দিনক্ষণ, মাস মনে নেই। মনে আছে বছর। ১৯৬২ সাল। পাবনার নগরবাড়ি থেকে ঢাকায়, ফেরিতে। একদল লোক, ফেরিতে যাত্রী, স্লোগান দিচ্ছেন, "শেখ মুজিব, শেখ মুজিব"।
কে শেখ মুজিব, কিচ্ছু জানিনে, বয়স তখন দশ। লক্ষ্য করলুম, একজন মানুষ, বেশ সুঠাম, গোঁফ নজর কাড়ার, কেবিন থেকে বেরিয়ে স্লোগানিদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। মানুষটি কে? অচেনা।
কেবিনের সামনে ঘুরঘুর করছিলুম। কেউ একজন ধমক দেন। ধমকে, ফেরির কেবিনে ঢুকে পড়ি। মেজআপা জ্যোৎস্না জিজ্ঞেস করেন, কারণ কী? বলি। তিনি দেখতে যান (তাঁর সঙ্গেই ঢাকায় যাত্রা)। ফিরে এসে বলেন, "চল। কেবিনে চাচা আছেন (চাচা মানে মনসুর আলি। শেখ মুজিবের অন্যতম লেফটেনান্ট। পাড়াতুতো চাচা। আব্বার ঘনিষ্ঠ। স্বাধীনতার পরে মনসুর আলি বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)"। গেলুম। চাচা কফি বলেছিলেন, মেজআপার মুখে শোনা, "আয়, নেতাকে সালাম কর।" আপা সালাম করেছিলেন কী না বলেননি, বলেন, "তোকে সালাম করতে বলেছিলাম। তুই সালাম দিয়েছিলি। কেবিনের বাইরে থেকে দেখেছি। শেখ মুজিব তোর মাথায় হাত রেখে কী সব বলছিল।"
কী বলছিলেন, এত বছর পরে মনে নেই, একটি কথা তথা বাক্য কানে বাজে, "বাবা, মানুষ হও, ঠিকমতো লেখাপড়া করবে।"
শেখ মুজিবের নির্দেশ মানিনি, মানুষ হইনি, লেখাপড়াও শিখিনি। আমাদের আরেক আত্মীয়া, বেগমবু, ৩২ ধানমন্ডির পয়লা নম্বরের বাসিন্দা, শেখ মুজিবের কয়েকটা বাড়ির পরে, দেখেছি, শেখ মুজিবের বড়ো কন্যা শেখ হাসিনা (এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) প্রায়ই আসেন, বেগমবুর বড়ো কন্যা শিরিনের বান্ধবী, সহপাঠিনী। লুলুআপাও (সুলতানা কামাল। কবি সুফিয়া কামালের মেয়ে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা)। ওঁরা বন্ধু। শেখ হাসিনাকে তখন থেকে চিনি। জানি, শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। এই জানার চেয়ে বেশি, শিরিনখালার বান্ধবী।
গণ আন্দোলনে (১৯৬৯) শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্ত, ঘরে ফিরেছেন, শিরিনখালা বললেন, "চল"। আমরা ফুল নিয়ে গেলুম। শেখ মুজিব খুশি হলেন, শিরিনখালাকে কী বললেন, শুনেছি ঠিকই, স্মরণ নেই পঞ্চাশ বছর পরে।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাসকয়েক আগে মস্কোর প্রগ্রেস পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিনের বই (বাংলায় অনুবাদ) পড়ে মগজে ভিন্নস্রোত, মার্ক্সবাদে ঝুঁকলুম। ছাত্র ইউনিয়নে (রুশপন্থী। লোকে কয় মস্কোপন্থী) উদ্দীপ্ত। মনি সিং, অধ্যাপক, মতিয়া চৌধুরী আদর্শ। কিন্তু, শেখ মুজিবের (আওয়ামি লিগের। তখন বলতুম 'আলি'-র বিক্ষোভ, মিছিল। আ.লি., সংক্ষিপ্ত আওয়ামি লিগ) মিছিল বিক্ষোভ হলেই হাজির। ছাত্র ইউনিয়নের মিছিল হয় বটে, বেশি নয়, মাঝে মাঝে। কমিউনিস্ট পার্টির মিছিল, মিটিং কালেভদ্রে।
লক্ষ্য করি, ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-নেত্রীর মুখে কেবল কচকচানি, তত্ত্ব, থিয়োরি, পরিকল্পনা। আলি-র ওসব নেই, বিক্ষোভ, মিছিল, ডিরেক্ট অ্যাকশন।
ছাত্র ইউনিয়নকে অনেকেই বলতে শুরু করে, নাচুনে পার্টি, গানের পার্টি, কালচারাল পার্টি। কারণও আছে বলার। অন্য কোনো ছাত্রদল নয়, রাজনৈতিক দল নয়, ছাত্র ইউনিয়ন প্রায় প্রতি মাসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে। বলা হয়, প্রগতিশীল কালচারাল অনুষ্ঠান।
ঠিক যে, বাংলাদেশে এখনও যে সুস্থ কালচারাল ধারা, ছাত্র ইউনিয়নই মূলে। আমরা জানি, প্রত্যেকে জানে, পেটে ভাত না থাকলে, স্বাধীনতা না থাকলে, প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হলে, দুঃস্বপ্নে জীবন কাটালে কালচার বড়ো কোনো ভূমিকার দায় নেয় না। পেট যদি ভর্তি, অর্থে যদি বলীয়ান, নানা রঙের কালচারে আপত্তি নেই।
আপনারা যাঁরা উনসত্তরের অভ্যুত্থান দেখেননি, বর্ণনা করা মুশকিল, গণজোয়ার কাকে বলে। সব কিছু অচল। রাস্তাঘাটে মানুষের ঢল। নাওয়াখাওয়া সব বাদ। পাকিস্তানের ভিত্তিভূমি টলটলায়মান। মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে তখনই প্রস্তুত। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আর কারোর আস্থা নেই। আওয়ামি লিগই ভরসা। আওয়ামি লিগও জেনে গিয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামি লিগের 'ভূমিধ্বস' জয়।
শেখ মুজিবুর রহমানকেই বাংলাদেশ ক্যাপ্টেন মেনে নিয়েছে। হয়ে গেলেন আমারও ক্যাপ্টেন। শেখ মুজিব নন আর। ক্যাপ্টেন 'বঙ্গবন্ধু'।
১৯৭১ সালে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেসকোর্সে, দুপুরের পরে আসবেন, জনমুখে প্রচারিত, সংবাদপত্রেও (মিডিয়া বলতে তখন 'পূর্ব পাকিস্তান রেডিও', 'পূর্ব পাকিস্তান টিভি')। সকাল ন'টার আগেই রেসকোর্সে পৌঁছে গেলুম। সকালে দুটি রুটি খেয়েছিলুম ভাজি দিয়ে, দুটি রুটি পকেটে নিয়ে গেছিলুম। ভাষণের মঞ্চ থেকে পনেরো/কুড়ি ফুট দূরে বসি, সঙ্গে আরও দু'তিনজন বন্ধু। ওঁরাও রুশপন্থী। একটা-দেড়টার আগে লোকলোকারণ্য হয়নি। আমরা জায়গা ছাড়ি না। বঙ্গবন্ধুকে চোখের সামনে দেখব। বঙ্গবন্ধু দশ জানুয়ারি (১৯৭২) বাংলাদেশে, তেজগাঁ বিমানবন্দরে মানুষ আর মানুষ। ফুল নিয়ে গিয়েছিলুম। দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর কনভয়ে ছুড়ে মারি। গাড়িতে নয়, মাটিতে পড়ে। গাড়ির চাকায় পিষ্ট।
দিনকয়েক পরে বঙ্গবন্ধু কলকাতায়। জানতুম না আসবেন। আমরা চার বন্ধু ভ্রামণিক। নেহাল বললে চল। গেলুম। গড়ের মাঠ। তিলধারণের জায়গা নেই। বঙ্গবন্ধুকে দেখতে আবালবৃদ্ধবনিতা। বাবুলভাই বললেন, "মঞ্চের সামনে যাব।" "কী করে?" প্রশ্ন। বাবুলভাই: "আমাকে সামনে রেখে বলবি মুক্তিযোদ্ধা" (তিনি খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা। কুষ্টিয়া-পাবনা সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন)। আমরা বলি, জায়গাও পাই।
বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' যাঁদের পাঠ, জানেন শেখ মুজিবুর রহমান কী করে আমার/আপনার ক্যাপ্টেন, বঙ্গবন্ধু। জন্ম ২০ জানুয়ারি, ১৯২০, ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় উল্লেখ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ভারতে। সঠিক। তখন অখণ্ড ভারত। পাকিস্তানের নামগন্ধ নেই।
এও ঠিক, ভারত ভাগ না হলে পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম) হয়না। পূর্ব পাকিস্তানের শোষক, নির্যাতক পশ্চিম পাকিস্তান, বঙ্গবন্ধু হাড়েমজ্জায় টের পান, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতায় নিবেদিত, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, জনক। একেই বলে ক্যাপ্টেন। আমাদের পরিচয় আজ বাংলাদেশি। বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমানই সর্বাত্মক নেতা ও ক্যাপ্টেন।