কলকাতাবাসী জানেন, এমন মুহূর্ত সত্যিই বিরল, যখন ট্র্যাফিকের চাপে হাঁসফাঁস করছে না মধ্য কলকাতার শিয়ালদা এলাকা। এই পথে যাঁদের যাতায়াত, তাঁরা সদাই অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য ছুটছেন; কেউ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছেন শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরবেন বলে, কেউ অধৈর্যভাবে অপেক্ষা করছেন ভিড়ভাট্টা ছেড়ে বেরোনোর, নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছনোর। শহরের আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী রাস্তাঘাটের মতোই এককালে যা ছিল স্রেফ একটি রাস্তা, বা নির্দিষ্ট কোনও স্থানের নাম, তা আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি গোটা এলাকা।
বর্তমানের 'সাউথ শিয়ালদা রোড' আজ স্রেফ আনুষ্ঠানিক কাজে লাগে; যেমন ঠিকানা লিখতে বা আইনত কোনোকিছু চিহ্নিত করতে। এই রাস্তাই মধ্য কলকাতার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে শহরের পূর্বভাগের জলাভূমির, বিমানবন্দর ও তার দ্রুত হারে বাড়তে থাকা সংলগ্ন এলাকার, এবং বৌবাজার বা লালবাজারের মতো হেরিটেজ পাড়ার, যা স্টেশনের থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে অবস্থিত।
শিয়ালদার নামকরণ কবে হয়েছিল, তার কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই, তবে এই শহরের ইতিহাস যাঁর কণ্ঠস্থ, সেই পি থাঙ্কপ্পন নায়ার লিখেছেন, এই নামের সূত্রপাত সম্ভবত সেই সময়ে, যখন কলকাতা ছিল মূলত জলাভূমি, যার মধ্যে গজিয়ে উঠেছিল কিছু দ্বীপ। জনমানব বর্জিত বলা যায় মোটের উপর। 'শিয়ালদা' সম্ভবত ছিল 'শিয়ালডিহি' (এখানে ডিহি কথাটার অর্থ গ্রাম)। কলকাতার পত্তনের পর সেই শিয়ালডিহিই কালক্রমে হয়ে গিয়েছে শিয়ালদা।
‘Calcutta: Old and New’ বইটিতে উনিশ শতকের কলকাতার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন হ্যারি কটন (H.E.A Cotton)। তাঁর লেখায় পাওয়া যায় যে, ১৬৯০ সালে যখন প্রথম সূতানুটি গ্রাম দখল করে ব্রিটিশরা, সেখানকার পারিপার্শ্বিক এতই মোহিত করে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে যে এই এলাকায় কোম্পানির পাকাপাকি বসতি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কটন লিখে গিয়েছেন এক বহুল প্রচারিত কাহিনী, যা থেকে বোঝা যায়, কীভাবে 'কলকাতা'র পরিকল্পনা আসে চার্নকের মস্তিষ্কে।
"একটি বেশ ছড়ানো পিপুল (অশ্বত্থ) গাছের তলায় মগ্ন হয়ে বসে হুঁকোয় টান দিতেন তিনি (চার্নক), যা দাঁড়িয়ে ছিল বর্তমানের বৌবাজার স্ট্রিট এবং লোয়ার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলে। জায়গাটার নাম ছিল Boytaconnah (বৈঠকখানা), এবং মিলনস্থান হিসেবে পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয়তা বজায় ছিল তার," লিখেছেন কটন। এই বিখ্যাত গাছ স্থান পায় ১৭৯৪ সালে প্রণীত এ আপজন (A. Upjohn) সাহেবের কলকাতার মানচিত্রেও, এবং তার সেই স্থান বর্তমানে শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরের মধ্যে পড়ে।
আজ আর কোনও চিহ্ন নেই সেই অশ্বত্থ গাছের। শহরের ক্রমবর্ধমান আয়তনের সঙ্গে তাল রাখতে এই চত্বরের গাছপালা কেটে সাফ করা হয় ব্রিটিশ আমলেই। কিছু তথ্যসূত্র অনুযায়ী, বাংলার গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়েই কেটে ফেলা হয় গাছটি, তবে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয় নি। বৈঠকখানা অবশ্যই আজও বেঁচে আছে, মূলত জমজমাট বৈঠকখানা বাজারের মধ্য দিয়ে।
কটন আরও লিখেছেন, "১৭৫৭ সালে শিয়ালদাকে বলা হয়েছিল একটি 'উঁচু বাঁধানো পথ, যা পুবদিক থেকে আসছে'।" কটন যখন ভারতে ছিলেন, তখন শিয়ালদা ছিল ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের শেষ স্টেশন। এই রেলওয়ে ছিল দার্জিলিং এবং পূর্ব বাংলার বেশ কিছু পাট ও তামাক উৎপাদনকারী অঞ্চলে পৌঁছনোর সহজতর উপায়। এছাড়াও এই রেলপথ কাজে লাগাত বেশ কিছু সরকারি সংস্থা।
এই এলাকাতেই গড়ে ওঠে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, যার বয়স এখন ১৪৬ বছর, এবং ১৮৭৩ সালে প্রবল সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপের মুখে যা প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশরা। তার জীবদ্দশায় বহুবার নাম পাল্টেছে এনআরএস হাসপাতাল। ইতিহাসের নথি বলছে, এটি প্রথম স্থাপিত হয় 'পপার হসপিটাল', অর্থাৎ 'কাঙাল হাসপাতাল' নামে, যা ১৮৮৪ সালে হয়ে যায় 'ক্যাম্পবেল হসপিটাল অ্যান্ড মেডিক্যাল স্কুল'। শিয়ালদা এলাকাকে কলকাতা শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চল বলেই মনে করা হতো, এবং কটন লিখেছেন যে ক্যাম্পবেল হাসপাতালের অবস্থান ছিল ইচ্ছাকৃত, যেহেতু প্রধানত মারাত্মক ছোঁয়াচে স্মল পক্সের রুগীরাই আসতেন এখানে।
আজ আর প্রত্যন্ত নয় শিয়ালদা, বলাই বাহুল্য। সত্তরের দশকে নির্মিত শিয়ালদা ফ্লাইওভার থেকে নজর করে দেখলে দেখা যায়, আধুনিকীকরণের ঢেউ বাঁচিয়ে আজও এই এলাকায় ইতিউতি দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরোনো কলকাতার স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ কিছু বাড়ি। যে ট্র্যাফিক সঙ্কট কাটাতে ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছিল, তা অবশ্য আজ পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। আজও বৈঠকখানা বাজার কাগজ, কাগজ জাত সামগ্রী এবং লেটারপ্রেস প্রিন্টারের জন্য দেশের অন্যতম প্রধান বাজার, যদিও ডিজিটাল যুগে বেশ কিছুটা কমেছে বিক্রি।
যা নেই, তা হলো এই এলাকার এবং তার ঐতিহ্যবাহী নামকরণের কোনও চিহ্ন।