Advertisment

সেন্ট জনস চার্চ: যেন এক জাদুঘর

শহর কলকাতা ও বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নাম জানা ও না-জানা, স্বীকৃতি পাওয়া ও না-পাওয়া অনেক ঐতিহ্যের খোঁজ। সে সব খুঁজে আনছেন দুই স্থপতি সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগ। সে সব লিপিবদ্ধ থাকছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

সেন্ট জনস গির্জা

‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে’...সেই বণিক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, শহর কোলকাতায় রাজত্ব কায়েম করার শুরুর দিকে জনসাধারণের জন্য প্রথম যে ‘পাবলিক বিল্ডিং’ তৈরি করেছিল, সেটাই আজকের সেন্ট জনস চার্চ। ডালহৌসির ব্যস্ত অফিসপাড়ার মধ্যে ইতিহাসের নানা আকর বুকে নিয়ে যা সবুজ মরুদ্যানের মত দাঁড়িয়ে।

Advertisment

আরও পড়ুন, হাওড়ার জানবাড়ী: তন্ত্রসাধনার গর্ভগৃহ 

এই চার্চের বাগানে শায়িত রয়েছেন কলকাতার তথাকথিত প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নক। ল্যাটিন ভাষায় সমাধি ফলকে লেখা তাঁর মৃত্যু তারিখ ১০ জানুয়ারি, ১৬৯২। অষ্টভূজাকৃতি মুরিশ-স্টাইলের সমাধিটি বানিয়েছিলেন তাঁর প্রথম মেয়ে মেরির স্বামী চার্লস আয়ার। এই সৌধ বানানোর জন্য চেন্নাইয়ের কাছে পল্লভরম থেকে আনীত হয়েছিল পাথর, যার নামকরণই করা হয়েছিল চার্নকাইট। এই সৌধেই শায়িত আছেন জব চার্নকের দুই কন্যা মেরি ও ক্যাথরিন।

publive-image জব চার্নকের সমাধি

জব চার্নক পাটনায় থাকাকালীন এক হিন্দু সদ্যবিধবা মহিলাকে সতীদাহ থেকে উদ্ধার করেন এবং পরে বিবাহ করে নাম দেন মারিয়া। কথিত আছে মারিয়ার মৃত্যুর পর প্রতিবছর তিনি স্ত্রীর কবরে একটি করে মোরগ বলি দিতেন। পরবর্তি কালে সেখানেই চার্নককে কবর দেওয়া হয়। যদিও এ বিষয়ে কোন তথ্য প্রমাণ নেই।

এছাড়া প্রাঙ্গণে রয়েছে বাংলা তথা বম্বের গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্ন-এর সমাধি। কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টি প্রস্তুতকারক ভীম চন্দ্র নাগ যাঁর নামে বানিয়েছিলেন লেডিকেনি মিষ্টি, সেই লেডি ক্যানিং-এর সুসজ্জিত স্মৃতিসৌধ আছে চার্চের উত্তরের বারান্দায়। ইনিই ভারতের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং এর স্ত্রী শার্লট ক্যানিং। ১৮৬১ সালে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর পর দেহ শায়িত হয়েছিল ব্যারাকপুরের লাটবাগানে, এখানে রয়েছে সেই সৌধের হুবহু প্রতিরূপ। 

India Heritage লেডি ক্যানিংয়ের সমাধি

তৎকালীন গণ্যমান্যদের স্মৃতিসৌধ ছাড়াও রয়েছে বেগম ফ্রান্সিস জনসন(১৭২৫-১৮১২)-এর সমাধি। কলকাতার ‘গ্র্যান্ড ওল্ড লেডি’ হিসাবে পরিচিত এই মহিলা সিরাজদৌল্লার মায়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সেই থেকেই নামের আগে বেগম। এক সময় দেশে চলে গেলেও আবার ফিরে এসেছিলেন এখানের রাজকীয় জীবনযাপনের টানে। দাসদাসী পরিবৃত হয়ে হুঁকো সেবন করতে করতে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান। ওনার চতুর্থ স্বামী উইলিয়াম জনসনের উদ্যোগে সেন্ট জনস চার্চের প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ হন তিনি। আর্চ আর গোল স্তম্ভে ঘেরা এই অপূর্ব সুন্দর সমাধির মাথায় গোলাকার গম্বুজ। 

Heritge Kolkata বেগম জনসনের সমাধি

এছাড়া চার্চের দক্ষিণ দেওয়ালে রয়েছে জেমস অ্যাচিলিস কার্কপ্যাট্রিক-এর স্মৃতিসৌধ। হায়দরাবাদের রাজকুমারীর সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদীয়মান ব্যক্তিত্ব কার্কপ্যাট্রিকের প্রেমের কাহিনি নিয়ে উইলিয়াম ডালরিম্পল এর ঐতিহাসিক বেস্ট সেলার ‘হোয়াইট মুঘল’। ১৮০৫ এর ১৫ই অক্টোবর মৃত্যুর পর তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় অধুনালুপ্ত নর্থ পার্ক স্ট্রীট সিমেটারিতে। তাঁর পিতা এবং ভাইয়েরা মিলে সেন্ট জনস চার্চের দেওয়ালে স্মারকসৌধটি নির্মাণ করেন। এই চার্চের দক্ষিণ দেওয়ালে রয়েছে উইলিয়াম ডালরিম্পল-এর পূর্বপুরুষ জেমস প্যাটিল এবং তাঁর স্ত্রীর স্মৃতিসৌধও।

বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ডোরিক থামের বারান্দা, স্টেনড গ্লাসের জানলা আর পিরামিডের মত বেলটাওয়ার নিয়ে হলুদ রঙের সেন্ট জনস চার্চ। 

Kolkata Heritage সেন্ট জনস গির্জা

রাজভবনের উত্তরপশ্চিম কোণের এই জমিতে অতীতে ছিল কবরখানা, পরবর্তীকালে তা ব্যবহৃত হত গোলাবারুদ রাখার কাজে। তারপর এর মালিকানা যায় শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের হাতে। চার্চ তৈরির জন্য জমি তিনিই দান করেন। চার্চ তৈরির খরচ সংগৃহীত হয়েছিল লটারির মাধ্যমে। ১৭৮৪ সালের ৬ এপ্রিল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। নির্মাণকার্য শুরু হয় লন্ডনের ‘সেন্ট মার্টিন-ইন-দ্য-ফিল্ডস’-এর আদলে, স্থপতি ছিলেন ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর লেফটেন্যান্ট জেমস আগ। ১৭৮৭ সালে তৈরি হয় চার্চ, তখন নাম ছিল অ্যাংলিকান ক্যাথেড্রাল অব ক্যালকাটা। ১৮৪৭ সালে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল তৈরি হওয়া পর্যন্ত এ চার্চ ক্যাথেড্রালই ছিল।

চার্চের উত্তর ও পূবদিকে রয়েছে আটটি করে কম্পাসের মাথা-অলা জানলা, ছাদ সমতল, অভ্যন্তরে ভারবহনকারী ডরিক কলাম। প্রবেশের ঢালুপথ তৈরিই হয়েছিল তখনকার মূল যান পাল্কির কথা মাথায় রেখে। ইট ও পাথরে তৈরি নিওক্ল্যাসিকাল ধারার এই স্থাপত্যের ১৭৪ ফুট উঁচু পাথরের টাওয়ারে রয়েছে সুপ্রাচীন ঘড়ি, আজও প্রতিদিন তাতে দম দেওয়া হয়। পশ্চিমদিকের এই ক্লকটাওয়ার দিয়েই চার্চের মূল প্রবেশপথ ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে কিছু সদস্য কবরের মধ্যে দিয়ে চার্চে প্রবেশে আপত্তি তোলায় অল্টারের দিকে ছটি ডরিক কলাম দেওয়া এক পোর্টিকো নির্মাণ করে নতুন প্রবেশপথ বানানো হয়।

Kolkata Heritage পুরনো প্রবেশপথ

বেলটাওয়ারটি নির্মিত পাথর দিয়ে। অষ্টাদশ শতকের শেষে নির্মাণশিল্পে পাথরের ব্যবহার বেশ দুর্লভ ছিল, তাই এই চার্চকে স্থানীয়রা বলতেন ‘পাথুরে গির্জা’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪২) জাপানি বোমায় চার্চের বারান্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

Kolkata Heritage বেল টাওয়ার

চার্চের অভ্যন্তরের হলে দু’সারি কম্পোজিট কলম দিয়ে আইল আর নেভ-এ ভাগ করা বসার জায়গা।

Kolkata Heritage গির্জার অভ্যন্তর

মূল অল্টারের বাঁ দিকে বিখ্যাত শিল্পী জোহান জোফানির আঁকা ‘লাস্ট সাপার’।

Kolkata Heritage মূল অল্টার

ডানদিকে স্টেনড গ্লাসে সুসজ্জিত জানলা।

Kolkata Heritage এই সেই জানালা

জোফানির ছবিটি দ্য ভিঞ্চির মূল ছবির সরাসরি কপি নয়। যীশু এবং তাঁর শিষ্যদের মুখ শিল্পী এঁকেছিলেন তৎকালীন ক্ষমতায় থাকা ফাদার, পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটদের অনুকরণে। ক্রুদ্ধ ম্যাজিস্ট্রেট তরোয়াল দিয়ে ছবিটিতে আঁচড় কাটেন। আজও আড়াআড়ি সেই দাগ লক্ষ্য করা যায়। 

Kolkata Heritage লাস্ট সাপারের ছবি

অল্টারের বাঁদিকে সেন্ট জনস চার্চের আরেক আকর্ষণ ১৮২৪ সালের একটি বিশাল পাইপ অর্গ্যান। বিভিন্ন আকারের দেড় হাজার পাইপ দিয়ে হাওয়া প্রবেশ করিয়ে এই অর্গ্যান বাজানো হয়। অতীতে হাপর ব্যবহার হত, মানুষ লাফিয়ে হাপর চালাতো। তারপর ডি.সি., এখন এ.সি. বিদ্যুৎ সংযোগে চলে এটি। অর্গানটির প্রস্তুতকারক ইংল্যান্ডের উইলিয়াম হিল অ্যান্ড সনস এবং নরম্যান অ্যান্ড বিয়ার্ড লিমিটেড, যারা তৎকালীন নির্বাক চলচিত্রের প্রেক্ষাপটে বাজানো পাইপ অর্গ্যান তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। এত বৃহৎ, প্রাচীন ও সচল পাইপ অর্গ্যানের নিদর্শন এদেশে পাওয়া যায় না। 

Kolkata Heritage পাইপ অর্গ্যান সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না

চার্চের অভ্যন্তরে, দেওয়ালের গায়ে পাথর ও পিতলের নানা ট্যাবলেট, যার প্রতিটি কোনো মানুষ বা ঘটনাকে স্মরণ করায়। বাঁ দিকের অফিসঘর আগে পোশাক বদলের ঘর ছিল, সেখানে রয়েছে কাঠের তৈরি হ্যাঙ্গার, তাতে পোর্সেলিন আর পিতলের হুক। ডানদিকের ঘরটি হেস্টিংসের অফিস ঘর। সেখানে আছে হেস্টিংসের স্বাক্ষরিত পোর্ট্রেট, তাঁর ব্যবহৃত টেবিল-চেয়ার,  ম্যান্টেল ঘড়ি এবং অজস্র পুরোনো ছবি ও শংসাপত্র।

Kolkata Heritage হেস্টিংসের ব্যবহৃত টেবিল

সদস্য হিসেবে সেন্ট জনস চার্চে মাসে তিন টাকা করে দিতে হত, সে যুগের নিরিখে যা এক বিশাল অঙ্ক। তাও এ শহরে ইওরোপিয়ানদের সংখ্যা যত বেড়েছে, ভক্তদের লাইন তত লম্বা হয়েছে। স্থান সংকুলানের জন্য ১৮৪৭ সালে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল তৈরি হয়, তার সাথে সাথে সেন্ট জনস চার্চ তার গুরুত্ব খানিকটা হারিয়ে ফেলে।

বাগানে রয়েছে আরো দুটি স্মারক। সবথেকে বড় ও উঁচুটি বহন করছে দ্বিতীয় রোহিলা যুদ্ধে মৃত ইংরেজ সৈন্যদের স্মৃতি। রোহিলা ওয়ার মেমোরিয়াল। রোহিলারা হল আফগানিস্তান সীমানার পস্তুন উপজাতির একটি অংশ। তাদের একাংশ উত্তর ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস শুরু করে।  ব্রিটিশদের সঙ্গে রামপুরে রোহিলাদের যুদ্ধ বাঁধে (১৭৯৪)। এই রোহিলা যুদ্ধে যে সব ইংরেজ সেনা আধিকারিক মারা গেছিলেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত সেন্ট জন্স চার্চের এই মেমোরিয়াল। স্মৃতিস্তম্ভটি বারোটি থামের ওপর গোলাকার ডোমের আকৃতির, ফলকে খোদিত আছে নিহতদের নাম।

Kolkata Heritage রোহিলা যুদ্ধ স্মারক

পশ্চিমের পাঁচিল ঘেঁষে রয়েছে আরেক সৌধ ‘ব্ল্যাক হোল অব ক্যালকাটা মনুমেন্ট’। শোনা যায় কলকাতা দখলের সময় নবাব সিরাজদৌল্লা একটি ছোট ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলেন প্রায় ১৫০ জনকে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ও গরমে অধিকাংশের মৃত্যু ঘটে। যদিও এ ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে। যে কজন বেঁচেছিলেন, তাঁদের একজন জন হলওয়েল, গভর্নর জেনেরাল হয়ে জিপিও-র কাছে একটি স্মৃতিসৌধ বানান যা ১৮২২ সালে স্থানচ্যুত হয়। ১৯০১ সালে রাইটার্স বিল্ডিং-এর দক্ষিণ পশ্চিম কোণে  লর্ড কার্জন এটির পুনঃস্থাপন করেন। ১৯৪০ সালে, স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলিতে, ব্রিটিশ সরকার এটি সরিয়ে আনেন সেন্ট জনস চার্চে। এভাবেই সেন্ট জনস চার্চের প্রতিটি কোণে এ শহরের ইতিহাস যেন জীবন্ত থমকে আছে।  

heritage
Advertisment