Advertisment

ট্যাংরা- নামই যথেষ্ট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কাঁচা চামড়ার চাহিদা তুঙ্গে ওঠে, যার ফলে ভাগ্য পাল্টে যায় ট্যাংরার চিনা বাসিন্দাদের। ব্যবসায় বিপুল লাভের আশায় ক্রমশ বাড়তে থাকে চিনা বাসিন্দা এবং চামড়ার কারখানার সংখ্যা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Tangra, Kolkata

ট্যাংরা চিনা কালীর মন্দির (ছবি- শশী ঘোষ)

এই দুনিয়ায় আজব শহরের অভাব নেই। কিন্তু তাদের মধ্যেও আজব শহর কলকাতা। অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি দেওয়া যাক। একটা নয়, দু-দুটো চায়না টাউন পৃথিবীর আর কোন শহরে আছে বলতে পারেন? কলকাতার আছে ট্যাংরা এবং টেরিটি বাজার। লস অ্যাঞ্জেলেস, স্যান ফ্রান্সিসকো, সিঙ্গাপুর, সিডনি, যেখানেই যান, একটি করেই চায়না টাউন পাবেন, তাও এই ইন্সটাগ্রামের যুগে সাজিয়ে গুছিয়ে ফোটোগ্রাফির উপযোগী করে তোলা, যাতে তাদের মূল চরিত্রের প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট না থাকে।

Advertisment

তিন দশক আগেও পূর্ব কলকাতার ট্যাংরার অলিগলিতে সহবাস করত চামড়ার কারখানা এবং চিনা রেস্তরা। কলকাতাবাসী মাত্রেই বলতেন, সস্তায় "চাইনিজ ফুড" মানেই ট্যাংরা। আদতে এই খাবার ক্যান্টনিজ এবং ভারতীয় রন্ধনপ্রণালীর এক অভিনব মিশ্রণ, যা এমনই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে এই প্রণালী অনুকৃত হয় ভারতের অন্যান্য শহরেও। ভারত ছাড়ুন, কলকাতার চায়না টাউন এবং ইন্দো-চাইনিজ খাবারের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে এই এলাকা যে নিউ ইয়র্ক শহরের অন্যতম জনপ্রিয় একটি রেস্তোরাঁ গোষ্ঠীর নাম 'ট্যাংরা'।

Tangra উপর থেকে ট্যাংরা (ছবি- শশী ঘোষ)

কিন্তু বর্তমান ট্যাংরায় দ্রুতগতিতে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অতীতের সেইসব রেস্তোরাঁ, হারিয়ে যাচ্ছেন চিনা বংশোদ্ভূত সেইসব ভারতীয়, যাঁদের হাতে তৈরি হতো সেই "চাইনিজ ফুড"। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে নিছকই পর্যটন কেন্দ্র হয়ে রয়ে গিয়েছে অনেক চায়না টাউন, কিন্তু কলকাতায় এমনটা হয়নি।

ইতিহাসের নথি বলে, কলকাতারও আগে স্থাপিত হয় ট্যাংরা। ঐতিহাসিক এবং কলকাতা বিশেষজ্ঞ পি থাঙ্কাপ্পন নায়ারের মতে, পড়শি অঞ্চল তোপসিয়ার মতোই ট্যাংরার নামকরণও হয় স্থানীয় ট্যাংরা মাছের নামেই, যা পাওয়া যেত এখানকার জলাভূমির নদীনালায়। তোপসিয়ার মতোই ১৭১৭ সালে কলকাতার অন্তর্ভুক্ত হয় ট্যাংরা, এবং ১৭৫৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব মীর জাফরের কাছ থেকে ৫৫টি গ্রামের ইজারা নিয়ে কলকাতার শহরতলি হিসেবে সেগুলিকে চিহ্নিত করে। সামগ্রিকভাবে এই গ্রামগুলির নাম হয় ডিহি পঞ্চান্নগ্রাম, যাদের মধ্যে ছিল ট্যাংরাও।

কলকাতায় চিনারা আসা শুরু করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বলছেন জয়তী ভট্টাচার্য এবং কুনুর কৃপালনি, যাঁদের ‘Indian and Chinese Immigrant Communities: Comparative Perspectives’ শীর্ষক গবেষণাপত্র কলকাতার চিনা সম্প্রদায়ের ওপর গভীর আলোকপাত করেছে।

কলকাতার হাক্কা চাইনিজ সম্প্রদায় অনেক ব্যবসার সঙ্গেই জড়িত ছিল, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল জুতো তৈরির কাজ।

১৯১০ নাগাদ কিছু চিনা জুতো প্রস্তুতকারক শহরের কেন্দ্র থেকে সরে গিয়ে বসলেন ট্যাংরার জলে-জঙ্গলে। উদ্দেশ্য, চামড়া উৎপাদন তথা জুতো তৈরির নিজস্ব কারখানা খোলা। ভট্টাচার্য এবং কৃপালনি জানাচ্ছেন, ইতিহাসে কিন্তু ট্যাংরা এবং চিনা সম্প্রদায়ের মধ্যে সংযোগের উল্লেখ খুব একটা পাওয়া যায় না। এই এলাকা বহুদিন পর্যন্ত অনুন্নতই ছিল, যে শহর কলকাতায় চিনারা থাকতেন ততদিন অবধি, তার সঙ্গে আকাশপাতাল ফারাক।

এরপর ১৯৫০-এর দশকে নিতান্ত প্রয়োজনের খাতিরেই ট্যাংরা হয়ে ওঠে চায়না টাউন। কিরকম?

মোটামুটি উনিশ শতকের শেষ থেকে যে মধ্য কলকাতা ছিল তাঁদের বাসস্থান তথা কর্মক্ষেত্র, সেখান থেকে কার্যত উৎখাত হয়ে যান বেশ কিছু চিনা বাসিন্দা। কারণ সেসময় নতুন একটি রাস্তা গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় কলকাতা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট, শহরের একেবারে মাঝখান দিয়ে, চিনেপাড়ার বুক চিরে। সুতরাং সেখানকার বাসিন্দাদের ট্যাংরা ছাড়া গতি ছিল না, যেহেতু সেখানে ইতিমধ্যেই ঘর বেঁধেছিলেন কিছু চিনা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কাঁচা চামড়ার চাহিদা তুঙ্গে ওঠে, যার ফলে ভাগ্য পাল্টে যায় ট্যাংরার চিনা বাসিন্দাদের। ব্যবসায় বিপুল লাভের আশায় ক্রমশ বাড়তে থাকে চিনা বাসিন্দা এবং চামড়ার কারখানার সংখ্যা। ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে এলাকার চেহারা, গড়ে ওঠে নিত্যনতুন ঘরবাড়ি, কলকারখানা। শহর থেকে কিছুটা দূরে হওয়ার দরুন নিজেরাই স্থানীয় স্কুল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করে নেন এলাকার মানুষ, যার ফলে বৃহত্তর শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখারও প্রয়োজন পড়ে না তেমন।

তবে এড়ানো যায় নি ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের প্রভাব। জড়িয়ে পড়েছিলেন শুধু কলকাতায় নয়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও বসবাসকারী চিনারা। তাঁদের গবেষণাপত্রে ভট্টাচার্য এবং কৃপালনি লিখেছেন, যুদ্ধের কারণে দেশান্তরিত হন এমন অনেক চিনা, যাঁরা তখনও পিপলস রিপাবলিক অফ চায়নার পাসপোর্টধারী। অথবা কমিউনিস্ট বা কোনোরকম চিন-পন্থী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। যাঁরা এদেশে রয়ে যান, তাঁদের কারোর কারোর স্থান হয় রাজস্থানে কিছু আটক কেন্দ্রে।

ভারত-চিন যুদ্ধের জেরে ভারতের অভ্যন্তরেও নিয়ন্ত্রণ করা হয় চিনা বাসিন্দাদের গতিবিধি। ট্যাংরা যেহেতু সরকারিভাবে কলকাতার সীমানার বাইরে, সেহেতু সেখানকার মানুষকে ট্যাংরার বাইরে বেরোতে হলে অনুমতি নিতে হতো পুরসভা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। এই নীতির ফলে কলকাতার মধ্য এবং উত্তর ভাগে কাঁচা চামড়ার বাজারে পৌঁছনো মুশকিল হয়ে যায় তাঁদের পক্ষে।

যুদ্ধ চলাকালীন ভারত ছেড়ে অন্য দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান বহু সংখ্যক চিনা। তবে যাঁরা রয়ে যান, তাঁদের ফের একবার ভাগ্যন্নোতি ঘটে সত্তর এবং আশির দশকে।

অদ্ভুতভাবে, দীর্ঘদিনের ওঠাপড়া, এবং চিনা সম্প্রদায়ের বাসস্থান হওয়া সত্ত্বেও, ট্যাংরার নাম সেই ট্যাংরাই থেকে যায়। আজ অনেক কমে গেছে রেস্তরাঁর সংখ্যা, ইতিহাস হয়ে গেছে চামড়ার কারখানাও। আদালতের নির্দেশে ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সেগুলি স্থানান্তরিত করা হয় শহরের বাইরে।

আজ এই গোটা এলাকা জুড়ে দেখা যায় যথেচ্ছ নির্মাণের কাজ, সে বাড়ি হোক বা অফিস, অথবা বিলাসবহুল হোটেল। তারই মাঝে নিজেদের অবশিষ্ট সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি রক্ষা করে চলেছেন কলকাতার চিনারা।

kolkata news heritage
Advertisment