেয়েছেন। যিনি ওঁর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে দৌড়তে পারবেন। যিনি সৎ হবেন। জনসমাজে যার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। অরুণ জেটলি স্বাস্থ্যের কারণে সরে দাঁড়ানোয় “বিগ ফোর” মানে স্বরাষ্ট্র-অর্থ-বিদেশ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রকগুলিতে মোদীকে রদবদল করতে হয়েছে। সুষমা স্বরাজও এবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে নির্বাচন লড়েননি। তাই এই দুই শূন্যপদে নির্মলা সীতারমনকে অর্থমন্ত্রী এবং রাজনাথ সিং-কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী করেছেন মোদী। অন্যদিকে, অমিত শাহ হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর প্রাক্তন বিদেশ সচিব জয়শঙ্কর হলন বিদেশমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আর বিদেশ মন্ত্রকে এবার অগ্রাধিকার কী হবে, নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তি চয়ন থেকে সেটাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমত, পুলওয়ামা আক্রমণ এবং বালাকোটে পাল্টা হানার পর ভারতের বিদেশনীতি এবার দ্রুত গতিতে এগোবে। ভারত পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করলেও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার সঙ্গেও দ্রুত বাণিজ্য নিয়ে যেসব মার্কিন দাবি তা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করবে। তৃতীয়ত, রাশিয়া এবং ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গেও সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। এমনকি ধীরে ধীরে আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গেও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ রোধে কিছুটা চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে ইমরান খান আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। এ ধরনের জটিল কূটনীতির জন্য জয়শঙ্করের মতো বিদেশমন্ত্রীর বিশেষ প্রয়োজন ছিল, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
এদিকে আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে অমিত শাহ। ফলে, পাকিস্তানের মদতপুষ্ট কাশ্মীরী জঙ্গি বা বিদেশি সন্ত্রাসবাদীদের নির্মূল করে দেওয়ার জন্য যে সঙ্কল্প নিয়েছেন মোদী-অমিত শাহ তা সুচারুভাবে রূপায়নই হবে নয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রধান কাজ। মোদী আর অমিত শাহের মধ্যে এক গুরু-শিষ্য সম্পর্ক আছে। তাই, কাশ্মীর অমিত শাহের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবেই। নেহেরুর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন বল্লভ ভাই পটেল। বাজপেয়ীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন লালকৃষ্ণ আডবানী। নর্থব্লকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পটেলের এক বিশাল সাদাকালো ছবি আছে। এই বিশাল ছবিটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ আজ। কারণ, আডবানী জিততেন গাধীনগর থেকে, অমিত শাহও এলেন সেই আসন থেকে, আডবানীর রেকর্ড ভেঙে আরও বেশী ভোটে। অমিত শাহর মত আডবানীও একদিন দলের সভাপতি ছিলেন। এমনিতে ভয়ঙ্কর পরিশ্রমী অমিত শাহ। আমি নিজে দেখেছি ওঁর হাই সুগার। চপারে বসে ইনসুলিন ইঞ্জেকশান নিয়ে দৌড়চ্ছেন ভোটের প্রচারে। তাই অমিত শাহ হলেন ম্যান অফ অ্যাকশন। তাঁর লক্ষ্য হবে ৩৭০ ধারা আর ৩৫-বি নিয়ে আশু আলাপ-আলোচনা শুরু করা। তবে রাজ্যসভায় বিজেপির আসন সংখ্যা এখনও বেশ কম। বিজেপি রাজ্যসভায় এখনও সংখ্যালঘু। তাই ৩৭০ ধারা নিয়ে বিল নিয়ে এলেও এখনই পাশ করাতে পারবে না। তাই বিজেপি নেতা অমিত শাহ অপেক্ষা করবেন রাজ্যসভায় কত দ্রুত সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করা যায়, সে জন্য। তাছাড়া, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের চরিত্রও অনেকটা বদলে গিয়েছে। হুরিয়ত নেতারা আর আগের মতো প্রাসঙ্গিক নন, তবে জায়গায়-জায়গায় উপত্যকার কোণে কোণে অনেক যুবক জঙ্গি নেতা তৈরী হয়েছে। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার চেষ্টাও করেছিলেন রাজনাথ সিংহ। তখন অবশ্য মেহবুবা মুফতির সঙ্গে বিজেপির যৌথ সরকার ছিল। তবে আজ আর সেই সমঝোতা নেই। অমিত শাহের প্রাথমিক কৌশল হবে আগে ডান্ডা মেরে এই সব জঙ্গিদের ঠান্ডা করা। চাপে পড়লে তবেই ওই যুবকরা আলাপ-আলোচনার পথে আসতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান দীনেশ্বর শর্মাকে মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব দিয়েছিল রাজনাথ সিং। সেই দীনেশ্বর শর্মার সঙ্গে অমিত শাহ এখন কথা বলবেন, যাতে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ভিত্তিক রিপোর্টি বুঝতে পারেন। এছাড়া, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, পুলিশের আধুনিকীকরণ, বে-আইনি অনুপ্রবেশ, জাল ভিসা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি, পাকিস্তান ও চীনের তৎপরতা এসব বিষয় অমিত শাহ বিচার-বিশ্লেষণ করবেন। পাশাপাশি, গোয়েন্দা বিভাগগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করাও হবে অমিত শাহর অন্যতম লক্ষ্য। আইএএস, আইপিএস–দের বদলি ও নিয়োগ নীতিতে সংস্কারও প্রয়োজন। তাই জয়শঙ্কর এবং অমিত শাহ এই দুই মন্ত্রীর মধ্যে সমন্বয় ঘটা মোদীর জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়। এঁদের মধ্যে একজন কট্টরবাদী রাষ্ট্রবাদের পথে যাবেন, তিনি অমিত শাহ। আর অন্যজন 'বসুধৈব কুটুম্বকম' বলে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের কথা বলবেন, তিনি জয়শঙ্কর। আর এই দুই জন সম্মিলিতভাবে আসলে নরেন্দ্র মোদীর জন্য কাজ করবেন। এর পাশাপাশি, মোদী তাঁর পুরোনো টিমকে রেল, পরিবহন, তথ্য-প্রচার, পেট্রোলিয়াম, তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রকেই রেখেছেন। ফলে পীযূষ গোয়েল, রবিশঙ্কর প্রসাদ, নীতীন গড়কড়ি, প্রকাশ জাভড়েকর, ধর্মেন্দ্র প্রধান সকলেই আছেন।
আরও পড়ুন- মোদী আবার কেন?
যাঁদের মন্ত্রীর পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা বিদ্রোহ করেছেন, এমন কোনও নজির দেখা যায়নি। অটল বিহারী বাজপায়ী প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে সিকন্দর বখতকে বিদেশমন্ত্রী করেছিলেন এবং কেন তাঁকে অর্থমন্ত্রী করা হবে না, সেই গোঁসায় তিনি সাউথ ব্লকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে আসেননি প্রথম দু-তিন দিন। মোদী জমানায় এরকম দৃশ্য অকল্পনীয়। যশবন্ত সিনহা, অরুন শৌরী, আর শত্রুঘ্ন সিনহা বিদ্রোহ করতে গিয়ে দলছাড়া হয়েছেন। এসব দেখে অনেকে বলেন মোদী আসলে স্বৈরতন্ত্রী। এ এক অঘোষিত জরুরী অবস্থা, তাই বিবিধ কন্ঠস্বর নেই। কিন্তু আমার মনে হয়, যাঁরা এটা বলেছেন, তাঁরা ঠিক কথা বলছেন না। আসলে দেশের কোটি কোটি মানুষ এখনও মোদীর প্রতি অগাধ আস্থা রাখেন। তাঁকে বিপুলভাবে ভোট দেন আর সেই মানুষের ভোটে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বলেই তাঁর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব এত মজবুত। মানুষের বিপুল সমর্থনে তিনি “মোদী”। আর তাই কতিপয় মানুষ যদি নিজেদের স্বার্থে ঘা লাগায় মোদী বিরোধিতা করতে যান, তবে তাঁরাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। মানুষ তাদেরই আস্তাকুড়েতে নিক্ষেপ করবেন। আর তাই এ হল মোদী সরকারের এক নতুন অধ্যায়। নবকলেবরে নরেন্দ্র মোদী।
(লেখক প্রবীণ সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত)