আবার এসে গেল ৮ মার্চ, নারীদিবস, আবার কিছু মিটিংমিছিল, কিছু আলোচনা, কিছু অনুষ্ঠান, বাজারের নানা বিপণিতে কিছু চমকদার ছাড়ের ঘোষণা, সব মিলিয়ে ষোলআনা। আবারও কিছু মানুষ ঘ্যানঘ্যান করতে থাকেন – একটা দিনকে নারীদিবস বলে কিসের মাথা কিনে নেওয়া হচ্ছে, কেউ কেউ হইচই করেন - পুরুষ দিবসই বা তবে হবে না কেন। কেউ আবার যত্ন করে বোঝাতে বসেন কেন নারী দিবসটা বিশেষ, সমান কাজে সমান মজুরি চেয়ে কোন নারী কবে কোথায় আন্দোলন শুরু করেছিল, পুরুষরা কার সঙ্গে সমতা চেয়ে আন্দোলন করবেন, নারীর সঙ্গে কি? যা শুনে পুরুষদিবসাকাঙ্ক্ষী জনতা থতমত খেয়ে চুপ করে যান, ইত্যাদি।
দিনের শেষে দেখি দুটো পরিচয়ই ঘুরে ফিরে আসে যায়, নারী – যাকে নিয়ে এই দিবসটি হচ্ছে, আর পুরুষ – যে ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলছে অথচ তাকিয়ে দেখছে না যে বাকি ৩৬৪ দিন তাকে নিয়েই উদযাপন চলেছে আকণ্ঠ। এইভাবে ৩৬৪ আর ১ যোগ করলে নিখুঁত ৩৬৫ পেয়ে যাই আমরা, নারী ও পুরুষ মিলে এইভাবেই বছর বা জীবন বা জগতের যাবতীয় সম্ভার ভাগাভাগি করে নেবার চেষ্টা করি, কিছুটা কাড়াকাড়ি, মারামারি, হুড়োহুড়িও হয়, নারীও আজ বিনা যুদ্ধে সুচ্যগ্র মেদিনী না দেবার স্পর্ধায় পৌঁছেছে কোনও কোনও ক্ষেত্রে, আমারও কিছু সশক্তিকরণ ঘটেছে বইকি।
আরও পড়ুন, নারীদিবস ও মি টু আন্দোলনের তাৎপর্য
৮ মার্চের কথা ভাবতে গিয়ে শিবের গীতের মতোই মনে পড়ে যায় ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় আয়োজিত হওয়া ভারতীয় নারী আন্দোলনের সপ্তম জাতীয় সম্মেলনের কথা, যা নানা কারণে স্মরণীয় ও ঘটনাবহুল। এই সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক কলকাতার একটি ছোট্ট সংগঠনের (স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি) কর্মী/সদস্য হিসাবে সেদিন কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা, এবং আমাদের মতোই আরও কেউ কেউ। নারী কে? প্রশ্নটি অতীব সরল ও তদধিক ভুল্ভুলাইয়া। নারী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র যে নারী, সে কে? সেই ২০০৬ সালে কিছু দ্বন্দ্ব, কিছু আলোচনা, ও বিস্তর চাপানউতরের পরেও মূল স্রোতের নারী আন্দোলন শরীরকেই নারীত্বের মূল পাদপীঠ বলে মনে করেছিল, তাই শারীরিক লিঙ্গ অনুসারে যে মানুষ নারীচিহ্নিত সেইই নারী এমনটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল। সম্মেলনে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন নারীচিহ্নিতেরাই, আর কিছু হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষ যারা লিঙ্গ বিষয়ক একটি বিশেষ আলোচনাসভায় যোগ দিতে পেরেছিলেন।
নারী কে, এই প্রশ্নের উত্তর অতএব আমাদের পাওয়া হয়নি সে যাত্রায়। জন্মসূত্রের নারীচিহ্ন যার কাছে প্রকৃতির ভুল, সমাজের দাগিয়ে দেওয়া অন্যায়, তাকে কেন নারী বলবে নারী আন্দোলন, আর প্রকৃতির সেই একই ভুলের স্বীকার হয়ে, সমাজের একই দাগে দাগিয়ে দেওয়া পুরুষচিহ্নধারী মানুষ যে নিজেকে নারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, তাকে কেন সসম্মানে গ্রহণ করা হবে না এই আন্দোলনের শরিক হিসাবে, এ প্রশ্নের উত্তর সেদিন আমরা পাইনি। সেদিনের নারী আন্দোলন, দুইয়ের পরিসরে বিভক্ত নারী আর পুরুষের সোজাসাপটা শারীরিকলিঙ্গনির্ভর পরিচয় ছাড়া আর কিছু দেখতে পায়নি।
৩৬৪র সঙ্গে ১ জুড়লে ৩৬৫ হয় বটে খাতায় কলমে, কিন্তু পুরুষের সঙ্গে নারী জুড়লেই সামগ্রিক মানবজাতি হয়না, মাঝে বহু ফাঁক থেকে যায়, থেকে গেছে। যে সব ফাঁকফোকরে ‘নারী কে’ এই প্রশ্নের সঙ্গে জায়গা করে নিতে পারে ‘পুরুষ কে’ এই প্রশ্নও, আর কেন শুধু নারী আর পুরুষের দুধার বিভাজনেই আটকে থাকবে যাবতীয় লিঙ্গ পরিচয়, এই প্রশ্ন তো সবার আগে উঠে আসতে পারে। ২০০৬ এর সেই উত্তরহীন প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু মানুষও বাধ্য হয়েছিলেন ভাবনা শুরু করতে - স্তন-যোনি-জরায়ু-ডিম্বকোষ দিয়েই কি নারী, নাকি এর বাইরেও নারীত্ব বলে অন্য কিছু আছে যার বলে আপাত অ-নারীও নারী হয়ে উঠতে পারে। তেমনি আবার পুরুষত্বই বা কী? পুরুষাঙ্গ-অণ্ডকোষ-শুক্রাশয়? দাড়িগোঁফ? আন্দোলনের মধ্যে কে থাকবে আর বাদ পড়ে যাবে কে বা কারা? নারী-পুরুষ, ট্রান্সম্যান-ট্রান্সউওম্যান ছাড়া আরও যারা আছেন, জেন্ডার স্পেকট্রামের নানা জায়গায় বাসিন্দা যে সব মানুষ, তাঁদের যাবতীয় বৈচিত্র কি আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলে পড়ে যাবে?
আরও পড়ুন, “আমাদের মতো মানুষরা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে চান না”
২০০৬ থেকে বিস্তর জল গড়িয়েছে নানা পথে, তারপর এই ২০১৯এও মাত্রই কয়েকদিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় যোগ দিয়েছিলাম, যেখানে মূলস্রোতের কিছু নারী সংগঠন, কিছু ছাত্র সংগঠন ও কিছু ক্যুইয়ার আন্দোলনকর্মী একসঙ্গে বসে বোঝার চেষ্টা করছিলাম আমাদের আন্দোলন পরস্পরের সাপেক্ষে কোথায় দাঁড়িয়ে। যা বেশ পরিষ্কার ভাবে উঠে এল তা হল মূল স্রোতের নারী সংগঠনেরা মূলত দুটো বিষয়কে খুঁটি হিসাবে ধরে কাজ করছেন, একটা মেয়েদের জীবন-জীবিকা, অন্যটা মেয়েদের ওপর ঘটা হিংসা-অত্যাচার। লিঙ্গবৈষম্য ও তার বিরোধিতা হল আন্দোলনের মূল কথা। অথচ যখন সেই লিঙ্গবৈষম্যকেই নারী-পুরুষ ছক থেকে বার করে নিয়ে সিস-ট্রান্স ছকে ফেলা হচ্ছে তখনি বিষয়টা গুলিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ‘নারী’কে কেন্দ্রে রেখে যে আন্দোলন তার মধ্যে ‘অ-নারী’ ঢুকে পড়ে বিষয়টা এলোমেলো করে দিচ্ছে। ঠিক এই অবস্থানের সামনে দাঁড়িয়েই একদিন আমেরিকার সাদা, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, শহুরে নারীদের আন্দোলনকে প্রশ্ন করেছিল কালো মেয়েরা, যেভাবে বিবাহিত, বিসমকামী, সন্তানবতী নারীদের আন্দোলনকে প্রশ্ন করেছিল সমকামী মেয়েরা, তেমনি আমাদের দেশে দলিত নারীরা প্রশ্ন করছে আজ সবর্ণ নারীদের, সমকামী নারীরা যৌনতার অধিকারকে সামনে তুলে এনে ধরেছে, ‘অ-নারী’ মানুষেরাও প্রশ্ন করছে শারীরিক নারীদের – এই আন্দোলনে আমরা কোথায়, আমাদের কথা শোনা যাচ্ছে না কেন।
খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জীবিকা, যে কোনও আন্দোলনের কেন্দ্রে থাকে এইসব দাবি, কিন্তু কবে আমরা বুঝব যে এই সাধারণ চাহিদাও আসলে স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে বিশেষ হয়ে ওঠে। নারী মানেই একটা নির্ভেজাল, নিটোল, নিখুঁত আইডেন্টিটি নয়, নারী কে তার ওপর নির্ভর করে তার দাবি। নারী আন্দোলন যদি এক ছাঁচে সব নারীর সমস্যা ও সমাধান বুঝতে চায় তা কখনো ঘটে উঠবে না। নারী মানে শুধুই শারীরিক নারী নয়, আরও অনেক কিছু এবং শারীরিক নারীচিহ্ন থাকলেও সে মানুষ নারী হিসাবে নিজেকে পরিচিত নাও করতে চাইতে পারে, এই সব সম্ভাবনাকে জায়গা দিতে হবে আন্দোলনের মঞ্চে।
অর্থাৎ একদিকে ৩৬৪ দিনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে একখানি মাত্র নারীদিবস, আর অন্যদিকে সেই ১ ও ৩৬৪র ফাঁকে গলে পড়ে যাচ্ছে আরও যা কিছু সব। সুখের কথা একটাই যে ৩৬৪র মধ্যে জায়গা না জুটলেও বৃহত্তর নারী আন্দোলন ও ফলত নারীদিবসের মধ্যে জায়গা করে নিতে পেরেছেন সেইসব বিশেষ নারী মানুষেরাও, যারা জন্মসুত্রে নারীচিহ্নিত শরীর না পেলেও সত্ত্বার মধ্যে ধারণ করেছেন নারীত্ব, এবং সেই সুত্রেই হয়ে উঠেছেন নারী। আর তেমন কিছু মানুষও জায়গা পেয়েছেন যারা জন্মসুত্রে নারীচিহ্নিত শরীর নিয়ে জন্মালেও অন্তরে ধারণ করে আছেন পুরুষ সত্তাকে, নারী না হলেও নারীদিবসের আয়োজনে শামিল হতে পারেন তারাও। আশা করি একদিন সামগ্রিক নারী আন্দোলন ও নারীদিবসের ধরতাই বাঁধা হবে নারী কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যে দিয়ে, নারীকে অখণ্ড একটা বস্তু হিসাবে আগে থেকে ধরে নিয়ে কথা শুরু হবে না আর।
(লেখক ক্যুইয়ার ফেমিনিস্ট অ্যাকটিভিস্ট)