কলকাতার রাস্তাঘাটের নাম বদলানোর একটা হিড়িক পড়ে ২০০৪ নাগাদ। তৎকালীন মহানাগরিক অর্থাৎ মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, ব্রিটিশ আমলের নাম পাল্টে বিভিন্ন বরেণ্য ভারতীয় বা কলকাতাবাসীর নামে নামকরণ করা হবে বহু রাস্তার। নাম বদলের এই প্রথা চলে আগামী এক দশক ধরে, কিন্তু অত সহজেই কি আর ইতিহাস মুছে ফেলা যায়? নতুন নাম যাই হোক, এখনও পুরোনো নামেই পরিচিত শহরের অধিকাংশ রাস্তা।
যেমন ধরুন পার্ক স্ট্রিট, যার নতুন নাম দেওয়া হয় মাদার টেরেজা সরণি। কিন্তু পার্ক স্ট্রিট যে পার্ক স্ট্রিটই রয়ে গেছে, এমনকি সরকারি নথিপত্রে বা নানা অনুষ্ঠানের সরকারি ঘোষণাতেও, তা তো আমরা সকলেই জানি। ব্রিটিশ আমলের ইতিহাসের মতোই জাঁকিয়ে বসে গেছে শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাজপথটির নামও।
এক-আধদিনের ইতিহাস নয়, প্রায় ২৫০ বছরের ইতিহাস। লিখিত রেকর্ডের কথা বলতে গেলে ফিরে যেতে হয় সেই ১৭৬০ সালে, যখন প্রথমবার এই রাস্তার কথা উঠে আসে সরকারি নথিতে। পরবর্তীকালের নথি দেখলে বোঝা যায়, বিশেষ করে এই রাস্তাটির ক্ষেত্রে নাম বদল কোনও নতুন ঘটনা নয়। যত আকারে আয়তনে বেড়েছে কলকাতা, তত বিবর্তন ঘটেছে পার্ক স্ট্রিটের।
১৮৫০ সালে প্রকাশিত 'বেঙ্গল অ্যান্ড আগ্রা ডিকশনারি' থেকে জানা যায়, রাস্তার তৎকালীন নাম ছিল 'Ghorustan ka Rastah' (গোরস্থান কা রাস্তা), ব্যতিক্রমে 'Badamtallee' (বাদামতলি)। রাস্তাটির বিবরণে বলা হয়, "open(ed) on Chowringhee opposite the ‘Chowringhee gate’ of the fort, (ran) easterly to circular road.” ফোর্ট, অর্থাৎ ফোর্ট উইলিয়ামের 'চৌরঙ্গী গেট'-এর বিপরীতে রাস্তার একটি মুখ, এবং সেটি সার্কুলার রোডের পূর্ব দিক ধরে চলে।
ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সির গভর্নর হিসেবে ১৭৬০ সালে হেনরি ভ্যানসিটার্টকে গদিতে বসায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ঠিক হয়, তাঁর ঠিকানা হবে ৫, মিডলটন রোয়ের বেশ বড়সড় তিনতলা ঔপনিবেশিক ধাঁচের বাড়িটি। প্রসঙ্গত, পরবর্তীকালে সেই বাড়িটিই হয়ে যায় লরেটো হাউজ স্কুল, আজও সেটি স্কুলেরই অংশ। যাই হোক, সেই বাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিল বিরাট বাগান, এবং এই বাড়িতে চার বছর থাকেন ভ্যানসিটার্ট।
কিন্তু তাঁর শাসনকালে এতরকম দুর্নীতি এবং অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে, যে একরকম বাধ্য হয়েই ১৭৬৪ সালে ইস্তফা দিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান ভ্যানসিটার্ট। তাঁর ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে এসে ওঠেন ইলাইজা ইম্পে, ফোর্ট উইলিয়ামের অধীনস্থ সেই সময়কার সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি, এবং তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বিশেষ বন্ধু।
এই ইলাইজা ইম্পের হাত দিয়েই পাশ হয় বীরভূমের দেওয়ান মহারাজা নন্দকুমারের চূড়ান্ত অন্যায্য ফাঁসির হুকুম। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন নন্দকুমার, যার প্রতিশোধ স্বরূপ নন্দকুমারকে ভুয়ো জালিয়াতির মামলায় জড়িয়ে অবশেষে ফাঁসির মঞ্চে তোলেন হেস্টিংস। মাধ্যম ছিলেন ইম্পে, যিনি স্বয়ং নন্দকুমারকে দোষী ঘোষণা করেন। ১৭৭৫ সালে কলকাতায় ফাঁসি হয় নন্দকুমারের। কিন্তু অক্ষত থাকেন নি দুই বন্ধুও। দুজনের বিরুদ্ধেই অসৎ আচরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ আনেন টমাস ম্যাকলে, যার ফলে দীর্ঘ সাত বছরের অভিশংসন (impeachment) প্রক্রিয়া চলে হেস্টিংস এবং ইম্পের নামে। শেষমেশ রাজনৈতিক কারণেই দুজনকে নির্দোষ ঘোষণা করে ব্রিটেনের হাউজ অফ কমনস।
পার্ক স্ট্রিটে ফেরা যাক। মিডলটন রোয়ের বাড়ির যে বড় বাগানের কথা বলা হয়েছে, সেই বাগান বা 'পার্ক' থেকেই পার্ক স্ট্রিটের নামকরণ বলে মনে করেন ঐতিহাসিক পি থাঙ্কপ্পন নায়ার। এতটাই বিস্তৃত ছিল এই 'বাগান', যে তৎকালীন কিছু নথি অনুযায়ী সেটি মিডলটন রো থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল সেই রাসেল স্ট্রিটে, এবং এর অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমানে রাসেল স্ট্রিটে অবস্থিত রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের জমিটিও। কিছু জায়গায় বাগানে চরে বেড়ানো হরিণের উল্লেখ রয়েছে, যে কারণে এই বাগানকে নাকি 'ডিয়ার পার্ক' বলা হতো, যদিও এর নির্দিষ্ট কোনও প্রমাণ এখন আর পাওয়া যায় না।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এই রাস্তার নাম হয়েছে বাদামতলা (প্রকারান্তরে Almond Street), ভ্যানসিটার্ট অ্যাভিনিউ, বেরিয়াল গ্রাউন্ড (Burial Ground) রোড, এবং বেরিয়াল গ্রাউন্ড স্ট্রিট। ভারতপ্রেমী জার্মান পণ্ডিত হেনরি ফারডিনান্ড ব্লখমান, যিনি ১৮৬০-এর দশকে কলকাতায় ফারসি ভাষা পড়াতেন, তাঁর 'Calcutta During Last Century' বইটিতে লিখেছেন যে, অতীতে পার্ক স্ট্রিটের নাম ছিল বেরিয়াল গ্রাউন্ড স্ট্রিট, এবং "গোটা দশেক" বাড়ি ছিল তার দু'ধারে।
কলকাতার একটি মানচিত্র বা ম্যাপ তৈরি হয় ১৭৯৪ সালে, সৌজন্যে এ. আপজন (A. Upjohn), যাতে পার্ক স্ট্রিটের উল্লেখ রয়েছে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড হিসেবে, কারণ এই পথ দিয়েই সাউথ পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে যেতে হতো। এই গোরস্থান চালু হয় ২৫ অগাস্ট, ১৭৬৭ সালে, যে কারণে বহুদিন পর্যন্ত পার্ক স্ট্রিটের আশেপাশে বাড়ি কিনতে চাইতেন না কেউ। সাউথ পার্ক স্ট্রিট ছাড়াও এই এলাকায় ছিল নর্থ পার্ক স্ট্রিট, মিশন, এবং টেরিটি গোরস্থান, কালের নিয়মে যেগুলি ভেঙে ফেলা হয়, দ্রুত বাড়তে থাকা শহরের প্রয়োজনে।
আজ যা এপিজে স্কুল, তার ভিতের নীচে রয়েছে এককালের ফরাসী গোরস্থান, এবং অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চের টাওয়ারটি দাঁড়িয়ে রয়েছে নর্থ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানের ওপর। এই গোরস্থানের একমাত্র দৃশ্যমান স্মৃতিচিহ্ন হলো রবার্টসন মনুমেন্ট, যার নীচে রয়েছে রবার্টসন পরিবারের একাধিক কবর। এই পরিবারের অনেক সদস্য একসময় কলকাতা পুলিশে চাকরি করেছেন। ইতিহাসবিদদের বক্তব্য, কলকাতা পুলিশের সঙ্গে যোগসূত্রই সম্ভবত এই মনুমেন্টের অক্ষত থাকার কারণ, যদিও ক্রমাগত গাড়ির ধোঁয়ায় কালো হয়ে যেতে থাকা এই স্তম্ভের চারপাশে এতরকমের হোর্ডিং এবং তারের সমাহার, যে খেয়াল করে না দেখলে সেটি চোখেই পড়বে না।
কবে যে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড হয়ে গেল পার্ক স্ট্রিট, তা সঠিক জানা যায় না, কিন্তু ইম্পে'র 'ডিয়ার পার্ক' থেকেই যদি এই নামকরণ হয়ে থাকে, ধরে নেওয়াই যায় যে ১৭৬০-এর দশকে পাল্টে যায় নাম। শহরের পুরোনো নথি ঘাঁটলে জানা যায়, ১৯২৮ পর্যন্ত চৌরঙ্গী থেকে লোয়ার সার্কুলার রোড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল পার্ক স্ট্রিট। সে বছর কলকাতা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট রাস্তা বাড়াতে শুরু করে, একেবারে চার নম্বর ব্রিজের রেল লাইন অবধি। এই রাস্তা বাড়ানোর কাজ শেষ হয় ১৯৩৪ সালে।
এককালে যতই গোরস্থানের আধিপত্য থেকে থাকুক, কালক্রমে পার্ক স্ট্রিট হয়ে ওঠে কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত এলাকাগুলির অন্যতম, যার দু'ধারে গড়ে ওঠে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, ফ্রিমেসনস হল, এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের মতো প্রতিষ্ঠান, সঙ্গে অজস্র উচ্চবিত্ত পরিবারের বাসভবনও। তবে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আধুনিকীকরণের ঠেলায় ক্রমাগত ভাঙা হয়েছে পুরোনো বাড়ি, বদলে গেছে স্থাপত্য।
গত ৪০ বছরে অতি দ্রুত গতিতে পাল্টে গেছে পার্ক স্ট্রিট, কিন্তু সেই বদল যাঁরা দেখেছেন, সেইসব মানুষও ধীরে ধীরে বিদায় নিয়েছেন। খুব শিগগির এমন দিন আসতেই পারে, যখন অতীতের সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটের একমাত্র যোগসূত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান, বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোডের শেষ নিদর্শন।