বহু বছর আগে নানা পাটেকারের (না, না, নানা তখন ‘ভালো’ ছিলেন) একটা ডায়লগ মনে আছে, “এক মচ্ছর আদমি কো হিজরা বনা দেতা হ্যায়।” এখন কথাটা একটু সংশোধন করে বলা যায়, “এক দিওয়ার আদমিকো মচ্ছর বনা দেতা হ্যায়।”
মচ্ছর, অর্থাৎ মশা, ভনভন করে মানুষের শান্তি বিগ্রহ করে, অযথা জ্বালিয়ে খায়, কামড়ে রক্ত বের করে আর মানুষের শরীরে রোগজীবাণু ঢুকিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত এনে দেয়। ঠিক তেমনই হচ্ছে একটা দেওয়াল ঘিরে। এখনও অবধি দুটো শিশুর মৃত্যু হল, আর তাতেও মানুষকে জ্বালানো শেষ হলনা, দেশের সরকারই বন্ধর ঘোষণা হল। আংশিকভাবে ‘শাট ডাউন’ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। সরকারি কাজকর্ম লাটে উঠল। সবই ওই এক দেওয়ালের জন্য। একটা দেওয়াল কয়েকজন মানুষকে মশা বানিয়ে দিচ্ছে আর সাধারণ মানুষকে তারা জ্বালিয়ে খাচ্ছে।
হ্যাঁ, একটা দেওয়াল। তার জন্যও দুটো বাচ্চার মর্মান্তিক মৃত্যু।
আর ২৮ বছর আগেকার হঠাৎ আকার নেওয়া সেই ভয়ঙ্কর সুনামি...
ক্রিসমাসের মুখে এমন ঘটনাই কাঁপাচ্ছিল পৃথিবীকে। হঠাৎ্ নীরবে হোয়াটসঅ্যাপ বেয়ে কাঁপিয়ে দিল একটা মেয়ের “অতি সাধারণ” বিয়ের কাহিনি। “সাধারণ”, কেন না, তার বাবা তার বিয়েতে তাঁর জমানো পুঁজির মাত্র ১% খরচা করেছেন । আবার গরিবদের ৫ দিন ধরে তিনবেলা খাইয়েছেন। ৪৮ টা চার্টার্ড প্লেনে করিয়ে উড়িয়ে এনেছেন তাবড়-তাবড় মহারথীদের। হ্যাঁ এই সেই আম্বানি। মুকেশ আম্বানি। যার “মনের দৌলত”, নিশাকে অন্য পরিবারে দান করলেন গম্ভীর কণ্ঠস্বরে মহানায়ক আমিতাভ বচ্চন। শুধু তাই নয়, সমস্ত অতিথিদের প্রত্যেককে আলাদা পাথরের খোদাই করা টেবিলে, রূপোর থালা, বাটি, গ্লাসে, খাইয়েছেন মুকেশ আম্বানি, এবং বলিউডের তারকারা তাদের পরিবেশন করেছেন।
এসব দেখে দেশবাসী সকলের মতন বিদেশে আমাদের মত মধ্যবিত্ত এন আর আইদের চোখও কপালে। সারা বছর আমরা ধ্যান করে গুগল ঘাঁটতে থাকি কোথায় প্লেনের ভাড়া সবচেয়ে সস্তা, দেশে যাবো বলে। আমাদের মেয়ের বিয়ের সময়ে লোন নিয়ে, বাড়ি ভাড়া করে, দেনায় ডুবে, নিজেকে বিক্রি করে দিই সামান্য কয়েকজন লোক খাওবো বলে। সেখানে দেশের সবচেয়ে ধনী মানুষ কিনা তার জমানো পুঁজির মাত্র ১ % খরচা করলেন তার মেয়ের বিয়ের জন্য, যেটা দাঁড়ায় ‘মাত্র’ ১০০ মিলিওন ডলার (৩,৩৫,০০০ কোটি টাকা)! এটা শুনে শুধু “আচ্ছা” বলা ছাড়া আমাদের আর কোন প্রতিক্রিয়া সাজেনা। কী বলব? হাসবো, না কাঁদবো? দুঃখ পাবো যে মাত্র এই’কটা টাকা খরচা করলেন ভদ্রলোক তার একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য, না গর্ব করব, যে দ্যাখ, লোকটা কত মহান, কত কম খরচা করলেন! দেখে শেখ! ...না কি বেশি খরচা করলেন...না কি কম... কে জানে?
আর, এক্সকিউজ মি! আমরা ঠিক কতটা গরিব? আমার ছেলের বিয়েতে যদি আমার ‘দৌলতের’ ১% খরচা করতে হয় তাহলে ডলারস্টোরের টফি খাইয়েই তো অথিতি সেবন করতে হবে। আমাদের মতন গরিবদের পৃথিবীর অর্থব্যাবস্থায় কোনো স্থান আদৌ আছে কি?
আমার তবে একটা প্রশ্ন আছে -- এ বিয়ের নিমন্ত্রিত কারা? যাদের পরিবেশন করলেন স্বয়ং আমিতাভ বচ্চন এবং শাহরুখ খান, তারা কারা? তাদের একবার চাক্ষুস দেখলেও চোখ-মন জুড়ে যায়।
ক্যানাডায় হাড়-কাঁপানো শীতে এইরকম খবর শুনলে শরীর গরম হয়ে যায়। আর এলোন মাস্কের বোরিং টানেল ছাড়াও এই দুনিয়ায় এখনো কিছু ঘটনা আছে যা এখনো আমাদের মুখ হাঁ করিয়ে দেয়। (কলেজ-লাইফে বলতাম, “বেশি হাঁ করে হাসিসনা, মশা ঢুকে যাবে।” কোন প্রসঙ্গ নেই কথাটা বলার, হঠাৎ মনে পড়ল।)
শুধু কি নিশা আম্বানির বিয়ে? গোটা ভারতবর্ষ দুলছে বিয়ের ধুমে। বলিউডের টপ তিনজন হিরোইনই বিয়ে করে ফেললেন – অনুষ্কা, দীপিকা আর প্রিয়াঙ্কা। এক বছরের মধ্যেই। প্রত্যেকটা বিয়েই চাঞ্চল্যকর আর প্রত্যেকবারই আমাদের মনে করিয়ে দিল আমরা কত গরিব।
কিন্তু সব ছাপিয়ে মনকে নাড়া দিয়ে গেল দুটো বাচ্চার মৃত্যু। যেমন নাড়া দিয়েছিল সেই লাল-জামা পড়া, সমুদ্রের ধারে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সেই প্রাণহীন সিরিয়ান শিশুর ছবিটা, যেটা সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল গত ২০১৫ সালে। ওই ছবির জেরে সারা পৃথিবীর মানুষ একত্র হয়েছিল সিরিয়ান শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিপ্রায়। ক্যানাডা সেই বছর থেকে প্রায় ২৫০০০ শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল, যারা অনেকেই ইতিমধ্যেই ক্যানাডার সিটিজেন হওয়ার যোগ্য হয়ে উঠেছেন। তারা বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু ক্যানাডার প্রতিবেশী দেশের ইতিহাস তেমন বুক-বাজিয়ে কিছু বলার পাবেনা। তারা তো সর্ব দিকে দেওয়াল তুলতেই ব্যস্ত! খুব “সোনার দেশ” “সোনার দেশ” বলছিলে? দেখো সে দেশের হাল।
ভারতের অবশ্য তুলনা নেই সেই দিক থেকে। নিজে খেতে পাক না পাক, অন্য কেউ বিপদে পড়লে ভারত আগে ভাগে এগিয়ে আসে। এমনিতেই ভারতে লাখ-লাখ শরণার্থী। বিভিন্ন দেশ থেকে। নেহাত সিরিয়া থেকে সন্ত্রাসবাদীতে থিক-থিক ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান পেরিয়ে ভারত যাওয়া ভৌগোলিক ভাবে কার্যত অসম্ভব, তা না হলে থরে-থরে সিরিয়ান ঢূকে দেশে একটা ‘সিরিয়া’ বলে রাজ্যই বানিয়ে ফেলতো এতোদিনে। চোখ রাঙ্গাতো কথায় কথায়। র্যাশন কার্ড করে, আধার কার্ড করে এতদিনে “হেনো চাই-তেনো-চাই” বলে হরতাল-মিছিলও বোধহয় করে ফেলতো। ক্যানাডা কিন্তু অতো সহজে ওদের প্রবেশ দেয়নি। মাসের পর মাস ইন্টারভিউ, মেডিক্যাল আর কাগজপত্রের লাটাইয়ে লাট খাইয়েছেন ট্রুডো সরকার। তারপর এখানে এনেছেন। তাই সিরিয়ানরা এখানে ভীষন কৃতজ্ঞ । জাস্টিন ট্রুডোর নামে নাম রাখে সন্তানের।
থাক ভারত আর ক্যানাডার কথা। দুটো দেশেরই মন খুব ভালো। ভারতে আইসিস যে পরিমাণ হানা আনার চেষ্টা করছে আর যেভাবে গত বুধবার এনআইএ চুপচাপ এক আইসিস-অনুপ্রাণিত সন্ত্রাসী মডিউলকে আটক করেছে, এবং ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে, এটা অত্যন্ত প্রশংসাজনক। আমি “হ্যাট্স্ অফ্” বলছি সেই কর্মকর্তাদের! ভারতের ‘ইন্টেলিজেন্স’ ঠেকাতে পারেনা কাকে!
আর এদিকে দেখো! পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী দেশ থর-থর করে ভয়ে কাঁপছে অসহায়, বুড়ো, বাচ্চা শরণার্থীদের দেখে! সারা দেশে দেওয়াল তুলছে। এত্ত বড় বড়, বিশাল দেহী পাহারাদাররা ছোট্ট-ছোট্ট বাচ্চাদের মেরে ফেলছে বর্ডারে। বীরত্বের কী নমুনা !
যেটা প্রয়োজন বলার সেটা হচ্ছে, এখনো কি যথেষ্ট হয়নি? গুগলে “ইডিওট” লিখলে একজনেরই নাম ও ছবি এসে যাচ্ছে। ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ যে কথাটা বুঝে ফেলছে, ‘ন্যাচরাল ইন্টেলিজেন্সের’ সেটা বুঝতে আর কতদিন লাগাবে? ‘ইডিওট’ অনেক থাকতে পারে পৃথিবীতে। তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। কিন্তু একটা মস্ত দেশের প্রধান হওয়ার অধিকার নেই। আর কী কী লাগবে একটা ইম্পিচপেন্টের জন্য? আর কত রোগজীবাণু ঢোকাবে মানবজাতির শরীরে? এই ইম্পিচপেন্টের খবর শুনলে ঘটা করে পুজো দেব! পয়সা দিয়ে চ্যানেল কিনে দেখবো। জয় স্যান্টা! আমার নতূন বছরের এই ইচ্ছাটা পূরণ করো।
অবশ্য, এই কথাটা অনেকেরই অপ্রিয় লাগবে। চোরা-ট্রাম্প-পেট্ যারা, তাদের। কিন্তু যে দুটো বাচ্চার মৃত্যু হল বর্ডার পেরিয়ে আসতে গিয়ে -- একটা শিশুর ক্রিসমাসের দিনে; আর একজন ইয়েমেনি মাকে তার মরণাপন্ন সন্তানকে দেখেতে যেতে দিতে যা করল যুক্তরাষ্ট্র, তাতে অনেকের দোরেই দেওয়াল নির্মাণ হয়ে গেল। এবং একটা দেওয়াল মানুষকে মচ্ছর বানিয়ে দিল।
নতূন বছরে আর কি কি চাওয়া যায়? আসলে নতুন বছর তো আর জানেনা তার জন্মদিন। আমরা জানি। সুর্যকে প্রদক্ষিণ যে হয়ে গেলো তা তো আর পৃথিবী জানেনা। বৈজ্ঞানিকরা জানে আর জ্যোতিষীরা জানে। তাদের রমরমা ব্যাবসা। ক্যালেন্ডার বিক্রেতাদের ভালো সময়। আর টপাস করে আজ ৩১শে ডিসেম্বর থেকে কাল ১লা জানুয়ারী হয়ে গেলো তা পৃথিবী জানবে কি করে? সুর্য জানবে কি করে? গাছ-পালা-জন্তু-পাখি জানবে কি করে? রাত পেড়িয়ে এটা যে একটা নতুন দিন তা বোঝানোর জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার, “হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার!” বলা আর নানান দেশে বিভিন্ন সময় আলোর ভেল্কি ছাড়া সত্যি আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে নতুন কিছু ফারাক হয়না। সেই থোড়-বড়ি-খাড়া থেকে খাড়া-বড়ি-থোড়। মাঝখান থেকে বেশ কিছু বেকুব তাদের ক্রেডিট কার্ডের ব্যালেন্স আর একটু বাড়িয়ে নেয়। ব্যাঙ্ক নীরব হাসি হাসে।
তাই, কি চাইব ভেবে পাচ্ছিনা। প্রত্যেক বছর মুখিয়ে থাকি যাক পুরাতন বছর, আগামী বছরে নিশ্চয়ই কিছু ভালো হবে। কিন্তু হয় কি? ভালো হওয়ানোটা তো আসলে নিজের হাতে। আর যা হচ্ছে, তা ভালোর জন্যই হচ্ছে। যা হচ্ছেনা, তা ভালোর জন্যই হচ্ছেনা, এটা ভেবে নিলেই অনেক শান্তি। নতূন বছরের আমরা করি নতুন প্রতিজ্ঞা, নতুন প্রতীক্ষা। জানুয়ারী পেরোতে না পেরোতেই সব ভুলে ভণ্ডুল। যে ভালো করতে চায় নিজের জীবনে, সে নতূন বছরের অপেক্ষায় থাকবে কেনো? আমার তো মনে হয় জীবনের কাজ আমাদের ভেস্তানো, আমাদের কাজ কি ভাবে ভেস্তে যাওয়া টুকরোগুলো তুলে আবার চলা । এই জীবন। এটাই স্বর্গ। এটাই সত্য। এই সত্য, এই স্বর্গীয়, নির্দয় পৃথিবীর মাঝে যতটা পারা যায় সত্যকে জাপটে ধরে চলতে হবে আরও একটা বছর।
আমার বাবা বলেন, “নো নিউজ মানে গুড নিউজ”। তাই হোক। ২০১৯ যেন “নো নিউজ” বছর হয়।