উত্তর কলকাতার শোভাবাজার এলাকা, এবং বিশেষ করে সেই এলাকায় অবস্থিত রাজবাড়ি, শহরের অবশ্য দ্রষ্টব্য ১০টি স্থানের মধ্যে একটি, বিশেষত দুর্গাপুজোর সময় তো বটেই। অন্তত এমনটাই বিজ্ঞাপন করা হয়। খুব একটা ভুল যে বলা হয়, তা অবশ্য নয়। একথা ভোলার নয় যে এই শোভাবাজার রাজবাড়িতেই আয়োজিত হয় কলকাতার প্রথম জমকালো, বড়মাপের দুর্গাপূজা, যার ফলে আজও অনেক শহরবাসীর কাছেই শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো না দেখলে পুজো সম্পূর্ণই হয় না।
ঠিক কবে যে শোভাবাজারের নামকরণ হয়েছিল, তা আজ আর জানা যায় না। তবে ঐতিহাসিক দলিল সাক্ষী যে, শোভাবাজারের জমিদার পরিবারের রাজবাড়ি তৈরি হওয়ার অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল এলাকার নামকরণ। অবধারিত ভাবেই এই নামকরণ কীভাবে হলো, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত।
এই পাড়ার নামের প্রাচীনতম অপভ্রংশের একটি হলো 'সুবাহবাজার'। ইতিহাসবিদ পি থাঙ্কাপ্পন নায়ারের মতে, এই নামের নেপথ্যে রয়েছে 'সুবাহর বাজার', অর্থাৎ 'সুবেদারের বাজার', শোভাবাজার রাজবাড়ির নাম এই এলাকার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বহু আগেই।
আরও একটি তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, শোভাবাজারের কাহিনি সেই সময় শুরু, যখন কলকাতা শহরেরই কোনও অস্তিত্ব ছিল না, এবং তখনও পৃথক পৃথক গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল সূতানুটি, কলিকাতা, এবং গোবিন্দপুর, যে তিনটি গ্রামকে একত্রিত করে শহরের পত্তন করেন জোব চার্নক। তা এই কাহিনি কতকটা এরকম - বসাক নামে বাংলার এক ধনী ব্যবসায়ী পরিবার তাঁদের আদি নিবাস সপ্তগ্রাম থেকে উঠে এসে বসতি গড়েন সূতানুটিতে। নতুন জায়গায়ও বজায় থাকে তাঁদের ধনভাগ্য, এবং জঙ্গল কেটে সাফ করে বাড়ি তৈরি করেন তাঁরা।
১৬৯০ বা তার কাছাকাছি সময়ে শহর কলকাতার ভিত প্রতিষ্ঠা করেন জোব চার্নক, এবং ১৭৫৭ সালে দেখা যায়, কলকাতার সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলির মধ্যে গণ্য হচ্ছে বসাক পরিবারও। এবং এই সমৃদ্ধি ও খ্যাতির কারণে পরিবারের তৎকালীন কর্তা শোভারাম বসাকের নামেই একটি এলাকার নাম হয় শোভাবাজার।
নায়ারের আরও বক্তব্য যে শোভাবাজার রাজবাড়ির পরিবার, যার কর্তা ছিলেন নবকৃষ্ণ দেব, এই এলাকায় বাস করতে আসেন ১৭৫৮ সালের পরে, যখন তাঁদের আদি নিবাস গোবিন্দপুরে ফোর্ট উইলিয়ামের জন্য জায়গা খালি করতে নিজেদের ভিটে থেকে উৎখাত হয়ে যান তাঁরা। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পান দেব পরিবার, যা দিয়ে পটলডাঙ্গার কাছে জমি কেনেন তাঁরা। এখানে কতদিন তাঁদের বাস ছিল, তা জানা যায় না, কিন্তু নবকৃষ্ণ দেব পরিবারের কর্তা হওয়ার পর শোভাবাজারে উঠে আসেন তাঁরা, কারণ এখানে তখনও জমির দাম অপেক্ষাকৃত কম।
যদিও একাধিক ব্লগার এবং ট্যুর গাইড প্রায়শই বলে থাকেন যে শোভাবাজারের নামের পেছনে রয়েছে নবকৃষ্ণের নেতৃত্বে আয়োজিত বৈঠক বা 'সভা', বিশেষ করে জাত সংক্রান্ত সভা, নায়ারের মতে এই দাবির সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। বহুদিন পর্যন্ত এই এলাকার স্বত্বাধিকারী ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কারণ ভারতীয়দের নিয়মিত কৃষিকার্য চালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স দিতে থাকে তারা, যেখান থেকে আদায় করা হতো খাজনাও।
‘An Historical Account of the Calcutta Collectorate, Collector’s Cutcherry Or Calcutta Pottah Office, from the Days of the Zemindars to the Present Time’ শীর্ষক একটি বইয়ে (১৯৫৮ সালে পুনর্মুদ্রিত) লেখক রেজিনাল্ড ক্রফোর্ড স্টার্নডেল কোম্পানির জারি করা লাইসেন্সের দীর্ঘ তালিকা পেশ করেছেন। ১ মে, ১৭৬৮ সালের হিসেবে লেখা রয়েছে, “The farming license for Soban bazar’s Towbazary for Rs. 275 per annum.” অর্থাৎ 'শোবান বাজারের তোবাজারি'-কে ২৭৫ টাকা বার্ষিক মূল্যে চাষবাসের লাইসেন্স। এই 'তোবাজারি' ব্যাপারটা ঠিক কী, তার কোনও ব্যাখ্যা, অথবা এই লাইসেন্স কার নামে জারি হয়েছিল, তার কোনও উল্লেখ নেই।
ভাগে ভাগে প্রায় ৭০ বছর ধরে নির্মিত শোভাবাজার রাজবাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয় ১৭৫০-এর দশকের মধ্যভাগে, এবং শেষ হয় ১৮৩০-এর দশকে। মুর এবং ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের ধাঁচে গড়া এই ভবনটিকে আজকের যুগে যথেষ্ট সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ এই রাজবাড়ি নির্মাণের মূলে যিনি, সেই নবকৃষ্ণ দেব কিন্তু নিজেকে ব্রিটিশদের কাছে একরকম বিকিয়েই দিয়েছিলেন, কোম্পানির কর্তাদের সঙ্গে যেচে ঘনিষ্ঠতা করেছিলেন সম্পত্তি এবং অর্থের লোভে।
অল্পবয়সেই পিতৃহারা নবকৃষ্ণের মা ছিলেন শক্ত মহিলা, এবং পুত্রের ভবিষ্যৎ উন্নতির কথা ভেবে নিশ্চিত করেছিলেন যে ছেলে যেন ইংরেজি এবং আরবি সহ একাধিক ভাষা শেখে। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে নবকৃষ্ণ ব্রিটিশ আধিকারকদের সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা শুরু করেন, যেমন করতেন তখনকার অনেক ব্যবসায়ীই, এবং ক্রমশ হয়ে ওঠেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফের এক মধ্যস্থতাকারী। কিন্তু ব্রিটিশদের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতার এখানেই শেষ নয়।
অনেকেই সম্ভবত জানেন না ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের নেপথ্যে নবকৃষ্ণের ভূমিকার কথা। সেই যুদ্ধ, যা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত গড়ে দেয়, যে ভিত টলানো যায় নি পরবর্তী ২০০ বছরেও। তাঁর ‘The Corporation That Changed the World: How the East India Company Shaped the Modern Multinational’ শীর্ষক বইয়ে লেখক নিক রবিনস লিখেছেন যে প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে ব্রিটিশদের সক্রিয় সহযোগী ছিলেন নবকৃষ্ণ, ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে।
যেসময় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহ নিজের রাজত্ব এবং কলকাতা শহর ব্রিটিশদের গ্রাস থেকে বাঁচানোর জন্য লড়ছেন, সেসময়ই তাঁর সেনাপতি মীর জাফর ব্রিটিশদের সঙ্গে চক্রান্ত করছেন, সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজে নবাব হওয়ার লোভে। অন্যদিকে নেপথ্যে, বিশেষ করে পলাশীর যুদ্ধের প্রাক-মুহূর্তে, ব্রিটিশদের সাহায্য করে গেছেন নবকৃষ্ণ, কোম্পানির কর্মচারী রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে, রচনা করেছেন সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সিরাজের রাজত্বের পতনের পর তাঁর তোষাখানা লুট করতেও ব্রিটিশদের সাহায্য করেন নবকৃষ্ণ, "৮০০ কোটি টাকা মূল্যের সোনা, রুপো, এবং গয়নাগাঁটি", লিখছেন রবিনস।
বেশিরভাগ মানুষই জানেন না, ক্লাইভ এবং নবকৃষ্ণের বন্ধুত্ব ঠিক কতটা গভীর ছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের বিজয়োৎসব পালন করার উদ্দেশ্যে শোভাবাজারে নিজের বাড়ির দরজা খুলে দেন নবকৃষ্ণ। কথিত আছে, প্রথম "বাড়ির পুজোর" এই উপলক্ষ্যেই আয়োজন করেন তিনি, যেখানে দেবীর পায়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করার আমন্ত্রণ পান ক্লাইভ। তবে এই পুজোয় শ্রদ্ধাভক্তির পাট বিশেষ ছিল না, ছিল ব্রিটিশ অতিথিদের মন পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। খাদ্য-পানীয় বাদেও পুজোর আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশিই ছিল বাইজি নাচের ব্যবস্থাও।
ঠাকুরদালানের যেখানে প্রতিমা বসানো হয়, তার একেবারে মুখোমুখিই ছিল নাচঘর। আজ ভগ্নদশা তার, জলহাওয়া অবাধে খেলে সেখানে, কারণ ছাদ ভেঙে পড়ার পর আর মেরামত করা হয় নি। নাচঘরের একদিকে একটি সিল করা দরজা, যেখান দিয়ে যাতায়াত করতেন বাইজিরা, পরিবারের বাসভবনের থেকে আলাদা পথে।
এই পুজোর বিপুল সাফল্য অনুপ্রেরণা জোগায় অন্যান্য ধনী ব্যবসায়ীদের, যাঁরা স্ব স্ব গৃহে ধুমধাম সহকারে চালু করে দেন দুর্গাপূজা। সবাই অবশ্য বাইজির ব্যবস্থা রাখতেন না। বাড়ির পুজোয় কোনও ইউরোপীয়ের, বিশেষ করে ব্রিটিশের, উপস্থিতি, হয়ে ওঠে অর্থ, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, এবং কোম্পানির সঙ্গে সান্নিধ্যের প্রতীক।
কোম্পানির প্রতি নবকৃষ্ণের আনুগত্যে আপ্লুত ক্লাইভ তাঁকে প্রথমে 'রাজা বাহাদুর', পরে 'মহারাজা' উপাধি প্রদান করে ২,০০০ টাকা বার্ষিক বেতনের ব্যবস্থা করে দেন। নতুন উপাধি গ্রহণ করে কীভাবে বাড়ি ফেরেন নবকৃষ্ণ? "হাতিতে চড়ে, পথেঘাটে টাকার বৃষ্টি করতে করতে," লিখেছেন রবিনস।
ক্লাইভ ভারত থেকে বিদায় নেওয়ার পরেও দু'দশক ধরে অটুট থাকে নবকৃষ্ণের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক। ক্লাইভের পরে ১৭৭৭ সালে ভারতের গভর্নর-জেনারেল হয়ে আসেন ওয়ারেন হেস্টিংস, এবং নবকৃষ্ণ হয়ে যান সূতানুটি এলাকার তালুকদার। গোটা এলাকা জুড়ে তখন জমির দাম ঊর্ধ্বগামী, স্থানে স্থানে গড়ে উঠেছে কলকাতার বিত্তবান ব্যবসায়ী পরিবারগুলির অট্টালিকা। তবে হেস্টিংস জমানার শেষ পর্বে অবনতি ঘটে সম্পর্কের, বিশেষ করে হেস্টিংসের ব্যাপক হারে দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর। এর ফলে নবকৃষ্ণের নিজের আয় এবং কীর্তিকলাপের তদন্ত হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা দেয়।
শিকাগো থেকে ১৮৯৭ সালে ফিরে আসেন স্বামী বিবেকানন্দ, এবং তাঁকে প্রথম গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয় শোভাবাজার রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে। অনুষ্ঠানের একটি বাঁধানো ছবি আজও দেখা যায় রাজবাড়িতে।
আজও শোভাবাজার রাজবাড়িতে ঘটা করেই দুর্গাপূজা হয়, যদিও অতীতের সেই জাঁকজমক আর নেই। রাস্তার ওপারে একটি বড় লাল ইটের, সবুজ খড়খড়ি দেওয়া জানালা-বিশিষ্ট বাড়ি, যাকে ছোট রাজবাড়ি বলা হয়। এই বাড়িতে থাকেন নবকৃষ্ণের ঔরসজাত পুত্র রাজকৃষ্ণের বংশধরেরা, এখানেও প্রতি বছর পুজো হয়। দুটি বাড়িই শহরের 'হেরিটেজ প্রপার্টি'র তালিকায় থাকলেও বড় বাড়ির মালিক হলেন গোপীমোহন দেবের বংশ। এই গোপীমোহন ছিলেন নবকৃষ্ণের বড় ভাই, যিনি তাঁর নিজের পুত্রকে ছোট ভাইয়ের হাতে তুলে দেন দত্তকপুত্র হিসেবে।
আজ হেরিটেজ তকমা থাকলেও অতীতের ছায়া হিসেবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এই রাজবাড়ি। 'রাজপরিবারের' সদস্যরা তাঁদের হৃতগৌরবকে হাতিয়ার করে বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময় তাঁদের বাসভবনকে করে তুলেছেন শহরের অবশ্য দ্রষ্টব্য। রাজ্য সরকারও যথাসাধ্য সাহায্য করেছে এই প্রচেষ্টায়। পারিবারিক ওয়েবসাইটে পরিবার এবং রাজবাড়ির 'হেরিটেজ'-এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকলেও দেশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ায় তাঁদের পূর্বপুরুষের ভূমিকা নিয়ে একবর্ণও লেখা নেই। মুছে ফেলা হয়েছে ইতিহাসের সেইসব পাতা।