Advertisment

সেমাইয়ের পায়েস, ইদ-উল-ফিৎর, ও চারু মজুমদার

ইদের দিন অভাবী ও দুঃস্থদের 'ফিৎরা' দেওয়া হয়। এই জাকাত আল-ফিৎর-এর জন্য রোজার ইদের নাম ইদ-উল-ফিৎর।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Eid-ul-fitr 2020

রোজার ইদে সেমাই হয় না, এমন বাঙালি মুসলমান বাড়ি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর

রমজান মাসের পর হিজরি অব্দে শাওয়াল মাস আসে। পয়লা শাওয়াল হয় ইদ-উল-ফিৎর। রোজা ভাঙার দিন হলো এই ইদ। ইদ মানে উৎসব। রোজার ইদ বাঙালি মুসলমানের সবচেয়ে বড় উৎসব। ইদের দিন অভাবী ও দুঃস্থদের 'ফিৎরা' দেওয়া হয়। ইদের নামাজের আগেই তা মিটিয়ে দিতে হয়। সম্পত্তির একটা অংশ গরিবদের দান করা বা জাকাত দেওয়া (জাকাত আল-মাল ও জাকাত আল-ফিৎর অন্যতম) বাধ্যতামূলক ও ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। এই জাকাত আল-ফিৎর-এর জন্য রোজার ইদের নাম ইদ-উল-ফিৎর। গরিবকে তাঁর হক বা অধিকার বুঝিয়ে দিতে হয়।

Advertisment

চারু মজুমদার ভালবাসতেন সেমাই। সারা জীবন সংগ্রামের মধ্যে আর আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা মানুষটির কোনও বিলাস ছিল না। নবারুণ ভট্টাচার্যের বয়স তখন পঁচিশ কী ছাব্বিশ, তিনি ঋত্বিক ঘটক (নবারুণের মাতামহের ভ্রাতা)-এর সঙ্গে এন্টালি পাড়ায় গিয়েছিলেন চারুবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। অমায়িক, মিষ্টভাষী লোকটিকে দেখেই যুবক নবারুণের মনে হয়েছিল, এমন চারু বাক যাঁর, তাঁকে কী অবলীলায় ধ্বংসের রাজনীতির স্থপতি হিসাবে ইতিহাসে ঠাঁই করে দিল রাষ্ট্র! চারুবাবুর নাকে অক্সিজেন নল লাগানো ছিল। পুলিশ তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। একজন মুসলমান রিকশাওয়ালা রাতে অক্সিজেনের সিলিন্ডার এনে দেয়, সেই চারুবাবুর নাকে নল লাগিয়ে ফিট করে দিয়ে চলে যায়, আর পুরোনো ফাঁকা সিলিন্ডার ফেরত নিয়ে যায়। চারু মজুমদারের ছিল হাঁপানির ব্যামো। যে অঞ্চলে থাকতেন তিনি, সেই এন্টালির এই তল্লাটটি ছিল মোটামুটি মুসলিম-অধ্যুষিত।

রোজার ইদে সেমাই হয় না, এমন বাঙালি মুসলমান বাড়ি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শুধু বাঙালি কেন, ভারতের প্রায় সব জায়গায় এই দিনে সেমাইয়ের পায়েস হয়। বাংলাতে যেমন সেমাই, সিমুই, সামাই ইত্যাদি বলে ডাকা হয়, দক্ষিণ ভারতে এই পদটিকে বলে সেভাই। কোথাও কোথাও সেমিয়া বা সেভিয়াঁ নামও রয়েছে। বাংলায় সেমাই নামক সুখাদ্য খুব পুরোনো নয়। ঊনবিংশ শতকের আগে সেমাইয়ের চল ছিল না। মুঘল যুগে বা নবাবি আমলেও খাদ্যটির বর্ণনা চোখে পড়ে না। 'সেমাই' শব্দটির উৎপত্তি নিয়েই খুব স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় না।

publive-image আরবিতে সেমাইকে বলে 'শে’রেয়া'। মিশরে শে'রেয়ার কদর খুব।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, গ্রিক 'সেমিদালিস' শব্দ থেকে অর্বাচীন সংস্কৃত শব্দ 'সমিদা' এসেছে। অবশ্য 'সমিদা' নামক শব্দ আরবি ভাষায় আছে। এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি পার্ক সার্কাস ময়দানে নাগরিক-সংশোধনী-আইন-বিরোধী ধর্নামঞ্চে যে ভদ্রমহিলা শহীদ হলেন, তাঁর নাম সমিদা বেগম। বলা হয়ে থাকে, এই আরবি অথবা সংস্কৃত 'সমিদা' থেকে বাংলায় সেমাই বা সমাই এসেছে। আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণের সময় এই সুখাদ্য এ দেশে এসেছে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন।

মজার কথা হলো, গ্রিক 'সেমিদালিস' শব্দটি আদতে গ্রিক নয়। অভিধান বলছে, গ্রিক ভাষায় এই শব্দটি বহিরাগত। 'সেমিদালিস' বাইবেলে আছে, সেখানে তার মানে হল সূক্ষ্ম ময়দা। খ্রিস্টধর্মে সেমিদালিস পবিত্র খাদ্য হিসাবে বিবেচিত। মূলত গম থেকে তৈরি হয়। সেমাইয়ের কাছাকাছি ইংরেজি প্রতিশব্দ 'ভারমিচেলি' এসেছে ইতালীয় শব্দ 'ভারমিয়েল্লি' থেকে। শব্দটি তুসকান, ১৩৩৮ সালে তার প্রথম দেখা মেলে 'ওরাটি' ছদ্মনামে। তবে রান্নার বইয়ে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৫ শতকে, 'দ্য আর্ট অফ কুকিং' নামক গ্রন্থে। কালজয়ী শেফ মার্টিনো দ্য কোমো সেই বইয়ের লেখক।

চারু মজুমদারের লেখা বইপত্র পাওয়া যায়। তবে জীবনীমূলক কোনও বড় কাজ এখনও হয়নি বলেই মনে হয়। তখন দেবী রায় ডিসি ডিডি ওয়ান। ঘোর নকশাল আন্দোলন চলছে। নকশাল আন্দোলন বললেই এমন ভাবনা চলে আসে যে হত্যালীলা (কারা হত্যালীলা চালিয়েছিল, তা গবেষণা সন্দর্ভ পড়লে জানা যায়) চলছে, সেই ছবিই জনমানসে ও গণমাধ্যমে চিত্রিত। আসলে নকশালবাড়ির আন্দোলন তেভাগা আন্দোলনের উত্তর-পাঠ। তেভাগা আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন চারু মজুমদার। জেল খেটেছেন। পার্টি ভাগ হওয়ার সময় সিপিআইএম-এ যোগ দিলেন। তার পর সিপিআইএম ত্যাগ, সিপিআইএমএল-এর প্রতিষ্ঠা। তিনি মধ্যবিত্তের নেতা ছিলেন না, ছিলেন অন্ত্যজদের নেতা, সর্বহারার বন্ধু।

১৯৭২ সালের জুলাই মাস। দেবী রায় লালবাজারে বসে নকশাল সেল তৈরি করে বাছা বাছা তরুণ অফিসারদের পাঠালেন রাঁচিতে, সেখানে নাকি কলকাতার একদল নকশাল ছোকরা ডেরা বেঁধেছে, তাদের গ্রেপ্তার করে আনতে হবে। তরুণ অফিসাররা সব গেলেন। একজন রয়ে গেলেন। তাঁর মন খারাপ। তাঁকে ডেকে পাঠালেন দেবী রায়। বললেন, "ওই যে দেখছ, লালবাজারের উল্টোদিকের কোল্ড ড্রিঙ্কসের দোকান, ওখানে একটা ছেলে কোল্ড ড্রিঙ্ক খাচ্ছে, ওকে ধরে নিয়ে এসো।" এটা কোনও পুলিশ অফিসারের কাজ হলো! তরুণ অফিসার অপমানিত হলেন। ছেলেটিকে নিয়ে এসে অনেক তল্লাশি চালিয়ে তার থেকে কয়েকটা রশিদ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। মৌলালি অঞ্চলের একটি দোকানের অক্সিজেন সিলিন্ডার সাপ্লাইয়ের রশিদ।

publive-image চারু মজুমদার। ছবি সৌজন্য: সিপিআইএমএল

একটু পরে চিৎপুর থেকে একজন যাত্রাপার্টির লোক এসে তরুণ অফিসারকে লুঙ্গি ফতুয়া পরিয়ে এবং মুখে দাড়ি লাগিয়ে দিলেন। কীভাবে রিকশা টানতে হয়, সে নিয়ে খানিক প্রায়োগিক কথা ও অনুশীলন হলো। আর একজন ভদ্রলোক এসে অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার শিখিয়ে দিয়ে গেলেন। রাত এগারোটায় সেই তরুণ পুলিশ অফিসার বেরোলেন রিকশা নিয়ে। সিআইটি রোডের একটি ভাঙাচোরা বাড়ি, অদূরে কনভেন্ট রোড, অন্য পাশে এন্টালি থানা। তরুণ অফিসার সেই বাড়ির একটি নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে টোকা মারলেন। দরজা খুলে গেল। পুরনো সিলিন্ডার খুলে নতুন সিলিন্ডার লাগানোর কাজ শেষ। অক্সিজেনের নল চারু মজুমদারের নাকে লাগিয়ে পকেট থেকে রিভলভার বের করে তাঁর বুকে ঠেকালেন পুলিশ অফিসার রুনু গুহনিয়োগী। ততক্ষণে চারপাশে থিকথিক করছে পুলিশ। একজন অস্ত্রহীন রুগ্ন মানুষকে গ্রেপ্তারের এত আয়োজন। যে সব পুলিশ অফিসারদের রাঁচি পাঠানো হয়েছে, তাঁরা থাকলে নাকি এই অপারেশনের খবর চাউর হয়ে যেত!

জট পাকিয়ে যাওয়া সেমাইয়ের চরিত্র। সেই জট খুলে যায় যদি তাকে সরল দুধে ভাসিয়ে অল্প মিষ্টি দেওয়া যায়। সেই কাজ করেছিলেন চারুবাবু। জটের ছাড়ান দিলেই অপূর্ব এক পদ তৈরি হয় সমাজে। তার নাম সেমাইয়ের পায়েস। চারু মজুমদার আদৌ তা ভালবাসতেন কিনা জানা নেই, তবে নবারুণ বাসতেন। ব্লাড সুগার ছিল বেশি, তাই বুঝেশুনে খেতে হতো, এই আর কী!

কেমন ভাবে বানাবেন এই পদ?

সেমাই বানানোর পেতলের কল এখনও বহু বাড়িতে পাওয়া যায়। যার একদিকে ময়দা বা আটার মণ্ড ভরে ঘোরালে অন্য মুখ দিয়ে সেমাই বের হয়। তা রোদে শুকিয়ে নিয়ে রাখতে হয়। এই শুকনো সেমাই ভাল করে গরম কড়াইতে নেড়েচেড়ে নিয়ে বাদামি করে রান্না করতে হয়। প্রধান উপাদান দুধ ও চিনি। তবে আজকাল লাচ্ছা সেমাইয়ের যুগ এসেছে। বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। বাড়িতে নিজেও লাচ্ছা সেমাই বানানো যায় খুব সহজ পদ্ধতিতে। কিন্তু এই লেখায় শুধু দেশি সেমাইয়ের প্রণালী বলা হবে।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে সেমাই খাওয়ার রীতি আছে। তবে সব জায়গায় তা মিষ্টি পদ হিসাবে বিবেচিত হয় না। নোনতা বা ঝাল সেমাইয়ের কথা বলছি না। সোমালিয়ায় মাখন, চিনি, জল ও এলাচ দিয়ে ডেজার্ট হিসাবে খাওয়া হয়। ইয়েমেনের 'আ-ত্রিয়াহ' বাংলার সেমাইয়ের মতো। আরবিতে সেমাইকে বলে 'শে’রেয়া'। মিশরে শে'রেয়ার কদর খুব।

বাঙালি সেমাইয়ের পায়েসের উপকরণ

সেমাই (ঘরে বানানো কিংবা কিনে আনা সাধারণ সেমাই) - ২০০ গ্রাম

চিনি - আধ কাপ

এলাচ - ৩ টে

দারচিনি - ২ টুকরো

তেজপাতা - ১টি

দুধ - ১ লিটার

প্রণালী

দুধ জ্বাল দিয়ে গরম করুন। তাতে চিনি মেশান, চিনি গলে গেলে তেজপাতা, এলাচ ও দারচিনি দিন। খালি অন্য একটি কড়াইতে শুকনো সেমাই ভেজে নিন। তেল দেবেন না। মচমচে হলে গরম দুধে মেশান। এক ফুট দিয়ে নামিয়ে রাখুন। আধ ঘন্টা ভিজতে দিন। তার পর পরিবেশন করুন। পরিবেশনের সময় ইচ্ছে হলে ওপরে ড্রাই ফ্রুটস (কাজু, কিশমিশ, পেস্তা ইত্যাদি) ছড়িয়ে দিন। এই সেমাই খেলে আপনার মুখ থেকে পেট, পেট থেকে প্রাণ রসময় হয়ে উঠবে। বাক হবে চারু। চারু বাক। রান্নার মধ্যে, বাকিটুকু পেটের মধ্যে খুলে যাবে সেমাই বা সেভাইয়ের জট।

সামাজিক জট ছাড়ানো ছিল চারু মজুমদার ও তাঁর পার্টির উদ্দেশ্য। তেভাগাতে চাষি আন্দোলন করেছিল তিন ভাগের দু'ভাগ ফসলের দাবিতে। নকশালবাড়ি ছিল সেই আন্দোলনের পরিবর্ধিত ধারা। চাষি জমি চাষ করবে কিন্তু ফসলের সিংহভাগ পাবে মালিক। সেই মৌলিক ও সরল জট ছাড়াতে চেয়েছিলেন চারুবাবুরা। নিপীড়িতদের নেতা চারু মজুমদারকে 'খুনি' তকমা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই রাতে।

পুলিশি হেফাজতে টানা ১২ দিন ছিলেন লালবাজার লক আপে। জেরার পর জেরা। কখনও বিশ্রাম পাননি অসুস্থ চারুবাবু। ১২ দিনের এক দিনও আদালতে তোলা হয়নি তাঁকে। ওষুধপত্র, অক্সিজেন, কিছুই দেওয়া হয়নি। ২৮ জুলাই তিনি ইন্তেকাল করেন। কেওড়াতলা শ্মশান দেখেছিল তাঁর পায়ের নীচের অংশ, যাকে ইংরেজিতে 'সোল' বলা হয়, তা ছিল ঘনঘোর কৃষ্ণবর্ণ। অদূরে দাঁড়িয়েছিলেন বাঘা বাঘা পুলিশ অফিসারেরা। সেমাইয়ের জট রান্না করে, এবং খেয়ে খুলে ফেলার শপথ নিই এই ইদ-উল-ফিৎর-এ।

ইদ মুবারক!

(লেখক ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ও দর্শনের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment