Advertisment

অন্ধকার দূর হয়ে যাক সে আলোর মহাজাগরণে

শাপলা সপর্যিতা বাংলাদেশের কথা সাহিত্যিক। সেখানকার একটি বিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার শিক্ষক তিনি, শেখান ক্রিয়েটিভ রাইটিংও। ভাষা শহিদদের সালাম জানানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন তিনি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
bangladesh bangla language

আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব ব্যথিত হই যখন আমার সন্তান আমার সাথে কথা বলার সময় বলে, ‘ইউ নো, এটা আমাদের অধিকার? অথবা, ‘ওকে, লেট আস ড্রপ ইট। চলো অন্য কথা বলি’ এ ধরনের কথা বলে। তখন তাকে বলি;

Advertisment

পুরোটাই বাংলায় বলো না কেন? অথবা ইংরেজিতে?

পড়াতে গেলাম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। প্রধান শিক্ষক আমাকে বললেন একমাত্র টেক্সট বুঝানোর সময় বাদ দিয়ে বাকি সব কথা ইংরেজিতে বলতে হবে। কিন্তু বাচ্চারা সমানে বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছে। সুপারভাইজার, টিচাররা একটানাই মিশেল দিয়ে খিচুড়ি ভাষায় কথা বলে চলেছেন। বছরে দু তিন বার করে নোটিশ আসছে ইংরেজিতে ছাড়া স্কুলের ভেতরে কোথাও বাংলায় কথা বলা যাবে না। অথচ ক্লাসে দু তিন জন খুব ভালো ছাত্র ছাড়া কেউ পুরোপুরি ইংরেজিতেও কথা বলতে পারছে না, বাংলায়ও না। বাংলা ভাষা, ভাষার বানানের প্রতি ভীষণ উদাসীন কর্তৃপক্ষ। চন্দ্রবিন্দু না দিলে কোনো বানান কাটা যাবেনা, পুরোপুরি নম্বর দিয়ে দিতে হবে । এ রকম নির্দেশনা রয়েছে শিক্ষকের প্রতি। আমি বুঝিনা তাহলে বাঁধন আর বাধন, গাথা আর গাঁথা কিংবা চাঁদ আর চাদের পার্থক্য বুঝবে কীভাবে একজন ছাত্র? যুক্তবর্ণ ভেঙে দেখানো বিষয়টি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্তই নয়। ক্লাস ফাইভ সিক্স এমনকি সেভেনের ছাত্রও ‍যুক্ত ত অর্থাৎ ত্ত কে পড়ছে ও। যত্রতত্রকে পড়ছে যএ তএ। এই যে আপাত হাস্যকর কিন্তু ভেতরে ভয়ঙ্কর এক অন্ধকার তার দায় কার? এই অন্ধকার দূর করবে কে বা কারা? স্কুল ব্যবসা করছে। ভুলে ভরা খাতায় নম্বর দিয়ে ছাত্র পাশ করাচ্ছে। বিপুল অংকের টাকা গুনছে। ছাত্র হয়ে উঠছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘ভ্যালুয়েবল কাস্টমার।’

আরও পড়ুন, শুভঙ্করের ফাঁকি: ‘উনিশ’ থেকে ‘একুশ’ গেলে কত থাকে বাকি?

বাংলাকে বাদ দিয়ে এই যে ভয়ঙ্কর এক আগ্রাসন তা কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নয়, বাড়িতে বাড়িতেও চলছে। যারা ভালো বলছে তারা ইংরেজিতেও ভালো বলছে বাংলাতেও ভালো বলছে। সত্যিকার অর্থে ভাষার প্রথম চর্চাটা আসে পরিবার থেকে। যতই উচ্চ শিক্ষিত হয়ে উঠি আর ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করিনা কেন, নিজের মায়ের ভাষাটা রপ্ত করে না নিলে কোনো অর্জন থাকেনা। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাটাও এরকমই। নিজের ভাষার গাঁথুনি ঠিকঠাক না হলে তার উপরে গড়ে ওঠা অন্য ভাষার পত্তনও বিশেষ জোর পাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। অথচ, মায়ের ভাষার কথা বলবার জন্য যুদ্ধ করতে হবে এমন ধারণা কিংবা সত্য ঘটনা বোধ করি এই বাংলার ভাগ্যেই ঘটেছিল।

এই বাংলা অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। যুগ যুগ ধরে, বংশ পরম্পরায় ভাষা একটি জাতির নিজস্ব সম্পদ। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবার কারণে একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত বলেই পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হলো বাংলাদেশ। অথচ পাশেই রয়ে গেছে বাংলা ভাষাভাষী ভারতের আর একটি অংশ, কলকাতাসহ আরও বেশ কটি প্রদেশ। কিন্তু বাদ সাধলো ধর্ম। হিন্দু মুসলিম প্রশ্ন প্রকট হয়ে দাঁড়ালো। মুসলিমদের এক দেশের অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। থাকুক না তাদের মাঝে হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব, ভাষার ভিন্নতা। যতই থাকুক দুই দেশের সংস্কৃতির ব্যাপক ব্যবধান। শুরু হলো পূর্ব পাকিস্তান (তৎকালীন বাংলাদেশ) শোষণ। সব ধরনের নিষ্পেষনের পাশাপাশি যোগ হলো ভাষা হরণের স্পর্ধা। আর সেই ভাষাকে পাকিস্তানি শাসকের হাত থেকে তাজা রক্তের বিনিময়ে, যুবক প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনতে হলো বাংলাভাষাভাষীকে। ‍কিন্তু ভাষার স্বাধীনতা অর্জনের ছয় দশক পরেও আমরা কি পেরেছি পুরোপুরি নিজের ভাষাটিকে রপ্ত করতে। পেরেছি কি ভাষাটিকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে! কেন যে এই প্রশ্নগুলো আমাকে আজ বড় বেশি ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। বাংলা পৃথিবীর মধ্যে কঠিন ভাষাগুলোর একটি, এটি সত্য। কিন্তু মায়ের ভাষা প্রতি ভালোবাসাটিও তো সত্য। আমার ছাত্র বলছে

-আই হেইট বেঙ্গলি

মা বলছেন

-আমার ছেলে বিদেশে পড়তে যাবে। তার বাংলা জানার অত দরকারটাই বা কী?

আমি ছাত্রকে বলি

-আচ্ছা, দেশের সীমানার বাইরে তুমি যখন পা দেবে তখন তোমার পরিচয় কি দেবে তুমি ?

-বাংলাদেশী

তোমার ভাষা কী বলবে লোককে?

-বাংলা।

-তাহলে?

-তুমি যখন তোমার ভাষাটি ঠিক করে বলতে পারবে না। নিজের দেশের জাতীয় সঙ্গীতটি ঠিক মতো গাইতে পারবেনা তখন কি তোমার পরিচয় সম্পর্কে লোকের সন্দেহ তৈরী হবে না?

ছেলে নির্বোধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বোঝে কী বোঝে না জানিনা। মা বলেন

-অত শত বুঝিনা। বাংলা খুব কঠিন। ছেলে পড়তে চায়না। ওটাকে অতটা গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।

ভাষার প্রতি এই উন্নাস, এই অবহেলা, এই কদর্য অসম্মান ছেলেটিকে দিনে দিনে স্বাজাত্যবোধহীন, ভাষাহীন এক কদর্য বস্তুতে পরিণত করছে এই বিষয়ে সচেতন কে করবে একে?

আরও পড়ুন, ইংরেজি বিভাগে আমরা

অন্যদিকে, সকালের কচি সোনা রোদে শীতের কাঁটাছেড়া ভালোবাসা যখন বিদায় বলছে, তারই ধারেকাছে ঘেঁষে বসেছে বইয়ের মেলা। আসলে বইতো এক উপলক্ষ মাত্র, প্রাণের মেলা বসে এখানে। কত প্রাণ যে এক হয়ে আসে, তারপর সেটা লেখক প্রকাশক পাঠক পার হয়ে আরও সাধারণে মেশে। মিশে যায় তাতে বীর শহীদদেরও গাথা। যারা দিয়েছে প্রাণ এই বাংলায় কথা বলবার জন্য, লিখবার জন্য। যাদের বুকের তাজা রক্ত পিছল পথ নিয়ে এসেছে বাংলা ভাষাভাষীর বাইরেও আরও নানা প্রান্তের মানুষকে অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বকে এক বিশাল প্রয়াসের মাধ্যেমে যুক্ত করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারী আজ দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে, আর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। আমরা বাঙালিরা ফেব্রুয়ারীর একুশ তারিখ খুব ঘটা করে পালন করি। লাল সাদা কাপড় পড়ে হাতে ফুল নিয়ে প্রভাত ফেরি করে শহীদ মিনারে যাই। ফুল দেই শহীদের বেদীতে। সারাদিন বইমেলা ঘুরে এখান সেখানে আনন্দে কাটিয়ে পার করি প্রহরের পর প্রহর। কিন্তু এই ক্ষণিক বাঙালিয়ানা আমার কাছে একেবারেই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায় যখন বাকি দিনগুলোতে শহীদ মিনারের জুতো পায়ে উঠতে দেখি এই বাঙালিকেই। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে এক অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষায় কথা বলতে শুনি। একটি বিশেষ দিন, একটি বিশেষ উপলক্ষ মনে করিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু একদিন সাদা শাড়ি পড়ে, কালো অক্ষরে লেখা আঁচল উড়িয়ে, পাজামা পাঞ্জবীতে শোভিত হয়ে শহীদের বেদির দিকে হেঁটে গিয়ে পরদিনই বড় অলস বিবশ হয়ে পড়ি আমরা। ইংরেজি ভাষায় কথা বলে নিজের আভিজাত্য প্রকাশ করি সগৌরবে। অন্যদিকে আড়ালে গোপনে ধর্মান্ধের ধারালো চাপাতির শাণ দেয়া চলতে থাকে। তাই এই ভাষার মাসেই, এই খোলা বইমেলার প্রান্তরেরই দিন দুপুরে খুন হয়ে যান হুমায়ুন আজাদের মতো বুদ্ধিজীবী, খুন হয়ে যান সচেতন মুক্তমনা লেখক ব্লগার অভিজিত। বিচার হয়না একটি খুনেরও।

একুশ, এই একুশ কেবলই রক্তাক্ত করেছে পথ। যুক্ত করেছে বিশ্ব বাঙালিকে নয় শুধু, যুক্ত করেছে মাতৃভাষাকে ভালোবাসার কিছু মানুষকে পৃথিবীব্যাপী। এইটুকু অর্জন দিয়েছে পরম শান্তি। যারা ভালোবাসি এই বাংলা, যারা ভালোবাসি এই দেশ, গুটিকতক এই প্রেম নিয়ে বেঁচে থাকি, তাদের বুকে জেগে থাকুক ভালোবাসার দীপ। আলো দিক এপারে ওপারে। বিশ্বের যত গভীর অন্ধকার দূর হয়ে যাক সে আলোর মহাজাগরণে।

Language Day
Advertisment