Advertisment

খালের ধারের 'উল্টাডিঙ্গি' গ্রাম আজ গমগমে জনবসতি

ডিহি পঞ্চান্নগ্রামের অন্তর্ভুক্ত মারাঠা খালের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির একটি ছিল 'উল্টাডিঙ্গি', যা বর্তমান উল্টোডাঙ্গার অপরিশোধিত সংস্করণ বলে মনে করা হয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kolkata history

বিধানচন্দ্র রায়ের নামাঙ্কিত স্টেশন। ছবি: শশী ঘোষ

উত্তরপূর্ব কলকাতার উল্টোডাঙ্গা এলাকার সঙ্গে সমগ্র কলকাতাবাসীই পরিচিত। শহরের ব্যস্ততম এবং সবচেয়ে জনবহুল এলাকাগুলির অন্যতম, যার একটা বড় কারণ হলো বিধাননগর রোড রেল স্টেশনের নৈকট্য। এলাকার নামকরণ নিয়ে একাধিক তত্ত্ব রয়েছে, তবে শহরের অন্যান্য প্রাচীন এলাকাগুলির মতোই উল্টোডাঙ্গার নামকরণের ইতিহাস নিয়েও কোনও নির্দিষ্ট নথিপত্র নেই।

Advertisment

ডিহি পঞ্চান্নগ্রামের অন্তর্ভুক্ত যেসব গ্রাম, সেগুলি ততদিন পর্যন্ত মারাঠা খালের পরিধির বাইরে ছিল, যতদিন না ১৭৯৯ সালে এই খাল আংশিকভাবে ভরাট করা হয়, তারপর পুরোপুরি বুজিয়ে দেওয়া হয় ১৮৯৩ সালে, যেহেতু ব্রিটিশদের কোনও কাজেই লাগছিল না তা। এই ৫৫টি গ্রামের একটি ছিল উল্টাডিঙ্গি, যা বর্তমান উল্টোডাঙ্গার অপরিশোধিত সংস্করণ বলে মনে করা হয়।

আরও পড়ুন: শিয়ালদহ, যেখানে অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় বসে তামাক খেতেন জোব চার্নক

উল্টাডিঙ্গি গ্রামের উৎপত্তি সম্ভবত মারাঠা খালের আমলে, বলেন কলকাতার ইতিহাসবিদ পি থাঙ্কপ্পন নায়ার। 'উল্টা' কথাটার অর্থ 'বিপরীত', এবং 'ডিঙ্গি' অর্থে ছোট নৌকো। এর সম্ভাব্য মানে হলো, খালের ওপারে ছিল এই গ্রাম, যেখানে খালে চলাচল করা নৌকো তৈরি এবং মেরামত করা হতো।

kolkata history কলকাতার ব্যস্ততম এলাকাগুলির একটি হলো উল্টোডাঙা। ছবি: শশী ঘোষ

খালের অবশিষ্টাংশ আজও রয়েছে অবশ্য, যা এই এলাকার প্রান্তসীমা ধরে আজও বয়ে চলে, ধীর মন্থরগতিতে গিয়ে মিশে যায় বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যত জনবহুল হয়েছে আশেপাশের অঞ্চল, তত শীর্ণকায় হয়েছে খাল, যার পাড়ে গড়ে উঠেছিল উল্টাডিঙি, এবং যা আজ নেহাতই অতীতের ছায়া হিসেবে কেষ্টপুর খাল নামে টিকে রয়েছে।

আরও পড়ুন: শোভাবাজার রাজবাড়ি: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের এক অন্যতম স্তম্ভ

১৯১১ সালে প্রকাশিত সি আর উইলসন রচিত 'The Early Annal of the British in Bengal' বইটিতে এই এলাকাকে তার বর্তমান নামের সাহায্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে ধরে নেওয়া যায়, ভারতে ব্রিটিশরা থাকাকালীনই বদলে গিয়েছিল এই নাম, উল্টাডিঙি হয়ে গিয়েছিল উল্টোডাঙ্গা। নায়ার লিখেছেন, ১৯৩৬ সালে কলকাতা মিউনিসিপাল গেজেটের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলকাতা পুরসভার কাছে উল্টোডাঙ্গা মেইন রোডের নাম পাল্টে সমাজসেবক দীননাথ দাশের নামে রাস্তাটির নামকরণের আবেদন জানান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যানন্দ সিদ্ধার্থরত্ন প্রমুখ, যদিও "কর্পোরেশন এই আবেদন গ্রাহ্য করে নি"।

publive-image বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা কিংবদন্তী চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়ের নামেই বিধাননগর রোড রেল স্টেশন। ছবি: শশী ঘোষ

নায়ার এও বলেছেন যে ১৯৪৪ সালের অগাস্ট মাসে পুরসভার কাছে পুনরায় এই আবেদন এই ভিত্তিতে জানান উল্টোডাঙ্গার কিছু বাসিন্দা, যে এলাকায় অবস্থিত নতুনবাজারের মালিক হিসেবে বিশিষ্টজন হিসেবে গণ্য হন দীননাথ, এবং তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ বাংলার লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য। কিন্তু ফের একবার নাকচ হয়ে যায় এই আবেদন। কেন, তা বিশদে লেখেন নি নায়ার, এবং এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করাও সম্ভব হয় নি।

আরও পড়ুন: ট্যাংরা - নামই যথেষ্ট

উল্টোডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী বিধাননগর রেল স্টেশনের পত্তন হয় ১৮৬২ সালে, ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়েজের শিয়ালদা-কুষ্টিয়া (বর্তমানে বাংলাদেশে) শাখার অধীনে। কবে এর নাম বিধাননগর হলো তা সঠিক জানা না গেলেও, নতুন নামকরণ যে বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা কিংবদন্তী চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায়ের নামেই, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

kolkata history পৌরসংস্থার হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও ফেরানো যায় নি কেষ্টপুর খালের করুণ হাল। ছবি: শশী ঘোষ

কেষ্টপুর খাল, যা একসময়ে জলের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল, বহুবছর ধরে স্থানীয়দের দৌরাত্ম্যে পরিণত হয়েছিল আস্তাকুড়ে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে বেশ কিছু পৌরসংস্থা জানায় যে ক্রমাগত আবর্জনা ফেলার ফলে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে খালের গতিপথ, যার ফলে থেমে গিয়েছে জলের ধারা। সেই জমা জলে বংশবৃদ্ধি করছে মশা, এবং ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে এলাকায়।

অবস্থার ক্রমাগত অবনতির চাপে, এবং ডেঙ্গুতে বাড়তে থাকা মৃত্যুর মুখে অবশেষে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয় রাজ্য সেচ দফতর। চিতপুর লক গেটে হুগলী নদীর জল ছাড়া হয় খালের জমা জল সাফ করতে, এবং মশার লার্ভা বিনাশ করতে জলে ছাড়া হয় গাপ্পি মাছ। তবে এই পদক্ষেপ যে স্রেফ সাময়িক সমাধান ছিল, তা কেষ্টপুর খালের বর্তমান দশা, এবং স্থানীয়দের সোৎসাহে তার মধ্যে আবর্জনা ফেলার বহর দেখলেই বোঝা যায়।

heritage
Advertisment